বিভাষ বাড়ৈ ॥ পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁস চক্রের সন্ধান পেয়েছে সরকার। প্রশ্ন ফাঁসে জড়িত অপরাধীদের চিহ্নিত করে অবিলম্বে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করা হয়েছে সরকারের একটি বিশেষ গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে; যেখানে তুলে ধরা হয়েছে অপরাধী চক্রের হোতাদের পরিচয়। এরাই মোবাইলের মাধ্যমে প্রশ্নপত্র বের করে দ্রুত সমাধান শেষে হলে উত্তরপত্রও সরবরাহ করছে। উত্তর পরীক্ষার্থীদের কাছে পৌঁছানোর জন্য এটিএম কার্ডসদৃশ মাস্টার কার্ড ও বিশেষ ধরনের ক্ষুদ্র ব্লুটুথ হিয়ারিং ডিভাইস ব্যবহার করছে। একের পর এক প্রশ্ন ফাঁস করে এরা একদিকে কোটি টাকা লোপাট করছে অন্যদিকে সরকারকে প্রশ্নের মুখে ফেলে দিচ্ছে। এদিকে অপরাধীরা আজ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের নিয়োগ পরীক্ষায়ও প্রশ্ন ফাঁস করবে বলে সতর্ক করা হয়েছে গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে।
জানা গেছে, আজ সকালে সারাদেশে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের অধীন উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা নিয়োগের পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। এই নিয়োগকে কেন্দ্র করে অপরাধীদের সক্রিয় হয়ে ওঠার প্রেক্ষাপটে তদন্তে নেমে নিয়োগ ও পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসের ভয়াবহ চিত্রের সন্ধান পেয়েছে গোয়েন্দারা। এ কর্মকা-ের সঙ্গে জড়িতদের চিহ্নিত করে গোয়েন্দা সংস্থার পক্ষ থেকে সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরে প্রতিবেদন পাঠানো হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আজ শুক্রবার কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের অধীন উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা পদে নিয়োগের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদের (আইবিএ) অধীন পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কেন্দ্রে নেয়া হবে এ পরীক্ষা। এই নিয়োগকে কেন্দ্র করে কৃষি মন্ত্রণালয় ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিফতরের কর্মকর্তাদের যোগসাজশে একাধিক জালিয়াত চক্র সক্রিয় হয়ে উঠেছে। অপরাধীরা প্রশ্নপত্র ফাঁস করাসহ প্রক্সি পরীক্ষার্থী, বিশেষ মোবাইল ডিভাইসের মাধ্যমে প্রশ্ন ফাঁস ও উত্তরপত্র পরীক্ষার হলে পরীক্ষার্থীদের কাছে পৌঁছানোর সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়েছে। অপরাধীদের নাম-পরিচয় উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জালিয়াত চক্রের মধ্যে আছেন কৃষি মন্ত্রণালয়ের অফিস সহকারী মোঃ বেলাল হোসেন, ভূমি সংস্কার বোর্ডের অফিস সহকারী জাহিদ হোসেন, ঠাকুরগাঁও জেলার কথিত ছাত্রলীগ নেতা নামধারী মোতাহার