ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

সৌদি প্রবাসী বাবা ও চীনে অধ্যয়নরত ভাই স্কয়ারে

খাদিজার অবস্থার কিছুটা উন্নতি, সিলেট উত্তাল

প্রকাশিত: ০৬:০৩, ৭ অক্টোবর ২০১৬

খাদিজার অবস্থার কিছুটা উন্নতি, সিলেট উত্তাল

সালাম মশরুর, সিলেট অফিস ॥ বখাটে, সন্ত্রাসী বদরুলের চাপাতির কোপে গুরুতর আহত কলেজছাত্রী খাদিজা আক্তার নার্গিসের অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়েছে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। সিলেট সরকারী মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ ড. মোহাম্মদ নুরুল ইসলাম রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালের আইসিইউতে খাদিজাকে দেখে এসে এই তথ্য দেন। তিনি বলেন, তাকে আমি দেখে এসেছি, আগের চেয়ে অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়েছে, তার রেসপন্স পাওয়া যাচ্ছে। খাদিজাকে দেখে এসে তার শারীরিক অবস্থার উন্নতির কথা জানিয়ছেন বৃহত্তর জালালাবাদ এ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সিএম শফি সামীও। তিনি ডাক্তারদের সঙ্গে কথা বলে খাদিজার অবস্থার উন্নতির খবর দিয়েছেন। তিনি বলেন, ডাক্তাররা আমাকে জানিয়েছেন আগে বাঁচার ৫% সম্ভাবনা ছিল এখন সেটা বেড়ে ১৫% হয়েছে। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, খাদিজাকে ৭২ ঘণ্টার পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছিল, ৭২ ঘণ্টা শেষে আরও ২৪ ঘণ্টার পর্যবেক্ষণে রাখা হবে। একদিকে স্কয়ার হাসপাতাল, অপরদিকে সিলেটে খাদিজার হাউসা গ্রামের বাড়ি। আত্মীয়-পরিজন, প্রতিবেশী, সহপাঠি থেকে শুরু করে বিভিন্ন শ্রেণীপেশার মানুষ উদ্বেগ- উৎকণ্ঠায় ছুটে যাচ্ছেন, খোঁজ নিচ্ছেন খাদিজার। মেয়ের এই দুঃসংবাদ শুনে ছুটে এসেছেন খাদিজা বেগম নার্গিসের বাবা সৌদি আরব প্রবাসী মাসুক মিয়া। বৃহস্পতিবার সকালে ঢাকা পৌঁছে সরাসরি স্কয়ারে যান মেয়েকে দেখতে। খাদিজার বড় ভাই চীনে অধ্যয়নরত শাহীন আহমদও দুপুরে দেশে পৌঁছে স্কয়ারে চলে যান। খাদিজা আক্তার নার্গিসের হামলাকারী সন্ত্রাসী বদরুল আলমের শাস্তির দাবিতে বৃহস্পতিবারও বিক্ষোভে উত্তাল ছিল সিলেটনগরী। নগরীর বিভিন্ন স্থানে বদরুলের শাস্তি দাবি করে বিক্ষোভ প্রদর্শন করা হয়। প্রেমের সম্পর্ক রাখতে রাজি না হওয়ায় ক্ষিপ্ত হয়ে খাদিজাকে এলোপাথাড়ি কোপায় বখাটে বদরুল। আদালতে দেয়া জবানবন্দীতে এমনটিই দাবি করেছে সে। সিলেটের অতিরিক্ত মহানগর মুখ্য হাকিম শারাবান তহুরার আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দীতে বদরুল জানায়, খাদিজার সঙ্গে আমার প্রেমের সম্পর্ক ছিল। সে প্রতিজ্ঞা করেছিল অন্য কারও সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক রাখবে না। সে আমার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে আমাকে এড়িয়ে যেতে থাকে। ঘটনার দিন সিলেটের এমসি কলেজে পরীক্ষা দিতে আসে খাদিজা। আমি জানতাম সেদিন তার পরীক্ষা আছে। তাই সকাল ১০টার সময় আমি এমসি কলেজ ক্যাম্পাসে চলে আসি। দুপুর ১২টার দিকে সে ক্যাম্পাসে আসে। তার সঙ্গে দেখা হলে আমি অনেক অনুনয় করি, যাতে সে আমায় বিয়ে না করলেও আমার সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক টিকিয়ে রাখে। খাদিজা পরীক্ষার হলে ঢুকে গেলে আমি কলেজের দপ্তরীর মাধ্যমে ১ ক্যান কোমল পানীয় তার জন্য পাঠাই। সে এটি নিতে অস্বীকৃতি জানায় ও তা ফিরিয়ে দেয়। এতে আমি রাগে ক্ষিপ্ত হই। ক্ষিপ্ত হয়ে আমি আম্বরখানা যাই। সেখান থেকে একটি মাংস কাটার চাপাতি কিনে আনি। সে জানায়, পরীক্ষা শেষে বেরিয়ে এলে খাদিজার সঙ্গে আবার আমার কথা হয়। তার কথাবার্তার পুরোটাই ছিল নেতিবাচক। তখন আমি আবারও প্রেম ভেঙে না দেয়ার জন্য তাকে অনুরোধ করি। সে তাতে সায় না দেয়ায় রাগে-ক্ষোভে আমি তাকে চাপাতি দিয়ে তার হাতে, মাথায় ও শরীরের বিভিন্ন অংশে এলোপাথাড়ি কোপাতে থাকি। বদরুল জবানবন্দীতে দাবি করে, আমি সম্পূর্ণ সচেতনভাবে নিজ বুদ্ধিতে এটি করেছি। এক পর্যায়ে আমি পালাতে চেষ্টা করলে পুলিশ আমাকে গ্রেফতার করে ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়। বদরুল সম্পর্কে বলতে গিয়ে খাদিজার বাবা সৗদি আরব প্রবাসী মাসুক মিয়া বলেন, আমার জীবনের বেশিরভাগ সময় প্রবাসে কাটিয়েছি। শুধু সন্তানদের মানুষ করব সেটাই ভেবেছি। বদরুল আমার বাড়িতে লজিং ছিল সেটা আমি এই ঘটনার পর জানতে পেরেছি। তবে আমার মেয়েকে উত্ত্যক্ত করায় তাকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিলেন আমার ভাই আব্দুল কুদ্দুস। এখন তো দেখছি আমার বাড়িতে বিষাক্ত সাপ হয়ে ঢুকেছিল। মেয়ের জন্য দেশবাসীর কাছে দোয়া চেয়ে হাসপাতালে সাংবাদিকদের মাসুক মিয়া বলেন, আমার মানসিক অবস্থা ভাল নেই। সবাই শুধু আমার মেয়ের জন্য দোয়া করবেন, যেন আল্লাহ ওকে সুস্থ করে দেন। দেশবাসীর কাছে আমার মেয়ের জন্য দোয়া চাইছি। তিনি বলেন, সন্তান জন্ম দেয়া, তাকে লালন-পালন করা কত কষ্টের। এসব কষ্টকে আরও বিষাদময় করে তুলে সন্ত্রাসীদের হামলা। আমি চাই আমার মেয়ের মতো কেউ যেন এমন ঘটনার শিকার না হয়। সাংবাদিকদের ধন্যবাদ জানিয়ে তিনি বলেন, তাদের জন্য আজ গোটা জাতি আমার মেয়ের নির্মম ঘটনা সম্পর্কে জেনেছে। সবার কাছে দোয়া চাই, আল্লাহ যেন আমার মেয়েকে সুস্থ করে দেন। সৌদি আরব প্রবাসী মাসুক মিয়া বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ১০টায় ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নেমে সরাসরি স্কয়ারে চলে আসেন। দুপুর ১২টার দিকে তিনি হাসপাতালে পৌঁছার পর মেয়ের সর্বশেষ অবস্থা সম্পর্কে চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলেন। খাদিজা স্কয়ার হাসপাতালের আইসিইউতে রয়েছেন। তাকে ৭২ ঘণ্টার পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে। বিক্ষোভে উত্তাল সিলেট নগরী ॥ কলেজছাত্রী খাদিজা আক্তার নার্গিসের হামলাকারী ছাত্রলীগের বদরুল আলমের শাস্তির দাবিতে বৃহস্পতিবারও বিক্ষোভে উত্তাল সিলেট নগরী। নগরীর বিভিন্ন স্থানে বদরুলের শাস্তি দাবি করে বিক্ষোভ প্রদর্শন করা হয়। খাদিজার নিজ ক্যাম্পাস সিলেট সরকারী মহিলা কলেজের শিক্ষার্থীরা দ্বিতীয় দিনের মতো সকাল ১০টায় বিক্ষোভ কর্মসূচী শুরু করেন। এ সময় জিন্দাবাজার-আম্বরখানা সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করা হয়। সকাল ১১টায় তারা বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে সিলেট জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী বরাবরে ৪ দফা সংবলিত স্মারকলিপি প্রদান করেন। তাদের অন্যতম দাবি দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে বদরুলের বিচার করতে