ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

ছোট কাগজ ॥ সাহিত্যের আঁতুড়ঘর

প্রকাশিত: ০৩:৫৩, ৮ অক্টোবর ২০১৬

ছোট কাগজ ॥ সাহিত্যের আঁতুড়ঘর

দেশ বিদেশে বরেণ্য অনেক সাহিত্যিকের লেখায় হাতেখড়ি হয় স্থানীয়ভাবে প্রকাশিত লিটল ম্যাগাজিনে। যাকে সংক্ষেপে বলা হয় লিটল ম্যাগ। বিদেশে খ্যাতি পেয়েছে, এমন অনেক পত্রিকার শুরু ছিল লিটল ম্যাগে। যেমন লন্ডনের দ্য মিরর। আমাদের দেশে লিটল ম্যাগের যাত্রা শুরু অনেক আগে। ব্রিটিশশাসিত ভারতবর্ষে স্বাধীনতা আন্দোলনের সূতিকাগারে যতটা না ছিল পত্রপত্রিকার ভূমিকা, তার চেয়ে ঢের বেশি ভূমিকা পালন করে অঞ্চল ও এলাকাভিত্তিক প্রকাশিত স্বল্প আয়তনের ও ছোট আকারের লিটল ম্যাগাজিন। এইসব ক্ষুদে ম্যাগাজিনের লেখক ছিলেন ওই সময়ের নামকরা লেখক ও বিপ্লবীরা। ব্রিটিশরা যতটা না ভয় করেছে দৈনিক বা সাপ্তাহিক পত্রপত্রিকাকে, তার চেয়ে বেশি ভয় করেছে লিটল ম্যাগকে। অনেক লিটল ম্যাগাজিন শাসকের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে দেশপ্রেমকে হৃদয়ে গেঁথে মুক্তির কথা লিখেছে। এ জন্য অনেকের ওপর খড়গ নেমে আসে। লিটল ম্যাগ যে কতটা শক্তিশালী ইতিহাস তার সাক্ষ্য দেয়। তেমনই লেখালেখির জগতে লিটল ম্যাগ কাছে থেকে পরোক্ষভাবে পাঠশালার ভূমিকা পালন করে। অনেক উপন্যাসিক, ছোট গল্পকার, কবিতা প্রবন্ধ লেখকের আঁতুর ঘর ছিল লিটল ম্যাগ। ছোট কাগজে যাত্রা শুরু, পরবর্তী সময়ে এমন অনেক লেখকের খ্যাতি এনে দেয়। আমাদের দেশে লিটল ম্যাগের যাত্রা শুরু দেশ বিভাগের পরে ১৯৪৭ সালে। তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা লেখক প্রতিভা প্রকাশে দেয়ালিকা ও লিটল ম্যাগ প্রকাশ করে। ১৯৪৮ সালে ভাষা আন্দোলন শুরু হলে লিটল ম্যাগের ভূমিকা বেড়ে যায়। প্রতিবাদের কথা প্রকাশ হতে থাকে এইসব লিটল ম্যাগে। ১৯৫০ থেকে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি হয়ে পরবর্তী সময়ে লিটল ম্যাগ ছিল বাংলা ভাষা দিয়ে প্রতিবাদের অন্যতম অস্ত্র। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় ওই সময়ে অনেক পত্রিকা ভাষা আন্দোলনের বিরোধিতা করে। তারও প্রতিবাদ করে এই লিটল ম্যাগাজিন। ঢাকার লিটল ম্যাগাজিনের হাত ধরে দেশের প্রতিটি শহরে প্রকাশিত হতে থাকে লিটন ম্যাগ। যাকে পরবর্তী সময়ে সংক্ষেপে বাংলায় বলা হয় ছোট কাগজ। এই লিটল ম্যাগ প্রকাশে কেউ কাগজ কিনে, কেউ ছাপাখানার খরচ দিয়ে সহযোগিতা করে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই লিটল ম্যাগ প্রকাশের উদ্যোগ নেয় স্কুলের নবম ও দশম শ্রেণী এবং কলেজের শিক্ষার্থীরা। তারাই লেখা সংগ্রহ করে বুদ্ধিজীবী, বিশিষ্টজন, কবি সাহিত্যিক ও