হোসেন, ঢাকা টিচার্স ট্রেনিং কলেজের এমএড কোর্সের ছাত্র পলাশ, জনতা ব্যাংকের এক্সিকিউটিভ অফিসার সোহেল রানা। ডিজিটাল জালিয়াত চক্রের অন্যতম হোতা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে কুড়িগ্রামের মোঃ রবিউল ইসলামকে। যার সহযোগী পঞ্চগড়ের একটি মাদ্রাসার প্রভাষক আব্দুল হাকিম। এরাই আজ রাজধানীর সরকারী টিচার্স ট্রেনিং কলেজ কেন্দ্র থেকে উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র বের করবে বলে সরকারকে সতর্ক করা হয়েছে গোয়েন্দা সংস্থার ওই প্রতিবেদনে।
প্রতিবেদনে পাবলিক ও নিয়োগ পরীক্ষায় অপরাধীদের তৎপরতার কৌশল তুলে ধরা হয়েছে। বলা হয়েছে, অপরাধীরা পরীক্ষার শুরুর আগে কখনও কখনও শুরুর ৩০ মিনিটের মধ্যে মোবাইলের মাধ্যমে প্রশ্নপত্র বের করে দ্রুত সমাধান শেষে হলে নির্দিষ্ট প্রার্থীর কাছে উত্তরপত্রও সরবরাহ করছে। উত্তর পরীক্ষার্থীদের কাছে পৌঁছানোর জন্য এটিএম কার্ডসদৃশ মাস্টার কার্ড ও বিশেষ ধরনের ক্ষুদ্র ব্লুটুথ হিয়ারিং ডিভাইস ব্যবহার করছে। বিশেষ ধরনের মাস্টার কার্ডকে কাঁধ অথবা কানের কাছাকাছি শরীরের কোন স্থানে টেপ দিয়ে আটকানো হয় এবং বিশেষ হিয়ারিং ডিভাইস কানের ভেতর ঢুকিয়ে দেয়া হয়। মাস্টার কার্ডের নম্বরে কল মোবাইলে কল দিলে তা স্বয়ংক্রিয়ভাবে রিসিভ হয়ে যায়। এরপর জালিয়াত চক্রের সদস্যরা প্রশ্নের উত্তর বলে দেয়। এই কাজের জন্য বিশেষভাবে তৈরি টি শার্ট পাওয়া যায় যা মোবাইলের কাজ করে। এসব টি শার্ট ও মোবাইল ডিভাইস জালিয়াত চক্র চীন থেকে আমদানি করে বলেও বেরিয়ে এসেছে তদন্তে।
এই জালিয়াত চক্র দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন পরীক্ষায় অপকর্ম করে আসছে উল্লেখ করে সরকারকে সতর্ক করে বিশেষ সংস্থার পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ফাঁস চক্রের একাধিক সদস্য বিভিন্ন সময় গ্রেফতার হলেও অর্থের বিনিময়ে আবার কখনও আদালত থেকে জামিন নিয়ে বের হয়ে একই কাজে লিপ্ত হয়েছে।
জালিয়াতির মাধ্যমে অপেক্ষাকৃত কম মেধাসম্পন্নরা যেমন নিয়োগ পাচ্ছে তেমনি নিয়োগের আগে গোয়েন্দা প্রতিবেদন প্রয়োজন না হওয়ায় জামায়াত-শিবিরের কর্মী-সমর্থকরা সরকারী চাকরিতে ঢুকে পড়ছে। এদিকে প্রতিবেদনে আজকের পরীক্ষার বিষয়ে সরকারকে কঠোর পদক্ষেপ নেয়ার সুপারিশ করে বলা হয়েছে, নিয়োগ পরীক্ষা কেন্দ্রগুলোকে কঠোর নজরদারি ও কেন্দ্রের ভেতরে পর্যাপ্ত তল্লাশি চালানো না হলে জালিয়াত চক্র বিপুলসংখ্যক অযোগ্য প্রার্থীর চাকরি লাভের ব্যবস্থা করে কৃষিমন্ত্রী ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের মহাপরিচালকের মহৎ উদ্যোগ ব্যর্থ করে দিতে পারে।
