ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মুহম্মদ শফিকুর রহমান

চ্যাম্পিয়ন্স অব দ্য আর্থের আলোয়

প্রকাশিত: ০৩:৪৯, ৮ অক্টোবর ২০১৬

চ্যাম্পিয়ন্স অব দ্য  আর্থের আলোয়

আমাদের প্রিয় রাষ্ট্রনেতা জাতির পিতার কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৭০তম জন্মদিন পার করেছেন দিন দশেক আগে। অসংখ্য গুণমুগ্ধ নাগরিক তাঁকে জন্মদিনের শুভেচ্ছাসহ তাঁর সুস্থ দীর্ঘ জীবন কামনা করেছে। এ কামনা তাঁর জন্য যতখানি তারচেয়ে বেশি আমাদের ষোল কোটি মানুষের জন্য। যাঁদের তিনি সম্মান দিয়েছেন, স্বপ্ন দেখতে ও দেখাতে শিখিয়েছেন, বাস্তবায়ন করতে পথ দেখিয়েছেন, সর্বোপরি অভাব-অনটনে জর্জরিত বাংলাদেশকে এক সমৃদ্ধ মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত করে বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন। তাই তো দেখি উন্নত দেশগুলোর অর্থনৈতিক জোট গ্রুপ-৮ তাঁকে তাদের শীর্ষ সম্মেলনে আমন্ত্রণ জানায় এবং বাংলাদেশের বর্তমান সমৃদ্ধির জন্য শেখ হাসিনার নেতৃত্বের ক্যারিশমা কি জানতে চায়। নেত্রীর জন্মদিনের ওপর গত শনিবারে লেখার কথা ছিল আমার নিয়মিত লেখার দিনে। কিন্তু জনকণ্ঠের নির্বাহী সম্পাদক বন্ধু স্বদেশ রায় অনুরোধ করলেন ভারত ও পাকিস্তানের সাম্প্রতিক সীমান্ত সংঘর্ষের ওপর লিখতে। অনুরোধের যৌক্তিকতাও ছিল। আমরা জানি ব্যর্থ রাষ্ট্র পাকিস্তান বিশ্বব্যাপী বন্ধু হারিয়ে সম্প্রতি ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের অভ্যন্তরে উরিতে ঢুকে ১৮ জন সেনাকে হত্যা করে। পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে ভারতীয় মিলিটারি পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের ৫ কি. মি. অভ্যন্তরে ঢুকে ৮টি জঙ্গী ঘাঁটি ধ্বংস করে দেয় এবং ৮ পাকসেনা ও ৮০ জঙ্গীকে হত্যা করে ফিরে আসে। উত্তেজনা চলছিল। তাই নেত্রীর জন্মদিনের ওপর এ সপ্তাহে লেখার পরিবর্তে ভারত-পাকিস্তানের উত্তেজনার ওপর কলম ধরি। মনে পড়ে ১৯৯৭ সালে পাকিস্তান প্রথমে আণবিক বোমার বিস্ফোরণ ঘটায়। সঙ্গে সঙ্গে ভারতও আরও বেশি সংখ্যক বিস্ফোরণ ঘটায়। শেখ হাসিনা বাংলাদেশের রাষ্ট্রনেতা (প্রধানমন্ত্রী) ও সার্কের অন্যতম সদস্য রাষ্ট্রের সরকারপ্রধান হিসেবে প্রথমে ভারতের রাজধানী দিল্লী ও পরে পাকিস্তানের ইসলামাবাদ সফর করেন। দুই দেশের সরকারকে মানবতা বিধ্বংসী আণবিক বোমা বিস্ফোরণের পাগলামি বন্ধ করার পরামর্শ দেন। দিল্লীতে তাঁর সফরসঙ্গী হিসেবে আমার সৌভাগ্য হয়েছিল ইত্তেফাকের পক্ষে ওই গুরুত্বপূর্ণ ইভেনটি কভার করার। আলোচনা টেবিলের এক পাশে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, অপর পাশে ভারতের প্রধানমন্ত্রী বাজপেয়ী। শেখ হাসিনা যে বিষয়টির ওপর গুরুত্ব দেন তা হলো একটি আণবিক বোমা বানাতে যত খরচ হয় তা দিয়ে ভারতের কত পার্সেন্ট মানুষের জীবনমান উন্নত করা যায়, তার হিসাব কি ভারত সরকারের কাছে আছে? কোন লিখিত বক্তব্য নয়, টফিং পয়েন্টও নয়, ইংরেজীতে পুরো এক্সটেম্পোর বক্তব্যে শেখ হাসিনা এও বলেছিলেন, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যান্য দেশের মতো ভারতও একটি উন্নয়নশীল দেশ। জনসংখ্যার দিক দিয়ে ভারতে হতদরিদ্রের হার অনেক বেশি। ভারতকে আণবিক অস্ত্র বানানোর বিলাসিতা সাজে না। তাই আরও অন্তত এক দশক শেখ হাসিনার ক্ষমতায় থাকা দরকার এজন্য যে, তিনি বাংলাদেশকে উন্নয়নের মহাসড়কে প্রবেশ করিয়েছেন কা-ারি হিসেবে। মহাসড়কের শেষ প্রান্তে নিয়ে যেতে তাঁকেই স্টিয়ারিং-এ থাকতে হবে। আমরা তাঁর নেতৃত্বেই ২০২০ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন করব এবং পরের বছর ২০২১ সালে আমাদের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী তথা ৫০ বছর পূর্তি উদযাপন করে মধ্যম আয়ের দেশ থেকে উন্নত দেশের মহাসড়কে প্রবেশ করব। ইতোপূর্বে আমি এক লেখায় বলেছিলাম, আজ হতে শত বর্ষ পরে যে তরুণ গবেষক বাংলাদেশের ছবি আঁকতে বসবে সে জাতির পিতার পাশে কেবল একটি নাম, একটি ছবিই দেখবে, সে ছবি শেখ হাসিনার। শেখ হাসিনা আজ উন্নত-অনুন্নত বিশ্বের কাছে ‘চ্যাম্পিয়ন্স অব দ্য আর্থ’। এর বাংলা করেছি ‘ধরিত্রীর আদরের কন্যা’। ধরিত্রীর কন্যা তো অনেকেই আছেন। কিন্তু ‘আদরের কন্যা’ একজনই। তিনি শেখ হাসিনা, যিনি এই ধরিত্রীকে ভাল করে চেনেন। আমাদের সব্যসাচী কবি লেখক সৈয়দ শামসুল হক নেত্রীর জন্মদিনে ইন্তেকাল করায় তিনি তাঁর জন্মদিনের কোন উৎসব করেননি কবির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে। সৈয়দ শামসুল হক লিখেছেন “আমি জন্মেছি বাংলায়, আমি বাংলায় কথা বলি। আমি এই বাংলার আলপথ দিয়ে হাজার বছর চলি...।” কবির এ লাইন দুটি শেখ হাসিনা সম্পর্কে বেশি প্রযোজ্য। আমাদের সুশীল সমাজের প-িতরা (?) টিভির টকশোতে বসে ঝড় তোলেন। তাদের যদি জিজ্ঞেস করা হয়, আপনি নিজের গ্রামটি চেনেন তো? অনেকেই জবাব দিতে পারবেন না। কিন্তু শেখ হাসিনা বাংলার প্রতিটি গ্রামের আলপথ দিয়ে হেঁটেছেন, কোন্্ জমিতে কি ফসল ফলাতে হয়, কি কি উপকরণ লাগে, কোন্্ জলাশয়ে কি মাছ পাওয়া যায়, বিশেষ করে নিজ জন্মভূমি টুঙ্গিপাড়ায় কোথায় কি আছে সব একবাক্যে বলে দিতে পারবেন। আবার আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে হাঁটতে ডিজিটাল বিজ্ঞানমনস্ক বাংলাদেশ গড়তে পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়কে আইটি বিশেষজ্ঞ বানিয়েছেন, জনপ্রশাসনে পিএইচডি গবেষণায় আমেরিকার হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠিয়েছেন। তিনি জয়ের কাছে কম্পিউটার শিখেছেন এবং গোটা জাতির হাতে কম্পিউটার তুলে দিয়েছেন। যে কারণে বিশ্বের এক ডজনের অধিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট ডিগ্রীসহ ইউএন সিস্টেমের প্রতিটি শাখার পুরস্কার লাভ করে বাংলাদেশের সম্মান আরও অনেক উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। ডক্টরেট ডিগ্রীতে সম্মানিত করেছে আমেরিকার বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয়, জাপানের ওয়াসেদা, ব্রিটেনের ডান্ডি এবার্ট, বিশ্বভারতী, অস্ট্রেলিয়ার ন্যাশনাল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বঙ্গবন্ধু কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ত্রিপুরা সেন্ট্রাল ও প্যারিসের ডাউফিন ইউনিভার্সিটি। এছাড়া ভারতের গান্ধী পদক, মাদার তেরেসা পদক, ইন্দিরা গান্ধী শান্তি পদক, ইউএন সিস্টেমের সেরেন, সাউথ-সাউথ, ট্রি অব দ্য পিন, চ্যাম্পিয়ন্স অব দ্য আর্থ এবং সম্প্রতি ‘প্লানেট ৫০+৫০ চ্যাম্পিয়ন’ ও ‘এজেন্ট অব দ্য চেঞ্জ’ পুরস্কার লাভ করেন। শেখ হাসিনা তাঁর সমস্ত পুরস্কার জনগণকে উৎসর্গ করেন। আজ তিনি বিশ্বের ১০ প্রভাবশালী রাষ্ট্রনেতার কাতারে উঠে এসেছেন। শেখ হাসিনার সাহসিকতায় জাতির পিতার হত্যার বিচার, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করেছেন, বিশ্বব্যাংকসহ সাম্র্রাজ্যবাদের মোড়লদের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে নিজ অর্থে পদ্মা সেতু বানাচ্ছেন (এরই মধ্যে ৪৪% কাজ সম্পন্ন), তা বিশ্ববাসীকে অবাক করেছে। বর্তমান বিশ্বের দুষ্টক্ষত জঙ্গীবাদ ও ধর্মের পাশে সন্ত্রাসবাদের মোকাবেলা করে চলেছেন জিরো টলারেন্স নীতি ঘোষণা করে, যা বহির্বিশ্বে অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত রচনা করেছেন। তবে বাংলাদেশের মানুষের আজ যে অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ্যÑ কোথাও কোন অভাব নেই, দুর্ভিক্ষ-মঙ্গা শব্দ ডিকশনারিতে উঠে গেছে, জীবনের কোথাও নেই, মানুষের গড় আয় ১৪৬৬ মার্কিন ডলার, ফরেন কারেন্সি রিজার্ভ ৩০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, জিডিপি ৭.০২%, আয়ুষ্কাল ৭০ বছর, শিক্ষার হার ৭০%, অর্থাৎ বঙ্গবন্ধুর রেখে যাওয়া বাংলাদেশকে জিয়া-এরশাদ-খালেদা যেভাবে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গিয়েছিলেন, সেখান থেকে শেখ হাসিনা তুলে এনেছেন। উত্তরে হিমালয়ের পানিবাহিত ফসলের মাঠ এবং দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের ব্লু-ইকোনমি, সর্বক্ষেত্রে সাফল্য এনে বাংলার প্রতিটি ঘরে ঘরে হাসি ফুটিয়েছেন। কিন্তু সুশীল সমাজের একটি অংশ এবং ভেঙ্গে পড়া মস্কোপন্থী তথাকথিত বামদের এসব ভাল্লাগে না। কোথায় সরকারের বিরোধিতা করতে হবে তাদের সে জ্ঞান আছে কিনা সন্দেহ। অধ্যাপক আনু মুহম্মদরা তো ‘না’ ছাড়া ‘হ্যাঁ’ বলতে শেখেননি। শ্রদ্ধেয় সাংবাদিক ভাষা সৈনিক আবদুল গাফ্্ফার চৌধুরী শেখ হাসিনার রাষ্ট্র পরিচালনার ওপর এক পর্যালোচনায় বলেছেন, ভারতে যেমন জওহরলাল নেহরু দেশ স্বাধীন করেন এবং শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী নেহরুকন্যা হিসেবে রাজনীতিতে নেমে নিজ যোগ্যতায় ভারতবাসীকে ‘আধুনিক ভারত’ উপহার দিয়েছেন, তেমনি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের জাতি রাষ্ট্রের পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পথ ধরে রাজনীতিতে এলেও নিজ সাহস, যোগ্যতা, দক্ষতা ও দূরদর্শী নেতৃত্ব দিয়ে এক আধুনিক সমৃদ্ধ বাংলাদেশ উপহার দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধু যেমন জীবনে ছোটখাটো চিন্তা করেননি, আর সব রাজনীতিকের মতো কেবল দলীয় নেতা বা মন্ত্রী-এমপি হবার স্বপ্ন নিয়ে রাজনীতিতে আসেননি, এসেছেন একটি জাতি গঠন ও তাদের জন্য একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন নিয়ে এবং তিনি তা বাস্তবায়ন করেছেন ও বিশ্বকে কাঁপিয়েছে। কন্যা হিসেবে শেখ হাসিনাও ছোটখাটো চিন্তা করেন না। তার একটি উদাহরণÑ সাংবাদিক সমাজ যখন বড়জোর জাতীয় প্রেসক্লাবের খালি জায়গায় ৫/৬ তলা এটি ভবন নির্মাণের স্বপ্ন দেখেছেন, তখন তিনি ৩১ তলার প্রেসক্লাব কমপ্লেক্স নির্মাণের ঘোষণা দিলেন। বস্তুত জিয়া-এরশাদ-খালেদার মিলিটারি, হাফ মিলিটারি শাসন বড় স্বপ্ন দেখাও জাতিকে ভুলিয়ে দিয়েছিলেন। শেখ হাসিনা তা জাগিয়ে তুলেছেন। তাই সৈয়দ শামসুল হক যখন বলেন, “যখন আমার স্বপ্ন লুট হয়ে যায় নুরলদীনের কথা মনে পড়ে যায়।” আজও যখন কারও স্বপ্ন লুট হয়ে যায়, তখন শেখ হাসিনার কথা মনে পড়ে যায়। ঢাকা-৭ অক্টোবর, ২০১৬ লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও সভাপতি, জাতীয় প্রেসক্লাব নধষরংংযধভরয়@মসধরষ.পড়স
×