ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বায়ান্ন বাজর তিপ্পান্ন গলি

প্রকাশিত: ০৬:০৯, ৭ অক্টোবর ২০১৬

বায়ান্ন বাজর তিপ্পান্ন গলি

মোরসালিন মিজান ॥ ঢাকের শব্দ কানে আসতে শুরু করেছে। দিগন্ত বিস্তৃত মাঠ, সেখানে কাশের গুচ্ছ। মৃদু মন্দ হাওয়ায় দুল খাচ্ছে। দেখে বোঝা যায়, শারদীয় দুর্গোৎসব আসন্ন। অবশ্য আসন্ন আর বলা যাবে না। শুক্রবার ষষ্ঠীর দিন থেকে শুরু হয়ে যাচ্ছে পূজার আনুষ্ঠানিকতা। এরই মাঝে রাজধানী শহর ঢাকা মেতেছে উৎসবে। বিভিন্ন অলি-গলিতে ম-প নির্মাণ করা হয়েছে। প্রতিমা গড়ার কাজও ইতোমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। এখন চলছে শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি। জানা যায়, এবার সারাদেশে ২৯ হাজার ৩৯৫ পূজাম-পে শারদীয় দুর্গোৎসবে আয়োজন করা হয়েছে। যা গতবারের তুলনায় ৩০০টির বেশি। বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের প্রাথমিক হিসাবে এ তথ্য জানা গেছে। এদিকে ঢাকা মহানগরে ২৩০ ম-পে দুর্গোৎসবের প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। গত বছর ২২৬ ম-পে আয়োজন ছিল। অর্থাৎ এ বছর রাজধানীতে পূজার সংখ্যা বেড়েছে চারটি। দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি এক হাজার ৬০০টি পূজার আয়োজন হয়েছে চট্টগ্রাম জেলায়। রাজধানীর পূজাম-পের আলোচনায় এখন দারুণ এগিয়ে বনানী। অভিজাত এলাকার মাঠে যে ম-প নির্মাণ করা হয়, তা দেখার জন্য অপেক্ষা করে থাকেন রাজধানীবাসী। দূর-দূরান্ত থেকে ছুটে যান। এর প্রধান কারণ ম-পের নির্মাণশৈলী। প্রতি বছরই নান্দনিক সৌন্দর্যকে প্রাধান্য দিয়ে ম-প নির্মাণ করা হয় এখানে। সেই ধারাবাহিকতায় এবার ঐতিহ্য ও আধুনিকতার সমন্বয় ঘটানোর চেষ্টা করেছেন আয়োজকরা। এ জন্য মডেল হিসেবে বেছে নেয়া হয়েছে কান্তজীর মন্দিরকে। দিনাজপুরে অবস্থিত মন্দিরটি একইসঙ্গে বাংলাদেশের প্রাচীন স্থাপত্যকলার অনন্য নিদর্শন। তৎকালীন দিনাজপুরের মহারাজা জমিদার প্রাণনাথ রায় তার শেষ বয়সে মন্দিরের নির্মাণ কাজ শুরু করেন। ১৭২২ খ্রিস্টাব্দে তার মৃত্যুর পরে শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী পোষ্যপুত্র মহারাজা রামনাথ রায় ১৭৫২ খ্রিস্টাব্দে মন্দিরটির নির্মাণ কাজ শেষ করেন। শুরুতে মন্দিরের চূড়ার উচ্চতা ছিল ৭০ ফুট। ১৮ শতকে নির্মিত মন্দিরের আদলেই নির্মাণ করা হয়েছে বনানীর পূজাম-প। তথ্যটি আগেই জানা ছিল। এরপরও কিছুটা সংশয় কাজ করছিল মনে। কান্তজীর মন্দিরের অনুকৃতি! কতটা সম্ভব হবে? আর তারপর বৃহস্পতিবার ম-প ঘুরে দেখা। ঘুরে দেখতে গিয়ে চোখ তো কপালে! বিস্ময় কাটছিল