ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

মুক্ত চিন্তা ও মত প্রকাশের মাধ্যম

প্রকাশিত: ০৩:৫৩, ৮ অক্টোবর ২০১৬

মুক্ত চিন্তা ও মত প্রকাশের মাধ্যম

শিল্প-সাহিত্যের বিকাশে ছোট কাগজের ভূমিকা অপরিসীম। যুগ যুগ ধরে সৃষ্টিশীল সাহিত্য ধারাকে প্রবহমান রেখে আসছে ছোট কাগজ বা লিটল ম্যাগাজিন। শিল্প, সাহিত্য ও জ্ঞান-বিজ্ঞান বিষয়ে চলমান ধারাকে চ্যালেঞ্জ করে ব্যতিক্রমধর্মী চিন্তাধারা ও মতামত ব্যক্ত করার মুদ্রিত মাধ্যম হচ্ছে ছোট কাগজ। সৃজন, মননের স্বাধীন প্রকাশ মাধ্যম হিসেবেই এর আবির্ভাব। ধারণা করা হয়, উনিশ শতকের প্রথমার্ধে ইউরোপ-আমেরিকা থেকে শুরু হয়েছিল ছোট কাগজের যাত্রা। আজ তা পৃথিবীব্যাপী চলমান। অনেকের মতে, পাশ্চাত্যের আদলে আমাদের দেশে প্রথম ছোট কাগজ প্রবর্তন করেন প্রমথ চৌধুরী। তার সম্পাদনায় প্রকাশিত ‘সবুজপত্র’ (১৯১৪) বাংলা ভাষায় প্রকাশিত আধুনিক ছোট কাগজের আদিরূপ বলে গণ্য করা হয়। আর গত শতাব্দীর ষাটের দশক থেকে ছোট কাগজ প্রচলিত ও বাণিজ্যিক ধারার পত্রপত্রিকার বাইরে ব্যতিক্রমধর্মী আন্দোলন হিসেবে রূপ নেয়। ছোট কাগজে লিখতে লিখতেই অনেকে আজ প্রতিষ্ঠিত কবি-সাহিত্যিক। বাংলা সাহিত্যের অনেক খ্যাতিমান কবি-সাহিত্যিকের আবির্ভাব ঘটেছে এই ছোট কাগজের মধ্য দিয়ে। সাহিত্য ও সংস্কৃতির পাদপীঠ নেত্রকোনা জেলা ছোট কাগজ আন্দোলনের অন্যতম অংশীদার। স্বাধীনতাপূর্ব কাল থেকে এ পর্যন্ত নেত্রকোনা থেকে বহু ছোট কাগজ প্রকাশিত হয়েছে। বলা হয়ে থাকেÑ ‘ছোট কাগজের জন্মই হয় মৃত্যুর জন্য।’ এর ব্যত্যয় ঘটেনি এখানেও। অধিকাংশ ছোট কাগজ দু-একটি সংখ্যার পর আর আলোর মুখ দেখেনি। কোন কোনটি প্রকাশিত হচ্ছে অনিয়মিতভাবে। আবার নিয়মিতও প্রকাশিত হয় দু-একটি কাগজ। স্বাধীনতা পূর্বকালে নেত্রকোনার সবচেয়ে আলোচিত কাগজ ছিল ‘উত্তরাকাশ’। ষাটের দশকের প্রথম দিকে মৌলিক গণতন্ত্রের মুখপত্র হিসেবে কাগজটির যাত্রা শুরু। কিন্তু সম্পাদক সুসাহিত্যিক খালেকদাদ চৌধুরী ক্রমান্বয়ে এটিকে সাহিত্যের ছোট কাগজে রূপ দেন। এ কাগজেই ১৯৬১ সালে কবি নির্মলেন্দু গুণের প্রথম কবিতা ‘কা-ারী’ ছাপা হয়। উত্তরাকাশে যারা লেখালেখি করতেনÑ তাদের অনেকে পরবর্তী সময়ে খ্যাতিমান কবি-সাহিত্যিক হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন। স্বাধীনতা পরবর্তীকালে