ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

কিভাবে জীবিত শিশু মৃত হয়ে যায়-বিশেষজ্ঞরা যা বলেন

প্রকাশিত: ০৬:০৫, ৭ অক্টোবর ২০১৬

কিভাবে জীবিত শিশু মৃত হয়ে যায়-বিশেষজ্ঞরা যা বলেন

নিখিল মানখিন ॥ মৃত ঘোষিত রোগীর জীবিত হওয়ার ঘটনার জন্য মৃত ঘোষণাকারী ডাক্তারের অনভিজ্ঞতা, ঔদাসীন্য ও দায়িত্বহীনতাই অনেকাংশে দায়ী বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা। তবে বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ কাউকে মৃত ঘোষণার ক্ষেত্রে প্রথাগত পদ্ধতির কিছু পরিবর্তন ও সমন্বয় করার তাগিদ দিয়েছেন। তারা বলছেন, একজন রোগীকে মৃত ঘোষণা করা একটি স্পর্শকাতর, সংবেদনশীল ও জবাবদিহিতামূলক দায়িত্ব। এটি একজন মানুষের জীবন-মরণের বিষয়। তবে এটি খুব বেশি জটিল কাজ নয়। মৃত ঘোষণা করতে একজন চিকিৎসককে অভিজ্ঞ হওয়ার পাশাপাশি গভীর মনোযোগী হতে হয়। মৃত ঘোষণা দেয়ার জন্য নির্দিষ্ট কোন নীতিমালার দরকার নেই। তবে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের সমন্বয়ে গঠিত মেডিক্যাল টিমের দ্বারাই যে কোন রোগীর মৃত্যু নিশ্চিত করা দরকার বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের কেউ কেউ। সম্প্রতি ঘটে যাওয়া মৃত শিশুর জীবিত হওয়ার কয়েকটি ঘটনা সাধারণ মানুষের মনে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। চট্টগ্রাম নগরের সিএসসিআর হাসপাতালে গত সোমবার রাত ১টার দিকে দন্ত চিকিৎসক রিদোয়ানা কাউসার একটি শিশুর জন্ম দেন। এরপর শিশুটিকে সিএসসিআরের এনআইসিইউতে দেয়া হয়। রাত তিনটার দিকে শিশুটিকে মৃত ঘোষণা করা হয়। এরপর শিশুটিকে কেবিনে মায়ের কাছে নিয়ে আসা হয়। তার মৃত্যুসনদও দেয়া হয়। পরে মা রিদোয়ানা মোড়ানো কাপড় খুলে বাচ্চাটির নড়াচড়া দেখতে পান। পরে তাকে চাইল্ড কেয়ার হাসপাতাল নামের একটি বেসরকারী হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে ম্যাক্স হাসপাতালের এনআইসিইউতে ভর্তি করা হয়। বুধবার বেলা দেড়টার দিকে এনআইসিইউতে (নবজাতকদের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র) নবজাতকটির মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় সিএসসিআর হাসপাতালের দুই চিকিৎসককে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। গত মাসের ২২ তারিখে ফরিদপুরে এমন আরেকটি ঘটনা ঘটে। ফরিদপুর শহরের ডাঃ জাহেদ মেমোরিয়াল শিশু হাসপাতালে ডাক্তার কর্তৃক মৃত ঘোষিত নবজাতককে কবর দিতে গিয়ে তাকে জীবিত পাওয়া যায়। এ ঘটনাটি ঘটে ফরিদপুর শিশু হাসপাতালে। তবে নবজাতকের জীবিত থাকার বিষয়টি ‘মিরাকল’ বলেছেন ডাক্তার। ফরিদপুর শহরের কমলাপুর এলাকার বাসিন্দা নাজমুল হুদা মিঠু ২১ সেপ্টেম্বর রাত সাড়ে এগারটার দিকে তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী নাজনীন আক্তারকে ওই হাসপাতালের গাইনি বিভাগে ভর্তি করান। এক ঘণ্টা পর নাজনীন একটি কন্যাসন্তান প্রসব করেন। কিন্তু কর্তব্যরত চিকিৎসক রিজিয়া আলম নবজাতককে মৃত ঘোষণা করেন। ওই রাতেই নবজাতককে কবর দেয়ার জন্য একটি কার্টনে করে শহরের আলীপুর কবরস্থানে নেয়া হয়। পরবর্তীতে তাকে ভোরে কবর দেয়ার কথা বলে কার্টনে ভর্তি নবজাতককে রেখে দেয়া হয়। পরদিন ভোর সাড়ে ছ’টার দিকে কবর দিতে গেলে কার্টনে রাখা নবজাতকটি কেঁদে ওঠে। পরে তাকে দ্রুত শিশু হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করানো হয়। বেশ কিছুদিন আগে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে এক মৃত ঘোষিত ও ডেথ সার্টিফিকেট ইস্যুকৃত নারীর প্রায় ৪ ঘণ্টা পর পুনরায় জীবিত হওয়ার ঘটনা বেশ চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে। ইতোপূর্বেও একাধিক সদ্যপ্রসূত বাচ্চাকে মৃত ঘোষণা করে ডেথ টাবে ফেলে দেয়ার পর পুনরায় জীবিত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে এদেশে। এ ধরনের ঘটনা যে শুধু বাংলাদেশেই ঘটছে তা নয়; বিশ্বব্যাপী এ ধরনের ঘটনা বার বার চমক সৃষ্টি করেছে। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের বক্তব্য ॥ কাউকে মৃত ঘোষণার ক্ষেত্রে বিশ্বের কোথাও নির্দিষ্ট নীতিমালা নেই বলে জানালেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা। তারা বলছেন, মৃত ঘোষণার সাধারণ কৌশলসমূহ জটিল করে তুলেছে ভিন্ন সময়কালে ও অবস্থাভেদে কিছু মৃত ঘোষিত রোগীর পুনরায় জীবিত হওয়ার কারণে। অন্যতম মূল সমস্যাটা রয়ে গেছে ‘অপরিবর্তনীয়’ শব্দটিতে। কতক্ষণ হৃদপি-, শ্বাসপ্রশ্বাস ও ব্রেনের কার্যকারিতা বন্ধ থাকলে সে অবস্থা থেকে আর কখনোই ফেরা সম্ভব নয় তা নির্ণয় করা একসময় বেশ সহজ মনে হলেও মৃত ঘোষিত মানুষ বার বার জীবিত হওয়ার বাস্তবতায় এখন তা কঠিন প্রশ্নের সম্মুখীন। এ কারণে বর্তমানে নিশ্চিত মৃত্যু ঘোষণার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি জোর দেয়া হচ্ছে শ্বাসপ্রশ্বাস, হৃদপি- ও চেতনা নিয়ন্ত্রণকারী ব্রেন স্টেমের মৃত্যুর ওপর। তাই বর্তমানে মৃত ঘোষণার ক্ষেত্রে সময় নিয়ে বেশ কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা অত্যাবশ্যক হয়ে দাঁড়াচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা আরও বলছেন, পৃথিবীতে কাউকে মৃত ঘোষণা করার কোন সর্বজনস্বীকৃত আইনী কিংবা চিকিৎসাশাস্ত্রীয় কোন নির্ণায়ক উপায় নেই। বিশ্বের চিকিৎসা বিজ্ঞানীয় জ্ঞানের মূল ধারক ও বাহক দুই দেশ অর্থাৎ যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রও একে অপরের মৃত নির্ণয়ের পদ্ধতিতে একমত নয়। দীর্ঘদিন থেকে প্রচলিত ব্রিটিশ মৃত নির্ণয়ের বৈশিষ্ট্যসমূহকে ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট কাউন্সিল অন বায়োএথিকস ‘কাউকে মৃত ঘোষণার ক্ষেত্রে যথেষ্ট নয়’ বলে ঘোষণা দিয়েছেন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের ক্ষেত্রে সেটা প্রয়োগযোগ্য নয় বলে মনে করছেন। মৃত্যু যেহেতু কেবল একটি মুহূর্ত নয় বরং একটি প্রসেস এবং এই প্রসেসের সময়কাল সবার ক্ষেত্রে সমান নয়। তাই এই প্রসেসের কোন ক্ষণে একজনকে মৃত বলা হবে তা নিয়ে মতপার্থক্য থাকতেই পারে। তবে মৃত ঘোষণার ক্ষেত্রে নিম্নোক্ত কয়েকটি বৈশিষ্ট্যের বিষয়ে কারো কোন দ্বিমত নেই। সেগুলো হলো-মানুষের বেঁচে থাকার জন্য অক্সিজেন খুবই গুরুত্বপূর্ণ বায়বীয় উপাদান। শ্বাসের মাধ্যমে মানুষ অক্সিজেন গ্রহণ করে এবং রক্তের মাধ্যমে তা সারাদেহে ছড়িয়ে পড়ে। তাই শ্বাসপ্রশ্বাস ও হৃদপি- থেমে গেলে এবং কোন অবস্থাতেই তা আবার চালুর কোন সম্ভাবনা না থাকার অবস্থা নিশ্চিত হলে কাউকে মৃত ঘোষণা করা যেতে পারে (কার্ডিওপালমোনারি ডেড)। মানুষের জীবিত থাকার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো চেতনা। যদি কেউ অচেতন হয়ে পড়ে এবং তার চেতনা ফিরে আসার কোন সম্ভাবনা না থাকে তাহলেও তাকে মৃত ঘোষণা করা যেতে পারে (ব্রেইন ডেড)। হৃদপি- থেমে যাওয়া, শ্বাসপ্রশ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়া ও অচেতন অবস্থা নির্ণয় করতে সাধারণত বুকে স্টেথিস্কোপ লাগিয়ে