ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

রাজধানীতে লোডশেডিং, কারও মাথাব্যথা নেই

প্রকাশিত: ০৫:২৯, ৮ অক্টোবর ২০১৬

রাজধানীতে লোডশেডিং, কারও মাথাব্যথা  নেই

রশিদ মামুন ॥ লোডশেডিংয়ের কারণ খোঁজাই বন্ধ করে দিয়েছে বিদ্যুত বিভাগ। উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধির ফলে সরকারের মধ্যে বদ্ধমূল ধারণা জন্মেছে মানুষ এখন যথেষ্ট বিদ্যুত পাচ্ছে। অতিআত্মতুষ্টিতে ভোগাই দেশে লোডশেডিংয়ের বড় কারণ বলে মনে করা হচ্ছে। পিডিবি বলছে তাদের সিস্টেমে কোন সমস্যা নেই। বিতরণ কোম্পানি যখন যতটুকু বিদ্যুত চাইছে তাদের দেয়া হচ্ছে। অন্যদিকে কোন কোন বিতরণ কোম্পানি বলছে তাদের ওই রকম কোন লোডশেডিং নেই। তাহলে মানুষ বিদ্যুত পাচ্ছে না কেন সে প্রশ্নের উত্তর পাওয়া কঠিন। যদিও কেবলমাত্র আরইবি বলছে তাদের সঙ্কট রয়েছে। চাহিদার তুলনায় প্রতিদিন হাজার মেগাওয়াট এখন কম পাচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন যতটা বিদ্যুত নিয়ে সুন্দর সুন্দর প্রচারে মত্ত বিদ্যুত বিভাগ। ঠিক একইভাবে মানুষ বিদ্যুত পাচ্ছে কি পাচ্ছে না তা নিয়ে মাথা ঘামাতে রাজি নয় তারা। অতীতে বিদ্যুতের সঙ্কট সামাল দিতে প্রায় প্রতি সপ্তাহে বৈঠক করে উৎপাদন বিতরণ কোম্পানিকে নির্দেশনা দেয়া হলেও এখন সেসব ভুলেই গেছে বিদ্যুত মন্ত্রণালয়। এখন মোটামুটি সব বৈঠকে বসেই দেশের বিদ্যুত পরিস্থিতির ব্যাপক উন্নয়ন আর সন্তুষ্টি নিয়ে আলোচনা করা হয়। সঙ্কট এখন আর আলোচ্য বিষয় নয়। অর্থাৎ সমস্যা যে রয়েছে তাই মানতে চান না সংশ্লিষ্টরা। বিদ্যুত বিভাগের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, কিছু বিএনপি জামায়াত সমর্থক রয়েছে বিতরণ পর্যায়ে যারা ইচ্ছাকৃতভাবে বিদ্যুত বন্ধ করে রেখে মানুষের অহেতুক ভোগান্তি সৃষ্টি করে। কেন তাদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না এমন প্রশ্নের জবাব অবশ্য তিনি দিতে পারেননি। রাজধানীর প্রায় সকল এলাকায় লোডশেডিং ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। সব থেকে বিরক্তিকর হয়ে উঠেছে রাতের লোডশেডিং। বিদ্যুত বিভাগের তরফ থেকে লোডশেডিংয়ের কথা উল্লেখ করলেই বলা হয় বিতরণ ব্যবস্থার উন্নয়ন না হওয়ায় এই সঙ্কট। তবে প্রশ্ন উঠেছে কেন সরকারের দুই মেয়াদেও উৎপাদন এবং বিতরণের মধ্যে সমন্বয় হবে না? গত আট বছরে বিদ্যুতের উৎপাদন ক্ষমতা ১২ হাজার ৭৮০ মেগাওয়াটে উন্নীত হয়েছে। এতে