ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

শহীদ মহিউদ্দিন হায়দারের স্ত্রীর দুঃসহ জীবন

স্বামীর রক্তে কেনা দেশে আজও মাথা গোঁজার ঠাঁই হলো না

প্রকাশিত: ০৬:০৪, ৭ অক্টোবর ২০১৬

স্বামীর রক্তে কেনা দেশে আজও মাথা গোঁজার ঠাঁই হলো না

গাফফার খান চৌধুরী ॥ অর্থ আর বাসস্থানের অভাবে শহীদ মুক্তিযোদ্ধা মহিউদ্দিন হায়দারের পরিবারের পথে বসার যোগাড় হয়েছে। অথচ অসীম সাহসিকতা আর সত্যবাদীতার কারণে ১৯৭১ সালের ১৫ আগস্ট জীবন দিতে হয়েছে তাঁকে। নির্মম নির্যাতনের মুখেও তিনি পাকিস্তানী আর্মির কাছে নতি স্বীকার করেননি। আর সে কারণেই খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে নৃশংসভাবে পাকিস্তানী আর্মিরা তাঁকে হত্যা করে। হত্যার পর রাতের আঁধারে চরম অবহেলায় পাকিস্তানী নরপিশাচরা আখ ক্ষেতের নির্জন জায়গায় গর্ত খুঁড়ে এই শহীদের মরদেহটি এক প্রকার টেনে হিঁচড়ে নিয়ে মাটি চাপা দিয়েছিল। পরবর্তীতে সেখান থেকে লাশ তোলা হয়। তাঁর শরীরের আঘাত দেখে অনেকেই বহুদিন ঠিকমতো ঘুমাতে পারেননি। স্বাধীনতা লাভের পর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শহীদের স্ত্রীকে তাৎক্ষণিকভাবে থাকার জায়গা করে দেন। পরবর্তীতে বাংলাদেশ বেতারে চাকরিও দেন। ১৯৯৭ সালে আওয়ামী লীগ সরকার এই সাহসী শহীদ মুক্তিযোদ্ধার স্মৃতি সংরক্ষণে তাঁর নামে দুই টাকা দামের স্মারক ডাক টিকিট চালু করেন। চলতি বছরের ডিসেম্বরে সরকারী কোয়ার্টার ছেড়ে দিতে সরকারের তরফ থেকে নোটিস পাঠানো হয়েছে। ‘বাসা ছেড়ে যাব কোথায়? থাকার মতো তেমন কোন বাসস্থান গড়ে তুলতে পারিনি। এজন্য জীবনের অনেকটাই শেষ প্রান্তে এসে অর্থ আর আশ্রয়ের অভাব খুব বেশি তাড়া করে ফিরছে।’ এক নাগাড়ে কথাগুলো বলছিলেন শহীদ মহিউদ্দিন হায়দারের স্ত্রী খুরশীদা হায়দার। পরিবারটি বর্তমানে রাজধানীর আজিমপুর সরকারী কলোনির ২/ই নম্বর ভবনের তৃতীয় তলার উত্তর দিকের একটি ছোট্ট ফ্ল্যাটে বসবাস করছেন। পুরনো সরকারী ভবনটি একেবারেই জরাজীর্ণ। অপরিচ্ছন্ন পরিবেশ। আশপাশে ময়লা ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। কাঁদা আর পানিতে একাকার অবস্থা। চারদিকে ছোট ছোট জঙ্গল। কতদিন তাতে মশার ওষুধ পড়েনি, তা অনেকেই ভুলে গেছেন। দিনের বেলায়ও মশা ভন ভন করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ঝাঁপসা আলোতে ভাঙ্গা সিঁড়ি বেয়ে তিন তলায় উঠেই উত্তর দিকের ফ্ল্যাটেই শহীদ পরিবারটির বসবাস। অনুমতি নিয়ে ভেতর প্রবেশ করেই মন খারাপ হয়ে গেল। ফ্ল্যাটটিতে মাত্র দুইটি ছোট ছোট থাকার কক্ষ। সেই সঙ্গে বাথরুম, রান্নাঘর আর এক চিলতে বারান্দা। কোনমতে জীবন ধারণ বলতে যা বুঝায়, অনেকটা তাই। সামান্য কুশলাদি বিনিময় শেষে কাছে বসে কেমন আছেন জানতে চাইতেই যেন মনের অনেক কষ্ট আর না বলা কথা প্রবল স্রোতের মতো মনের গহীন থেকে বেরিয়ে আসতে লাগল। বলেন, কেমন আর থাকব। কোনমতে বেঁচে আছি। কথা বলার সময় মনের অজান্তেই চোখ দিয়ে টপ টপ করে পানি ঝরছিল, তা সামলে নিচ্ছিলেন বারবার। ইতিহাস বলছে, শহীদ মহিউদ্দিন হায়দারের জন্ম ১৯৩৫ সালের ৫ জুলাই। পিতা শিক্ষাবিদ সদর উদ্দিন আহমেদ। মা নেকজান বেগম। বাড়ি পাবনা জেলা সদরের কাচারীপাড়া গ্রামে। মহিউদ্দিনের মুক্তিযোদ্ধা সনদ নম্বর-ম-১৪৯৩৯৯। মহিউদ্দিনের বড়ভাই জিয়াউদ্দিন হায়দার কবি। সেজো ভাই একুশে পদকপ্রাপ্ত ডা. সাঈদ হায়দার ভাষা আন্দোলনে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণকারী এবং প্রথম শহীদ মিনারের নকশাকারী। পঞ্চম ভাই সুজা হায়দার চিত্রশিল্পী। সবার ছোট ছিলেন মহিউদ্দিন হায়দার। ডাকনাম পল্টু। পাবনাতেই পড়াশুনায় হাতেখড়ি মহিউদ্দিনের। ১৯৫৭ সালে বিএ পাশের পর আইন পড়ার সময় ওয়াপদায় চাকরি নেন। কিন্তু সংস্কৃতিমনা মহিউদ্দিন সে চাকরি ফেলে যোগদেন রেডিও পাকিস্তানে। যুদ্ধ দিনের স্মৃতি হাতড়িয়ে ছিষট্টি বছর বয়স্ক এই জ্যেষ্ঠ নাগরিক বলছিলেন, আমার বাড়ি সাতক্ষীরা সদরে। স্বামী নিখোঁজের দিন তাঁর বিয়ের তখন তিন বছর তিন মাস পূর্ণ হয়েছে। ততদিনে সংসার আলো করে দুই ছেলে সন্তানের পিতামাতা আমরা। বড় ছেলে শাহেদ সদরুদ্দিনের বয়স এক বছর সাত মাস। আর ছোট ছেলে ইমতিয়াজ মহিউদ্দিনের বয়স মাত্র তিন মাস। সুখের সংসার। বসবাস করছিলাম রংপুরের একটি ভাড়া বাড়িতে। স্বামী মহিউদ্দিন হায়দার রেডিও পাকিস্তানের রংপুর কেন্দ্রের অনুষ্ঠান সংগঠক (প্রাগ্রাম অর্গানাইজার) হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ১৯৭১ সালের ১৫ আগস্ট সকাল নয়টার দিকে একটি সরকারী মাইক্রোবাসে করে অফিসের উদ্দেশে বাসা থেকে বের হন। গায়ে সাদা শার্ট। পরনে নেভি ব্লু প্যান্ট। গাড়িতে রেডিওর একজন প্রকৌশলী এবং রেডিও পাকিস্তানের আরও একজন কর্মকর্তা ছিলেন। যাওয়ার পর থেকে আর কোন খোঁজখবর নেই। পরবর্তীতে আমার স্বামীর বড় ভাই জিয়াউদ্দিন হায়দার এবং রেডিও পাকিস্তানে কর্মরত অন্যদের কাছ থেকে শুনতে পারি, মাইক্রোবাসটি বেতারকেন্দ্রে প্রবেশ করার সময় পাকিস্তানী আর্মিরা আটকায়। মাইক্রোবাসে বোমা থাকার অভিযোগ এনে সবাইকে ধরে সেনানিবাসে নিয়ে যায়। সেখানেই নির্মম নির্যাতনে হত্যা করা হয় আমার স্বামীকে। চরম নির্যাতনের মুখেও আমার স্বামী কোন কিছুতেই পাকিস্তান আর্মির কাছে নতি স্বীকার করেননি বলে পরবর্তীতে আর্মিদের হাত থেকে প্রাণে বেঁচে যাওয়াদের কাছ থেকে শুনতে পারি। পরবর্তীতে স্থানীয়দের কাছ থেকে জানতে পারি, রেডিও পাকিস্তানের একজন কর্মকর্তাকে হত্যার পর লাশটি চরম অবজ্ঞা আর অবহেলার সঙ্গে গাড়ি করে শ্যামপুর সুগার মিলের নির্জন আখ ক্ষেতে গর্ত করে মাটি চাপা দিয়েছে পাকিস্তানী আর্মিরা। আমি সুগার মিল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করি। তারা প্রথমে লাশ তুলতে অস্বীকৃতি জানায়। কর্তৃপক্ষের আশঙ্কা, লাশ তোলার বিষয়টি পাকিস্তানী আর্মিদের কানে গেলে, তারাও বিপদে পড়বেন। শেষ পর্যন্ত অত্যন্ত গোপনে সার্বিক পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হলে