না। বনানীর কামাল আতাতুর্ক এ্যাভিনিউয়ের মাঠে নির্মাণ করা হয়েছে ম-প। মূল কাঠামোটি কান্তজীর মন্দিরের মতোই বর্গাকার। ঐতিহ্যবাহী মন্দিরের বাইরের অংশ টেরাকোটায় করা। অজস্র পোড়ামাটির ফলক বসানো। প্রতিটি ফলকে স্বতন্ত্র নক্সা। কত কত রকমের কাজ! বনানীর ম-পের দেয়াল নির্মাণের বেলায় অভিন্ন প্রয়াস লক্ষ্য করা যায়। কান্তজীর মন্দির থেকে ফর্ম খুঁজে নিয়ে কাজ করেছেন শিল্পীরা। ঐতিহ্যের সঙ্গে আধুনিক স্থাপত্যকলার মিলমিশ। তাতেই কান্তজীর মন্দিরের রেপ্লিকা। মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। হুবহু তো অসম্ভব। তবে কান্তজীর মন্দিরের আদল রক্ষার সব চেষ্টা করা হয়েছে। মূল কাঠামোটি বাঁশ ও কাঠের। তার উপর প্লাইউড। আর ফলকগুলো করা হয়েছে শোলা কেটে। ফলকের গায়ে যে নক্সা, সেখানে দেব-দেবীর প্রতিকৃতি লতা-পাতা ফুল ইত্যাদি। পূজার অনুকূল আবহ তৈরি ভাবগাম্ভীর্য রক্ষায় কাজ করছে ম-পের দেয়াল। বিকেলে ম-প এলাকা পরিদর্শন করেন শারদীয় দুর্গোৎসব উদ্যাপন কমিটির সাধারণ সম্পাদক সুধাংশু কুমার দাস। এক ফাঁকে কথা হচ্ছিল তার সঙ্গে। জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, আমরা প্রতি বছরই ম-পের নান্দনিক সৌন্দর্য নিয়ে বিশেষভাবে কাজ করি। আরাধনার অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টির পাশাপাশি, ম-পকে আকর্ষণীয় করে তোলার চেষ্টা হয়। এবারও ব্যতিক্রম হয়নি। এ বছর বাংলাদেশের প্রাচীন ঐতিহ্য কান্তজীর মন্দিরকে মডেল হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে। নির্মাণের ক্ষেত্রে ঐতিহ্য ও আধুনিকতার সমন্বয় ঘটিয়েছেন শিল্পীরা। গত দেড় মাস ধরে ম-প নির্মাণের কাজ হয়েছে। ৭ হাজার স্কয়ার ফিট জায়গা নিয়ে নির্মিত ম-প রাজধানীবাসীকে মুগ্ধ করবে বলেই আশা তার। ম-প মাথা তুলে দাঁড়াতেই কৌতূহলী চোখে তাকাতে শুরু করেছেন পথচারীরা। সবটুকু এখনও দেখা যায় না। কেউ কেউ বিশেষ অনুমতি নিয়ে ঠিকই ঢুকে পরছেন। চলছে মুগ্ধ হয়ে অবলোকন। সন্ধ্যার আগে আগে স্বামী সন্তানসহ ম-প দেখতে এসেছিলেন ফারজানা। সবাই দারুণ কৌতূহল নিয়ে ম-প দেখছিলেন। ছবি তুলছিলেন। এক ফাঁকে কথা হয় তাদের সঙ্গে। তখনই জানা যায়, তারা ডেনমার্কে থাকেন। ছুটিতে বেড়াতে এসেছেন। ফারজানার স্বামী আবার ভারতের নাগরিক। সঙ্গত কারণেই তাকে করা হয় প্রথম প্রশ্নটি। কেমন লাগল দেখে? জবাবে পাল্টা প্রশ্ন করে বললেন, ঢাকায় এমন চমকপ্রদ ম-প হয়? আমার সত্যি ধারণা ছিল না। ম-পের নির্মাণশৈলি দেখে আমি মুগ্ধ। কান্তজীর মন্দির সম্পর্কেও তাকে দারুণ কৌতূহলী মনে হলো। বললেন, একবার দেখার খুব ইচ্ছে হয়েছে।
×