রাজধানীসহ বড় শহরগুলোতে বিদ্যুত পরিস্থিতি সহনীয় পর্যায় পৌঁছে যায়। লোডশেডিং ইতিহাস হতে চলেছে সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরাও এমন বক্তব্য দেয়া শুরু করেন। এই পরিস্থিতিতে দেশের সর্বোচ্চ চাহিদা নয় হাজার মেগাওয়াট হলেও লোডশেডিং হওয়ার কথা নয়। কিন্তু সাড়ে আট হাজার মেগাওয়াট চাহিদাতে কেন পরিস্থিতি সামাল দিতে হিমশিম দশা এই প্রশ্নের উত্তর নেই কারও কাছেই। পাওয়ার গ্রিড কোম্পানির ওয়েবসাইটে ঘণ্টাপ্রতি বিদ্যুতের চাহিদা এবং প্রাপ্তির জায়গাটি কানায় কানায় পূর্ণ উল্লেখ করা হয়েছে। সেখানে দেশে কোন সঙ্কট নেই বলে দেখানো হচ্ছে। কেন সরকারী একটি প্রতিষ্ঠান এমন ভ্রান্ত তথ্য দিচ্ছে জানতে চাইলেই পাওয়ার গ্রিড কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাসুম আল বেরুনী প্রশ্ন শুনেই ফোনের সংযোগ বিচ্ছিন করেন। পরে আর চেষ্টা করেও তার ফোনে প্রবেশ করা যায়নি। পিডিবির সদস্য উৎপাদন প্রকৌশলী আনোয়ারুল ইসলাম জনকণ্ঠকে শুক্রবার বিকেলে বলেন, আমাদের সিস্টেমে কোন লোডশেডিং নেই। বিতরণ কোম্পানিগুলোকে তাদের চাহিদা অনুযায়ী আমরা বিদ্যুত দিচ্ছি। কিন্তু মানুষ কি বিদ্যুত পাচ্ছে? এমন প্রশ্নে তিনি নিজের গ্রামের (ফেনি) কথা উল্লেখ করে বলেন, আমার গ্রামেই চার থেকে পাঁচ ঘণ্টা লোডশেডিং হয় বলে আমাকে সেখান থেকে জানানো হয়েছে। এর কারণ হিসেবে বিতরণ সীমাবদ্ধতাকে দায়ী করেন তিনি। সেখানে পিডিবির আসলে কিছুৃ করণীয় নেই বলে জানান পিডিবির এই শীর্ষ কর্মকর্তা। রাজধানীর বেশিরভাগ এলাকায় বিদ্যুত সরবরাহকারী কোম্পানি ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির (ডিপিডিসি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব) নজরুল হাসান লোডশেডিংয়ের কথা শুনে খানিকটা অবাকই হন। তিনি পাল্টা প্রশ্ন করেন কোথায় লোডশেডিং হচ্ছে? রাজধানীর ধানম-ি, পরিবাগ, রামপুরা, বনশ্রীসহ কয়েকটি এলাকার কথা বললে তিনি জানান, ধানম-ি এবং উলনে ক্যাবলে সমস্যার কারণে একটু লোডশেডিং হচ্ছে। তবে এর বাইরে কোথাও তেমন লোডশেডিং নেই। রাজধানীর পান্থপথের বাসিন্দা সাইফুদ্দিন ভূঁইয়া বলেন, পান্থপথে গত এক মাসে যে পরিমাণ লোডশেডিং হয়েছে তা গত দুই বছরেও হয়নি। আকস্মিক এই বিদ্যুত বিভ্রাটের কারণ কি তা জানার জন্য স্থানীয়ভাবে যোগাযোগ করা হলেও তার উত্তর কেউ দেননি। স্থানীয় বিতরণ কোম্পানির অভিযোগ কেন্দ্রের দায়িত্বরতরা এক এক সময়ে লোডশেডিংয়ের এক একটি