স্থানীয়দের সহায়তায় লাশ তোলা হয়। বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় পরিহিত পোশাক আর শরীরের সার্বিক বর্ণনায় সবকিছু হুবহু মিলে যায়। আর শরীরে নির্যাতনের অসংখ্য চিহ্ন ছিল। যা দেখে বহুদিন অনেকেই ঠিকমতো ঘুমাতে পারেননি। স্বামীকে হারিয়ে ছোট ছোট দুই সন্তান নিয়ে চরম বিপাকে পড়ি। শেষ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর আন্তরিক সহায়তা আর স্বামীর চাকরির সুবাদে ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ বেতারে আমার চাকরি হয়। স্বাধীনতা লাভের পর বঙ্গবন্ধু শহীদ পরিবারের সদস্যদের নগদ দুই হাজার টাকা করে সহায়তা করেন। আমিও সন্তানদের সঙ্গে নিয়ে বঙ্গবন্ধুর কাছে যাই। বঙ্গবন্ধু সবকিছু শুনে বলেন, তোমার প্রয়োজন বাসস্থান। কারণ দুই সন্তান নিয়ে তুমি তো আর গাছতলায় থাকতে পারবে না। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে দুই সন্তান নিয়ে আমার থাকার ব্যবস্থা হয়। এরপর চাকরির সুবাদে আজিমপুরের এই বাসায় বসবাস করছি। কিন্তু ২০০৭ সালে চাকরি থেকে আমার অবসর হয়। অবসরের পর বার বার আমাকে সরকারী বাসা ছাড়ার জন্য তাগাদা দেয়া হচ্ছে। কিন্তু আমি কোথায় যাব? আমার রোজগার নেই। রোজগার বলতে শহীদ পরিবার হিসেবে ভাতার টাকা। আর ছোট ছেলে পিপলস ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিতে সামান্য বেতনে চাকরি করছে। বড় ছেলে ২০০৬ সালে অস্ট্রেলিয়ায় যায়। ভেবেছিলাম, হয়ত কপাল খুলবে। কিন্তু বিধি বাম। ছেলেবৌর জটিল ক্যান্সার ধরা পড়ে। ছেলের রোজগারের প্রায় সব টাকাই চিকিৎসায় ব্যয় হচ্ছে। এদিকে চাকরির সুবাদে প্রায় সাড়ে তিন লাখ টাকার মতো হয়ত পাব। কিন্তু যতদিন পর্যন্ত এই বাসা না ছাড়ব, ততদিন পর্যন্ত পাওনা টাকা পাওয়া যাবে না। আর যখন বাসা ছেড়ে দেব, তখন যতদিন বাড়তি থেকেছি, ততদিনের ভাড়া হিসেবে পাওনা টাকা থেকে নিয়মানুযায়ী কেটে রাখবে সরকার। সে হিসেবে বাসা ছাড়ার পর তেমন কোন টাকাই পাওয়া যাবে না। ছোট ছেলের বৌ রুমানা পারভীন। হিসাববিজ্ঞান বিভাগ থেকে এমএ পাস করেছে। ছোট ছেলের ঘরে রাশিক ইমতিয়াজ নামের পাঁচ বছর বয়সী এক পূত্রসন্তান রয়েছে। থাকার মতো তেমন ঠাঁই আজও হয়নি। স্বল্প আয় দিয়ে কিভাবে বাসা ছেড়ে চার চারটি মানুষের জীবন চলবে, তাই ভেবে ভেবে অস্থির। জীবনের পড়ন্ত বিকেলে তাই অর্থ আর বাসস্থানের খুব অভাব অনুভব করছি। এমন অভাবের কথা বলতেও পারছেন না, আবার সইতেও পারছেন না। লোকলজ্জা আর অর্থের অভাবে দিশাহারা তাঁরা। অথচ যেন দেখার কেউ নেই! তাই তিনি দুঃখ করে বলছিলেন, স্বামীর রক্তের বিনিময়ে এদেশের মানুষ বাংলাদেশ নামের স্বাধীন ভূখ- পেল, অথচ শহীদ পরিবার হয়েও আজও স্বামীর রক্তে কেনা স্বাধীন দেশে শহীদ পরিবারটির মাথা গোঁজার এক চিলতে জায়গা হলো না। এমন পরিস্থিতি থেকে রেহাই পেতে তিনি ও তাঁর পরিবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপ কামনা করেন।
×