হবে। মহিলা কলেজের আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের মুখপাত্র ফজিলাতুন্নেছা বলেন, আমাদের কলেজ ক্যাম্পাসে প্রতিদিনই বিক্ষোভ চালিয়ে যাব, আমরা দ্রুত বিচার দেখতে চাই, নিরাপত্তা চাই নারীর। সিলেট কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের সামনে বিক্ষোভ পালন করেছেন মহিলা কলেজের সাবেক শিক্ষার্থীরা। সাবেক শিক্ষার্থীদের পক্ষে এ্যাডভোকেট শিরিন আক্তার বলেন, পাশবিক এই ঘটনার দ্রুত বিচার করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে। এদিকে হামলার ঘটনাস্থল এমসি কলেজ ক্যাম্পাসেও বিক্ষোভ পালন করেন সেখানকার শিক্ষার্থীরা। বিক্ষোভ হয়েছে খাদিজার নিজ এলাকা সদর উপজেলার মোগলগাওয়ের হাউসা গ্রামের এলাকাবাসী। এছাড়াও একই দাবিতে সিলেটে প্রতিবাদ কর্মসূচী পালন করেছে বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড এ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট), সিলেট সরকারী মহিলা কলেজের এ্যালামনাই এ্যাসোসিয়েশন, জৈন্তিয়া ছিন্নমূল সংস্থা (জেছিস), ‘আমরাই পারি’ পারিবারিক নির্যাতন প্রতিরোধ জেলা জোট, সিলেট ও এশিয়া ছিন্নমূল মানবাধিকার বাস্তবায়ন ফাউন্ডেশন। বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে সিলেট ফ্রেন্ডস ক্লাবের উদ্যোগে মানববন্ধন কর্মসূচী পালন করা হয়। সিলেট ফ্রেন্ডস ক্লাবের সভাপতি মোঃ মিহাদ রহমানের সভাপতিত্বে ও সাধারণ সম্পাদক সজিব আহমদ কাদিরের পরিচালনায় মানববন্ধনে প্রধান অতিথি ছিলেন সিলেট কেন্দ্রীয় সমবায় কেন্দ্রের পরিচালক ও জেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টাম-লীর সদস্য এসএম নুনু মিয়া। বিশেষ অতিথি ছিলেন এটিএন বাংলা ইউকে’র বিভাগীয় প্রধান শফিকুল ইসলাম শফি, সংগঠনের উপদেষ্টা ও সিলেট মদন মোহন কলেজ ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি জাহাঙ্গীর চৌধুরী। এ সময় উপস্থিত ছিলেন সিলেট ফ্রেন্ডস ক্লাবের সাংগঠনিক সম্পাদক আতিকুর রহমান, সহসভাপতি মুজাক্কির আহমেদ, রাজুল আহমদ, সহসম্পাদক এম এইচ ফয়সাল, মহানগর ছাত্রলীগ নেতা মোঃ রাজু আহমদ, মদন মোহন কলেজ ছাত্রলীগ নেতা রাজেশ সরকার, সুহেল আহমদ, জমির আহমদ, মিলন আহমদ, আতিক আহমদ, ফাহিম, বাদল, বৃষ্টি, রবিন ও সাজ্জাদ । আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের মুখপাত্র ফজিলাতুন্নেছাকে হুমকি ॥ বদরুলের ফাঁসির দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের মুখপাত্র ফজিলাতুন্নেছাকে মোবাইলে হত্যার হুমকি দেয়া হয়েছে। বৃহস্পতিবার বেলা ১২টার দিকে মহিলা কলেজের দ্বাদশ শ্রেণীর ছাত্রী ফজিলাতুন্নেছা যখন তার সহপাঠীদের নিয়ে আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছিল তখন তার মায়ের মোবাইলে একটি অপরিচিত নম্বর থেকে কল দিয়ে ফজিলাতুন্নেছাকে আন্দোলন থেকে সরে দাঁড়ানোর কথা বলে। অন্যথায় তাকেও খাদিজার মতো কোপানো হবে বলে হুমকি দেয়। এ হুমকির পর থেকে ফজিলাতুন্নেছার পরিবারের লোকজনদের মধ্যে দেখা দিয়েছে উৎকণ্ঠা। এ খবর জানাজানির পর চাপা ভয় বিরাজ করছে মহিলা কলেজের আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের মধ্যে। তবে এ ব্যাপারে ফজিলাতুন্নেছা বলেন, হুমকিধমকি দিয়ে আমাদের আন্দোলনকে দমিয়ে রাখা যাবে না। বদরুলের ফাঁসির আগ পর্যন্ত তাদের আন্দোলন চলবে।
×