ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

কুমারী পূজার সন্ধিক্ষণ আজ

শারদোৎসব- সম্প্রীতির নিবিড় বন্ধনে অটুট মিলনমেলা

প্রকাশিত: ০৫:২৮, ৮ অক্টোবর ২০১৬

শারদোৎসব- সম্প্রীতির নিবিড় বন্ধনে অটুট মিলনমেলা

সমুদ্র হক ॥ সমস্ত অশুভ শক্তির বিনাশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির মধ্য দিয়ে সারা বিশ্বে এখন চলছে শারদীয় উৎসব। বসুন্ধরার প্রতীক নয়টি গাছের পাতাকে একসঙ্গে সাজিয়ে সজীব করে তোলা হয়েছে নতুন লালপেড়ে শাড়িতে। শরতের কাশবনের শুভ্রতায় ঘটে বা ঘোড়ায় চড়ে কৈলাশ থেকে মর্তলোকে বাবার বাড়িতে দেবী দুর্গার আগমনে বিশ্বময় এখন উৎসবের আমেজ। এই ঘোড়ায় চড়েই এবার ফিরে যাবেন স্বর্গালোকে। শুক্রবার সায়ংকালে বিকেলের তিথিতে দেবীর বোধনে মহাষষ্ঠী দিয়ে মূল উৎসবের সূচনা হয়েছে। শনিবার নবপত্রিকা বা নয়টি গাছের পাতায় মহাসপ্তমীর পর অষ্টমীতে কুমারী পূজার সন্ধিক্ষণ। পরের দিনে নবমী নবরাত্রিক ব্রত সমাপন শেষে বিজয়া দশমীতে বিসর্জনের অপরাজিতা পূজা হয়ে সমাপন ঘটবে এই উৎসবের। ঢাকের কাঠির বাদ্য আর ধূপের গন্ধে, ধোঁয়ায় পুরোহিতগণ দিবসগুলোর পূজা শুরু করেছেন শাস্ত্র অনুসারে। ভক্তরা শৃঙ্খলা বজায় রেখে প্রবেশ করছে পূজাম-পে। একেকটি পূজাম-প একেক রকম সাজে সেজেছে। শিল্পীরা তুলির নিপুণ ছোঁয়ায় সাজিয়েছেন প্রতিমাকে। দুর্গা দেবীর দশ হাতে অস্ত্র ও অলঙ্কারে সেজে এসেছেন ত্রিভুবনে। দুর্গা পরিবারের প্রত্যেকেরই আছে বাহন। দুর্গার বাহন সিংহ, কার্তিকের ময়ূর, সরস্বতীর হাঁস, লক্ষ্মীর পেঁচা ও গণেশের বাহন ইঁদুর। পুরাণে প্রতিটি বাহনের তাৎপর্যের বর্ণনা আছে। যে নয়টি গাছের পাতায় (নবপত্রিকা) সজীবতা তুলে ধরা হয় তাও অর্থপূর্ণ। যেমন লক্ষ্মীর স্বরূপ ধান গাছ। শোক রহিতা অশোক গাছ। এভাবে এসেছে কলা পাতা, কচুপাতা, হলুদ, ডালিম, বেল, জয়ন্তী ও মানকচু। গণেশ মূর্তির ডানপাশে রাখা হয় এই নবপত্রিকা। কৃষিনির্ভর জীবনযাত্রা ও সংস্কৃতির নিবিড় সংযোগ আছে এর মধ্যে। হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের শারদীয় দুর্গোৎসবের দুর্গা নামের আরেক অর্থ দুর্জয়া। তিনি দুর্গম নামে একেক অসুরকে বধ করেছিলেন। দুর্গার কাহিনীতে বর্ণিত আছে- মার্কেন্ডেয় পুরাণের অধীনে সপ্তশতী চ-িতে। এ জন্য দুর্গাপূজার অপরিহার্য অংশ চ-িপাঠ। গ্রন্থ পড়ে জানা যায় : দুর্গার আবির্ভাবের মূলে রয়েছে পরাক্রান্ত শত্রু ও সংস্কৃতির বিরুদ্ধাচরণকারীর বিপক্ষে সংঘবদ্ধ অভিযান এবং বিজয় অর্জন। পুরাণের রামায়ণের একাংশে বলা আছে : রামচন্দ্র রাবণ বধের জন্য দেবী দুর্গাকে আহ্বান জানিয়েছিলেন। নিদ্রিতা দেবীকে বোধন করেছিলেন। এ জন্য শারদীয় দুর্গাপূজাকে অকাল বোধনও বলা হয়। সদ্য জাগরিতা দেবীর কথা ছিল এ রকম- তিনি সপ্তমী তিথিতে দিব্যধনুর্বানে প্রবেশ করবেন। অষ্টমীতে রাম রাবণের যুদ্ধ হবে। অষ্টমী ও নবমীর সন্ধিক্ষণে রাবণের দশ মাথা লুটিয়ে