কারণ জানান। রাজধানীর তেজগাঁওয়ের শাহীনবাগের বাসিন্দা মাহমুদুল হাসান সজীব বলেন, তাদের এলাকায় ঘণ্টায় ঘণ্টায় বিদ্যুত যায়। গত তিন চার দিনে এই পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। গত মঙ্গলবার তো এক ঘণ্টা পর এক ঘণ্টা বিদ্যুত ছিল না। এই সপ্তাহের অন্য দিনগুলোতেও বিদ্যুতের এই যন্ত্রনা সহ্য করতে হয়েছে বলে জানান তিনি। রাজধানীর বনশ্রীর বাসিন্দা জোবায়ের হোসেন বলেন, ইদানিং শুরু হয়েছে মধ্য রাতের বিদ্যুত বিড়ম্বনা। হুট করে দেখা যায় রাত একটার দিকে এক ঘণ্টা বিদ্যুত নেই। আবার তিনটা বা চারটার দিকে বিদ্যুত চলে যায়। তীব্র গরমে ঘুম ভেঙ্গে যায়। এছাড়া দিনের বেলায় বিদ্যুতের যন্ত্রণা তো নিত্যসঙ্গী বনশ্রীর বাসিন্দাদের। রাজধানীর মোহাম্মদপুর, মিরপুর, পুরান ঢাকার ওয়ারি, চানখারপলু, যাত্রাবাড়ী, উত্তরা, রামপুরা, ফার্মগেট, গ্রীনরোড, ধানম-িসহ ঢাকা ডিপিডিসি এলাকায় লোডশেডিং সব থেকে বেশি। এছাড়া ঢাকার আরেক বিদ্যুত বিতরণ প্রতিষ্ঠান ঢাকা ইলেকট্রিক পাওয়ার ডিস্টিবিউশন কোম্পানি (ডেসকো) এলাকায়ও রয়েছে লোডশেডিং। ডেসকোর উত্তরা, বনানী, গুলশান, মিরপুর এলাকায় নিয়মিত লোডশেডিং করা হচ্ছে। ঢাকার দুই বিতরণ কোম্পানির এলাকায় গড়ে ৩ থেকে ৪ ঘণ্টা লোডশেডিং করা হচ্ছে। পিডিবি সূত্র জানায়, গত কয়েকদিন রাজধানীর পাশেরই হরিপুরের গ্যাসভিত্তিক ৪১২ মেগাওয়াট বিদ্যুত কেন্দ্রটি বন্ধ ছিল। শুক্রবার সকাল থেকে বিদ্যুত কেন্দ্রটি চালু হয়েছে। গ্যাসের সঙ্গে বর্জ্য আসায় কেন্দ্রটি বন্ধ রাখতে হয়। এর বাইরে আশুগঞ্জে আরেকটি ৪৫০ মেগাওয়াটের বিদ্যুত কেন্দ্রও যান্ত্রিক গোলযোগে বন্ধ ছিল। বৃহস্পতিবার রাতে কেন্দ্রটি চালু হয়। এর বাইরে গ্যাসের সঙ্কটে গড়ে এক হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুত কেন্দ্র বন্ধ রাখতে হয়। এ ছাড়াও পিক আওয়ারের পর তেল চালিত বিদ্যুত কেন্দ্রের উৎপাদন কমিয়ে দেয়া হয়। এতে সঙ্কট আরও বৃদ্ধি পায়। সারাদেশে গ্রামের পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ। এখন আরইবিতে গড়ে দৈনিক এক হাজার মেগাওয়াটের কম বিদ্যুত দেয়া হচ্ছে। আরইবির সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, কয়েকদিন হলো লোডশেডিং বেড়েছে। এর মূল কারণ সরবরাহ কম পাওয়া। তবে আরইবি সক্ষমতা বিচার না করেই প্রতিমাসে চার লাখের মতো সংযোগ দিচ্ছে। যা গ্রামে লোডশেডিংয়ের আরেকটি বড় কারণ বলে মনে করা হচ্ছে।
×