খালেকদাদ চৌধুরীর সম্পাদনায় নেত্রকোনা সাধারণ গ্রন্থাগার থেকে প্রকাশিত হয় ‘সৃজনী’। এটিও বহুল প্রচারিত সাহিত্য পত্রিকা। বেশ কয়েক বছর প্রকাশিত হয় কাগজটি। আশির দশকে প্রত্যাশা সাহিত্য গোষ্ঠী প্রকাশ করে ছোট কাগজ ‘চেতনা’। এর প্রথম সম্পাদক ছিলেন মাসুম পারভেজ। শূন্য দশক পর্যন্ত এটির প্রকাশনা অব্যাহত ছিল। মাসুম পারভেজের পরবর্তীকালে সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন নূরুর রহমান, মিজানুর রহমান মাসুম, সিজার মল্লিক ও ছড়াকার সঞ্জয় সরকার। নব্বই দশকের প্রথম দিকে নেত্রকোনা সাহিত্য সমাজ প্রকাশ করে ছোট কাগজ ‘অক্ষর’। প্রথম সংখ্যাতেই কাগজটি আলোচনায় উঠে আসে। কাগজটির প্রথম সম্পাদক ছিলেন সৈয়দ নাজমুল করিম। পরবর্তীকালে ক্রমান্বয়ে এটি সম্পাদনা করেন গাজী মোবারক হোসেন, মাহবুব কবির এবং শিমুল মিলকী। নেত্রকোনা সাহিত্য সমাজের বসন্তকালীন সাহিত্য উৎসব উপলক্ষে নিয়মিত প্রকাশিত হতো এ কাগজটি। তবে ২০১৪ সালের পর এটি আর প্রকাশিত হয়নি। ’৯০ দশকে মোহনগঞ্জ থেকে মুক্তস্বর সাংস্কৃতিক সংগঠন বের করে রইস মনরম সম্পাদিত ‘টুকরো কাগজ’। ১৯৯৫ সালে নেত্রকোনা সদরে সঞ্জয় সরকারের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় ‘ধীরে বহে ধলাই’। এর কাছাকাছি সময়ে মদন থেকে প্রকাশিত হয় দেওয়ান মর্তুজা আহমেদ সম্পাদিত ‘বেগবতী মগড়া’ এবং কেন্দুয়া থেকে দুজাহান তালুকদার সম্পাদিত ‘দরিয়া’। শূন্য দশকে নেত্রকোনা থেকে বেশ কয়েকটি ছোট কাগজ প্রকাশিত হয়। এর মধ্যে সরোজ মোস্তফা সম্পাদিত ‘অণুধ্যান’, বারীণ ঘোষ সম্পাদিত ‘ঝড়’, রাজীব আর্জুনী সম্পাদিত ‘মস্তক’, তানভীর জাহান চৌধুরী সম্পাদিত ‘বোধ’ উল্লেখযোগ্য। ২০০০ সালে আনোয়ার হাসানের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় ‘তৃণযোগ’। পরবর্তীতে তিনি ‘আসর’-এর সম্পাদক হন। দ্বিতীয় সংখ্যার ‘আসর’ সম্পাদনা করেন আবুল কাইয়ুম আহমেদ। ২০০৫ সালে নেত্রকোনা সরকারী কলেজের সাহিত্যকর্মীরা প্রকাশ করে ‘পিদিম’। প্রথমদিকে পল্লব চক্রবর্তী এবং পরবর্তীতে শিশির রাজন কাগজটি সম্পাদনা করেন। একই কলেজ থেকে ২০০৯-১০ সালে প্রকাশিত হয় ‘পলিমাটি’। ২০০৬ সালে রহমান জীবনের সম্পাদনায় কেন্দুয়া থেকে প্রকাশিত হয় ‘কু-লী’। ২০১৪ সালে নেত্রকোনার সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘বাতিঘর’ প্রকাশ করে শিশির রাজন সম্পাদিত কবিতার কাগজ ‘বাতিঘর’। নেত্রকোনায় বর্তমানে টিকে থাকা ছোট কাগজগুলোর মধ্যে ‘আগমনী’ অন্যতম। ২০০৬ সাল থেকে প্রতিবছর শারদীয় দুর্গোৎসবে প্রকাশিত হয় কাগজটি। সম্পাদনা করেন হারাধন সাহা। ২০০২ সাল থেকে দুর্গাপুরের গাভীনা গ্রামের জলসিঁড়ি পাঠাগার থেকে দীপক সরকার প্রকাশ করছেন ‘জলসিঁড়ি’। এখনও এটি অনিয়মিতভাবে প্রকাশিত হয়। এছাড়া কলমাকান্দা হতে ১৯৯৭ সাল থেকে আবু সাইদ কামালের সম্পাদনায় অনিয়মিতভাবে প্রকাশিত হচ্ছে ‘পাদদেশ’। কলামাকান্দার নূরুল হক সম্পাদনা করছেন ‘কলমীলতা’। এদিকে কেন্দুয়ার চর্চা সাহিত্য আড্ডার উদ্যোগে ২০১৫ সাল থেকে প্রকাশিত হচ্ছে ‘চর্চাপত্র’। সম্পাদনা করছেন রহমান জীবন। মদন থেকে দেবব্রত দাশ সম্পাদনা করছেন ‘সড়ক’। এছাড়া ছড়া ও ছড়া বিষয়ক প্রবন্ধ নিয়ে ‘ছড়াছড়ি’ নামক ছড়ার কাগজ সম্পাদনা করছেন সঞ্জয় সরকার। ২০১৬ সালে কাগজটির প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয়। শুরুতেই কাগজটি পাঠকদের দৃষ্টি কাড়ে। এ ছাড়া উদীচী শিল্পী গোষ্ঠীর নেত্রকোনা জেলা সংসদ থেকে অনিয়মিতভাবে প্রকাশিত হয় ‘সংস্কৃতিবাণী’। এছাড়াও বিভিন্ন সময়ে নেত্রকোনা থেকে প্রকাশিত ছোট কাগজগুলোর মধ্যে শ্যামগঞ্জের মিজানুর রহমান বাবু সম্পাদিত ‘আগমন’, নেত্রকোনা সদরের সিজার মল্লিক সম্পাদিত ‘গাঙ ঢেউ’, ল’ কবির সম্পাদিত ‘বৈশাখী’, মোহনগঞ্জের রইস মনরম সম্পাদিত ‘সময়’, কলমাকান্দার হেমেন্দ্র তালুকদার সম্পাতি ‘হিরণ¥য়’, দুর্গাপুরের জালাল রনি ও রূপন সরকার সম্পাদিত ‘সময়ের কলরব’, স্বাধীন আসাদ সম্পাদিত ‘সুসং কবিতা’, জামাল তালুকদার সম্পাদিত ‘কংস’, নাজমুল হুদা সারোয়ার সম্পাদিত ‘একুশ শতকের স্রোত’, মোহনগঞ্জ সাধারণ পাঠাগার থেকে প্রকাশিত ‘প্রতীতি’, ‘ময়ুখ’, ‘দৃক’, ‘প্রান্তর’, ‘জ্যোতি’, ‘সাঁকো’, আটপাড়ার মোস্তফা মইন সম্পাদিত ‘ডুমুর’, প্রয়াত বিভূতিরঞ্জন রায় সম্পাদিত ‘তুষাই সাহিত্য ও সংস্কৃতি পত্রিকা’, নেত্রকোনা সদরের সজল অনিরুদ্ধ সম্পাদিত ‘পাকুড়’, মিথুন রায় সম্পাদিত ‘রাণীখং’, আহমেদ তোফায়েল সম্পাদিত ‘ত্রয়ী’ প্রভৃতি এবং শিমুল মিলকীর সম্পাদনায় ‘শিকড়’ সাংস্কৃতিক সংগঠন থেকে প্রকাশিত ‘শিকড় সঞ্জীবনী’ প্রভৃতির নাম উল্লেখযোগ্য। -সঞ্জয় সরকার, নেত্রকোনা থেকে
×