হার্টবিট শোনা হয়, শ্বাসপ্রশ্বাস চলছে কিনা তা অবলোকন করা হয় এবং চোখে টর্চের লাইট ফেলে দেখা হয় চোখের মণি সাড়া দিচ্ছে কি না অর্থাৎ ব্রেন কার্যকর আছে কিনা। উপরোক্ত ৩ পরীক্ষণ ঋণাত্মক হলেই সঙ্গে সঙ্গে কিছুক্ষণ কৃত্রিম উপায়ে হার্ট-লাংগস চালুর চেষ্টা করা হয়। এরপর আবার উপরোক্ত পরীক্ষণসমূহের পুনরাবৃত্তি করতে হয়। এভাবে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক নিজে সন্তুষ্ট না হওয়া পর্যন্ত চেষ্টা চালানোর পর ব্যর্থ হলে কাউকে মৃত ঘোষণা দেয়া হয়ে থাকে। কাউকে মৃত ঘোষণার ক্ষেত্রে ত্রুটি করার কাজকে মানবাধিকার পরিপন্থী ও অপরাধ বলে মনে করেছেন বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের নবজাতক বিভাগের অধ্যাপক ও বাংলাদেশ মেডিক্যাল এ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের (বিএমডিসি) সভাপতি ডাঃ মোহাম্মদ সহিদুল্লা। তিনি জনকণ্ঠকে জানান, এটি অপরাধমূলক কাজ। মৃত ঘোষণাকারী চিকিৎসকের উদাসীনতা ও অনভিজ্ঞতার কারণে এমন ঘটনা ঘটে। একজন চিকিৎসকের পক্ষে কাউকে মৃত ঘোষণা করা খুব বেশি কঠিক কাজ নয়। এটার জন্য কোন নীতিমালার দরকার নেই। সচেতন থাকলে যে কোন ব্যক্তিই মৃত ব্যক্তির উপসর্গ বুঝতে পারে। অর্থাৎ চোখের মণি, শ্বাসপ্রশ্বাস ও হৃদপি- গভীর মনোযোগ দিয়ে পরীক্ষা করতে হয়। প্রয়োজনে শরীরে চিমটি কেটে শরীরের অনুভূতি দেখা যেতে পারে। তবে একটু সময় দিয়ে এসব করতে হবে। মৃত ঘোষণা দেয়ার কাজটি খামখেয়ালি মনে করা উচিত নয় বলে জানান অধ্যাপক ডাঃ মোহাম্মদ সহিদুল্লা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের ডীন অধ্যাপক ডাঃ এবিএম আব্দুল্লাহ জনকণ্ঠকে জানান, একজন রোগীকে মৃত ঘোষণা করা একটি স্পর্শকাতর, সংবেদনশীল ও জবাবদিহিতামূলক দায়িত্ব। মৃত ঘোষণাকারী চিকিৎসকের অনভিজ্ঞতা, উদাসীনতা ও দায়িত্বহীনতার কারণে এমন অনাকাক্সিক্ষত ঘটে থাকে। ডাঃ সিরাজুল ইসলাম মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডাঃ এম এ আজিজ বলেন, নবজাতক শিশু অনেক সময় দেরিতে শ্বাসপ্রশ্বাস নেয়া শুরু করতে পারে। এ ক্ষেত্রে ডেলিভারি টিমে শিশু বিশেষজ্ঞ ও নবজাতক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক রাখা দরকার। আর কয়েক বছরের শিশু ও বয়স্কদের মৃত ঘোষণার ক্ষেত্রে কয়েকটি উপসর্গ ভালভাবে খেয়াল করলেই তা ধরা পড়বে। এদিকে অনেক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বলছেন, এ ধরনের প্রতিটি ঘটনার ক্ষেত্রেই চিকিৎসকের অবহেলাকে প্রাথমিকভাবে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে। বাস্তবতা হচ্ছে কাউকে মৃত ঘোষণার ক্ষেত্রে প্রথাগত পদ্ধতির উৎকর্ষতার অভাব। ক্লিনিক্যাল ডেড মানুষকে বাঁচাতে আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানে যে ধরনের উন্নতি সাধিত হয়েছে, সেই তুলনায় আজও নিশ্চিত মৃত ঘোষণার আন্তর্জাতিক কোন সর্বজনস্বীকৃত নিয়ম কানুন তৈরি হয়নি। সাধারণ অসুস্থতা দেখার ক্ষেত্রেও রোগ নির্ণয়ের জন্য নানা ধরনের প্যাথলজিক্যাল, ইম্যাজিং টেস্ট বা ইলেকট্রিক ট্রেসিং প্রয়োজন হয়। অথচ কাউকে মৃত ঘোষণার মতো এতবড় সিদ্ধান্ত নেয়া হয় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কোনরূপ ল্যাব টেস্ট ছাড়া এবং অতি অল্প সময়ে। চিকিৎসা বিজ্ঞানের উৎকর্ষতার এ যুগে এটা মেনে নেয়া যায় না। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের সমন্বয়ে গঠিত মেডিক্যাল টিমের দ্বারাই যে কোন রোগীর মৃত্যু নিশ্চিত করা দরকার।
×