প্রগতিশীল ধারার সৃষ্টিশীল মানুষের কাছ থেকে। অনেকে লেখা প্রকাশে শাসকের রক্তচক্ষুর ভয়ে অপারগতা প্রকাশও করে। তবে কেউ সরাসরি কেউ পেছনে থেকে সহযোগিতা করে। বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দিতে লিটল ম্যাগের ভূমিকা ছিল মনে রাখার মতো। শুধু যে ছাপাখানায় লিটল ম্যাগ ছাপা হতো তা নয়। নানা মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। ষাটের দশকে সাইক্লোস্টাইল মেশিনে হাতে লিখে ম্যাগাজিন প্রকাশিত হতো। সাইক্লোস্টাইল যন্ত্রটি এমন- বর্তমানের লিগ্যাল সাইজের কাগজের মাপে কার্বনের মতো দেখতে গ্রাফ করা এক ধরনের লিনথিনে বিশেষ ধরনের কলমে লেখা হতো। সেই কাগজটি মেশিনে এঁটে দিয়ে নিচের বক্সে সেই মাপের কাগজ রেখে হাত দিয়ে ঘোরালে লেখা কপি হয়ে যেত। প্রতি পাতার জন্য একটি করে কার্বন লিনথিনে লিখতে হতো। যাদের হাতের লেখা ভাল তারাই ওই পেপারে লিখেছে। পরে প্রতিটি পাতা আলাদা করে রেখে সাজিয়ে সেট তৈরি করা হয়েছে। এভাবে ২০ থেকে ৩০ পাতার একেকটি সাইক্লোস্টাইল লিটন ম্যাগ এক/দেড়শ’ কপি প্রকাশ করা হয়েছে। সাইক্লোস্টাইলে উভয় পৃষ্ঠায় লেখা ছোট কাগজ প্রকাশিত হতো। সাইক্লোস্টাইল পদ্ধতিতে ১৯৬৭ সালে বগুড়া সরকারী আযীযুল হক কলেজের একাদশ শ্রেণীর শিক্ষার্থীরা কলেজের নানা সমস্যা নিয়ে দুই পাতার রম্য লিটল ম্যাগ প্রকাশ করে। যার নাম দেয়া হয় ‘বলটু’। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে এতটাই জনপ্রিয়তা পায় যে, আন্দোলন করে যা করা যায়নি লিটল ম্যাগ সরাসরি দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ওই সময়ে অধ্যক্ষ ড. হাফেজ আহমেদ সমস্যার বিষয়গুলো অনুধাবন করে দ্রুত ব্যবস্থা নেন। কয়েকটি সমস্যা ছিল এমন- কলেজের পুরনো ভবনে এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে যেতে অনেকটা জায়গায় কোন শেড ছিল না। শিক্ষার্থীদের ক্লাসের কক্ষ পরিবর্তনের সময় বৃষ্টিতে ভিজে যেতে হতো। রসায়নাগারে টেস্টটিউব বুনসেন বার্নারের অভাবে প্রাকটিক্যাল ক্লাস করা যেত না। জীববিদ্যার প্রাকাটিক্যাল করার সময় শিক্ষার্থীদের ব্যাঙ সংগ্রহ করে আনতে হতো। এই বিষয়গুলো রম্য কথায় প্রকাশ করায় শিক্ষার্থীদের সৃজনশীলতা প্রকাশ পায়। অধ্যক্ষ এমন পত্রিকার প্রশংসা করে দ্রুত সমস্যার সমাধান করে দেন। যারা এই পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত ছিল এক অনুষ্ঠানে তাদের ডেকে সৃজনশীল মেধার বিকাশেয় জন্য পুরস্কৃত করে বলেন, দেশে এই লিটল ম্যাগ যে কত বড় ভূমিকা পালন করেছে, তার প্রমাণ দিল ছোট্ট এক টুকরো বলটু। স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের পর এই দেশে যে দুটি