পড়বে। দশমীতে রামচন্দ্র বিজয় উৎসব করবেন। আরেক পুরাণে আছে : পুরাকালে একসময অসুরদের রাজা মহিষাসুর দেবরাজ ইন্দ্রকে পরাজিত করে স্বর্গরাজ্যের অধিপতি হয়ে বসলেন। পরাজিত ও স্বর্গ থেকে বিতারিত দেবতারা ব্রহ্মকে সামনে রেখে শিব ও বিষ্ণুর কাছে গিয়ে অসুরদের দৌরাত্ম্যের কথা বর্ণনা করেন। মহিষাসুর বিনাশের জন্য তাদের শরণাপন্ন হলেন। এই কথা শুনে প্রচ- ক্ষুব্ধ হলেন শিব ও বিষ্ণু। মুখম-ল থেকে বের হলো মহাতেজ। এইসব তেজ এক অনুপম দেবমূর্তি ধারণ করল। তিনি হলেন দুর্গা। দেবতারা এই মহাদেবীকে অস্ত্রে ও অলঙ্কারে সাজিয়ে দিলেন। হিমালয় দিলেন সিংহ, ব্রহ্মা দিলেন অক্ষ মালা ও কুম-ল। শিব দিলেন ত্রিশূল। বিষ্ণু দিলেন চক্র। বরুণ দিলেন শঙ্খ ও ইন্দ্র দিলেন বজ্র। দুর্গা সকল দেবের সম্মিলিত শক্তি হয়ে বিশ্ব শক্তিতে পরিণত হয়ে বধ করলেন অসুর শক্তিকে। দেশের বিভিন্ন জাদুঘরে সংরক্ষিত নিদর্শনের মধ্যে দুর্গা মূর্তির সংগ্রহ বেশি। ইতিহাস থেকে জানা যায় : এই অঞ্চলে দুর্গাপূজার প্রবর্তন করেছিলেন রাজশাহীর তাহেরপুরের রাজা কংস নারায়ণ। দুর্গাপূজাকে জনপ্রিয় করে তোলেন প-িত রঘুনাথ ও নদীয়ার মহারাজা কৃষ্ণ চন্দ্র রায়। জাতপাত শ্রেণী বিভেদ ভেঙ্গে এই পূজাকে সর্বজনীন রূপ দেন স্বামী বিবেকানন্দ। ১৯০১ সালে প্রথম এই সর্বজনীন পূজা হয় বেলুর মঠে। বিশ্বজুড়ে হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা এখন সার্বজনীন দুর্গাপূজা করে। পূজাম-পগুলো এই সময়ে পূজারিদের আগমনে মুখরিত। দর্শনার্থীদের ভিড় বেড়েছে। পূজার আভিধানিক অর্থ : পুষ্প চন্দন দিয়ে অভিষ্ট দেবতার কাছে নিজেকে উৎসর্গ। আলো ঝলমলে ম-প ঘিরে প্রতিটি স্থানেই বসেছে মেলা। ঢাকের বাদ্যির তালে মেলা পেয়েছে আরেক ছন্দ। পূজার সময় ঢাকের তালে ধূপদানি নিয়ে ক্লাসিক নাচের মতো করে তরুণ-তরুণীদের নাচ দর্শনার্থীদের মাতিয়ে তোলে। পুরোহিত পূজা করেন শাস্ত্রের সকল অনুষঙ্গ মেনে। প্রতিমা বরণের পর উলু দিয়ে শঙ্খ বাজিয়ে প্রদক্ষিণ করা হয়। উৎসবের আয়োজনে থাকে সিঁদুর খেলা। তরুণী বধূরা মেতে ওঠে সিঁদুর খেলায়। একে অপরকে রাঙিয়ে দেয়। পরস্পরের সিঁথিতে হাতের নোয়ায় সিঁদুর দিয়ে মঙ্গল কামনা করা হয়। পূজার আরেক অনুষঙ্গ প্রসাদ বিতরণ। দুর্গাপূজার আনন্দে খাবার তালিকায় নারিকেলের নাড়ু সন্দেশ লুচি সবজি দিয়ে নিমন্ত্রণ জানায় একে অপরকে। হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় শারদীয় উৎসবে বাড়ির প্রত্যেক সদস্য পরে নতুন পোশাক। সম্প্রীতির বন্ধনে সকল ধর্মাবলম্বীকে তারা নিমন্ত্রণ করে। ষষ্ঠী থেকে দশমী, পাঁচ দিনের এই পূজা সমাপনী হয় বিসর্জনের মধ্য দিয়ে। পুরোহিত পরবর্তী বছরে পুনরায় পরিবারসহ দেবীকে মর্ত্যে আগমনের আহ্বান জানিয়ে সমস্ত আনুষ্ঠানিকতার ইতি টানেন। বাঙালীর সার্বজনীন এই পূজা সম্প্রীতির বন্ধন হয়ে অটুট থাকে। মানুষে মানুষে সম্প্রীতির বন্ধনের মিলনমেলা এই দুর্গোৎসব।
×