গোয়েন্দা সংস্থার পক্ষ থেকে সরকারকে সুপারিশ করে বলা হয়েছে, জালিয়াত চক্রের কর্মকা-, গতিবিধি ও মোবাইলের কথোপকথন নজরদারিতে রাখা যেতে পারে। পরীক্ষা কেন্দ্রসমূহের প্রবেশপথে ও ভেতরে ব্যাপক তল্লাশির ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। এছাড়া প্রক্সি পরীক্ষার্থী ও ডিভাইসের ব্যবহার বন্ধে প্রতিটি পরীক্ষার্থীকে কেন্দ্রে দেহ তল্লাশি করার জন্য প্রয়োজনীয় জনবলসহ তল্লাশ টিম গঠন করারও সুপারিশ করা হয়েছে সরকারের কাছে।
এদিকে গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনের পর নড়েচড়ে বসেছে প্রশাসন। অপরাধী চক্রের প্রত্যেকেই চার থেকে ৫টি মোবাইল নম্বর ব্যবহার করছেন। যাদের একজন হচ্ছেন কৃষি মন্ত্রণালয়ের অফিস সহকারী মোঃ বেলাল হোসেন। তার একটি মোবাইল নম্বর খোলা পাওয়া যায়। বাকি সব নম্বর বন্ধ। তার সেলফোনে কল করা হয়েছিল। বেলাল হোসেন বলছেন? এমন প্রশ্নে তিনি প্রথমে বলেন, হ্যাঁ। আপনি কি কৃষি মন্ত্রণালয়ে কাজ করেন। বলেন, হ্যাঁ। এরপর তিনি বলেন, আপনি কে? সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে তিনি বলেন, আমি তো কৃষি মন্ত্রণালয়ে কাজ করি না। তাহলে কোথায়? এ প্রশ্নে তিনি কোন তথ্য দিতে রাজি হচ্ছিলেন না। বলেন, আছি, একটা জায়গায় আছি। সেটা কোথায় কয়েকবার প্রশ্ন করা হলে বলেন, আমি ঠাকুরগাঁয়ে আছি। রিয়া প্রকল্পে। এই প্রকল্প কোন্ মন্ত্রণালয়ের অধীন। এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, আমার এত তথ্য কেন জানতে চান? গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে নাম আসার তথ্য দিলে সঙ্গে সঙ্গে রং নম্বর বলে লাইন কেটে দেন তিনি। এরপর আর মোবাইল খোলেননি।
এরপর ফাঁস করা প্রশ্ন চেয়ে এক পরীক্ষার্থীর বড় ভাই পরিচয় দিয়ে কল করা হলে আরেক অভিযুক্ত জনতা ব্যাংকের এক্সিকিউটিভ অফিসার সোহেল রানা উল্টো কোথা থেকে গোপন নম্বর পেলাম তা জানতে চান। এই নম্বর ঠাকুরগাঁওয়ের বেলাল হোসেন দিয়েছে উল্লেখ করলে বলেন, আপনাকে তো আমি চিনি না। আপনাকে কিভাবে সাহায্য করব। আপনি তো অপরিচিত। এরপর দেখা করতে চাই, প্রশ্ন আগে পেতে কত টাকা লাগবে বলা হলে তিনি বলেন, না ভাই আপনাকে কিভাবে হেল্প করব। আপনাকে চিনি না। আর আমার নম্বর বেলাল দিয়েছে কিনা তা আবার জানতে চান। কয়েকবার দেখা করার কথা বলে হলে তিনি হঠাৎ রং নম্বর বলে লাইন কেটে দেন। এরপর মোবাইল বন্ধ করে দেন। আরেক অভিযুক্ত ভূমি সংস্কার বোর্ডের অফিস সহকারী জাহিদ হোসেনের একাধিক নম্বরে কয়েক দফা চেষ্টা করা হলেও নম্বর খোলা পাওয়া যায়নি। মোতাহার হোসেন, রবিউল ইসলামের চারটি নম্বরই বন্ধ পাওয়া যায়।
এদিকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়, শিক্ষা বোর্ডসহ সংশ্লিষ্ট সকলের কাছেই এখন পরিষ্কার এবারের এইচএসসি পরীক্ষায়ও পরীক্ষা শুরুর এক ঘণ্টা বা ৩০ মিনিট আগে প্রশ্ন ফাঁস করা হয়েছে কেন্দ্র থেকেই। ফাঁস করে দেয়া হয়েছে ফেসবুক, ভাইবারসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। বোর্ড কর্মকর্তারা সন্দেহ করছেন, পরীক্ষা শুরুর আগে প্রশ্নের বান্ডিল খোলার