অধ্যায় সবচেয়ে প্রথমে এগিয়ে আসে, তা হলো মঞ্চ নাটক ও লিটল ম্যাগাজিন। যে ধারাবাহিকতা আজও বয়ে চলেছে। সদ্য প্রয়াত সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক গত শতকের শেষে বগুড়ায় এক সাহিত্য সভায় প্রধান অতিথি হয়ে এসেছিলেন। ওই সময় তিনি লিটল ম্যাগাজিনের ভূমিকা তুলে ধরে বলেন, দেশের প্রতিটি প্রান্ত থেকে প্রকাশিত এই লিটল ম্যাগ সাহিত্যের অঙ্গনকে সমৃদ্ধ করছে। তিনি নিজেও অনেক লিটল ম্যাগাজিনে লিখেছেন। কে বড় লেখক কে ছোট, তা বড় কথা নয়। লিটল ম্যাগে লেখা পাঠক যখন গ্রহণ করবে তখনই সৃষ্টি হবে একেকজন লেখক। লেখক বই প্রকাশ করে যতটা না সুনাম কুড়াতে ও খ্যাতি অর্জন করতে পারেন, তার চেয়ে বেশি সুনাম এনে দেয় লিটল ম্যাগাজিনের তার কোন লেখা যদি পাঠকের দৃষ্টিতে পড়ে। যা তাকে এগিয়ে নিয়ে যায় লেখালেখির অনেক পথ। এক সময় এনে দেয় খ্যাতি। এনে দেয় পুরস্কার। দেশের প্রতিটি জেলা ও উপজেলা থেকে শত সহস্র লিটল ম্যাগ প্রকাশিত হচ্ছে। এইসব লিটল ম্যাগের নামগুলো খুবই সুন্দর। যা আকর্ষণ করে। প্রতিটি লিটল ম্যাগের রয়েছে নিজস্ব বলয়। ভিন্ন আঙ্গিক। বেশিরভাগ লিটল ম্যাগ পুস্তকের ফর্মার আকারে জ্যাকেট বাইন্ডিংয়ে হয়। এর বাইরে ট্যাবলয়েড, ব্রড শিটসহ নানা আকারের লিটল ম্যাগ হতে পারে। ঢাকার বাইরে থেকে প্রকাশিত কোন কোন লিটল ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদসহ লেখার মান এত সমৃদ্ধ, যা রাজধানী থেকে প্রকাশিত লিটল ম্যাগকেও হারিয়ে দেয়। এর উল্টো দিক আছে। কয়েকটি বিজ্ঞাপন নিয়ে কোন রকমে অতি দুর্বল লেখায় লিটল ম্যাগও প্রকাশিত হতে দেখা যায়। যার লক্ষ্য থাকে শুধু বাণিজ্য। এ ধরণের লিটল ম্যাগের স্থায়িত্ব থাকে না। ফেলে দেয়া কাগজের সঙ্গে বিক্রি হয়ে যায়। রাজধানী ঢাকাসহ প্রতিটি জেলা ও উপজেলায় লেখক প্রতিভা রয়েছে অনেক। যারা বনফুলের মতো। অনাদরে বেড়ে উঠে একসময় ঝরে যায়। সমৃদ্ধ লেখার লিটল ম্যাগ এই বনফুল লেখকদের ঝরে পড়ার হাত থেকে রক্ষা করতে পারে। যারা লিটল ম্যাগ প্রকাশ করছেন তারাও উন্নত লেখা সংগ্রহ করতে পারেন। ঢাকার বাইরের অনেক লেখক হীনমন্যতায় ভোগেন। তাদের প্রতিভা বিকাশের বড় প্লাটফর্ম লিটল ম্যাগ। বিশ্বের বড় শহরগুলোতে লিটল ম্যাগ প্রকাশ করে অনেক সৃষ্টিশীল লেখক তৈরি হয়েছে। পাশ্ববর্তী দেশ ভারতে এর অনেক উদাহরণ আছে। বাংলাদেশও পিছিয়ে নেই। জেলা শহর থেকে প্রকাশিত অনেক লিটল ম্যাগ সুনাম কুড়িয়েছে। এই লিটল ম্যাগকে লেখার গুণে ও প্রকাশের মানে আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে বর্তমান প্রজন্মের তরুণরা। তৈরি হবে আগামী প্রজন্মের সাহিত্যের বড় ভুবন। -সমুদ্র হক, বগুড়া থেকে
×