পরই একটি চক্র মোবাইলে সেই প্রশ্নের ছবি করে ফেসবুকে ছড়িয়ে দিচ্ছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই টাকার লেনদেনেরও প্রমাণ মিলছে না। বরং ফেসবুকে ছেড়ে দিয়ে একটি চক্র সরকারকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলতে চায় বলেই মনে করছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও বিশেষজ্ঞরা। এবার পরীক্ষা শুরুর এক ঘণ্টা আগেই ফেসবুকে প্রশ্নপত্র ফাঁস করেন আহমেদ নিলয় নামে এক ব্যক্তি। কয়েক দিন আগে এই নিলয় গ্রেফতার হয়েছে। এবার পাবলিক পরীক্ষায় অপরাধীরা প্রশ্নপত্রের ইমেজ (ছবি) আকারে ফেসবুক ভাইবারে আপলোড করেন। পরীক্ষার প্রশ্নপত্রের সঙ্গে ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্রের হুবহু মিলও পান বোর্ড কর্মকর্তারা।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অপরাধী কতটা বেপরোয়া তার প্রমাণ পাওয়া যায় তাদের পর পরীক্ষার আগে ফেসবুকে দেয়া স্টেটাসে। পরীক্ষা শুরুর আগেই অপরাধী আহমেদ নিলয় তার ফেসবুক টাইমলাইনে লিখেছিলেন, ‘সালা সাংবাদিকদের জন্য কিচ্ছু দিতে মন চায় না। অনেক বড় বিপদে আছি, তার পরও সাহায্য না করে পারলাম না। সবাই দোয়া কর। ইনশাল্লাহ যাতে তোমাদের পাশে থাকতে পারি। প্রতিদিনের মতো আজকের সকালবেলা প্রশ্ন সবাইকে ফ্রি দিলাম, শুধুমাত্র প্রমাণ দেয়ার জন্য। পরীক্ষার হল থেকে এসে মিলিয়ে নিও।
বিশেষ দ্রষ্টব্য দিয়ে আরও লেখা হয়েছে, ‘এখন কিছু চিটার-বাটপার আছে, যারা আমার ফ্রি দেয়া প্রশ্নের কপি মেরে ৫০০/১০০০ টাকা বিক্রি করছে। এদের থেকে সাবধান হন এবং চিটার-বাটপারকে ধরতে সাহায্য করেন।’
সঠিক প্রমাণ এখনও বের করতে না পারলেও এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার প্রশ্ন কোন্ কেন্দ্র থেকে ফাঁস হচ্ছে তার একটা ধারণা পাচ্ছেন সরকারের কর্মকর্তারা। একই আরণা শিক্ষা বিশেষজ্ঞদেরও। ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের কর্মকর্তারা বলছেন, সাধারণত পরীক্ষা কেন্দ্রে প্রশ্ন যায় এক ঘণ্টা আগে। সেখান থেকেই বান্ডিল খোলার পর এটি কোন্ কেন্দ্র থেকে ফাঁস করা হয়েছে বলে বোঝা যাচ্ছে। কারণ, মোবাইলে ছবি করে হুবহু প্রশ্ন দেয়া হচ্ছে বলেই প্রমাণ মিলেছে। এদিকে শিক্ষাবিদরা ফেসবুকে প্রশ্ন ছেড়ে দেয়ার ঘটনাকে কোন কেন্দ্রের ইচ্ছাকৃত অপকর্ম হিসেবে অভিহিত করেছেন। তারা বলছেন, এবার পরপর কয়েকটি পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস হয়েছিল। বিষয়টা উদ্বেগজনক। তবে যেহেতু আগের দিন ফাঁস হচ্ছে না, হচ্ছে পরীক্ষার দিন। তাও এক ঘণ্টা আগে। এতে পরিষ্কার যে, কেন্দ্রে প্রশ্ন গেলে এর পর তা ফাঁস করা হচ্ছে। ফেসবুকে দিয়ে দিলে টাকা পাওয়া যাবে না। তার পরেও সেভাবে দেয়া হচ্ছে। এর কারণ, সরকারকে হেয় করা। না হয় প্রশ্ন বিক্রি করে টাকা আদায় করা হতো, প্রশ্ন এভাবে ফেসবুকে দেয়া হতো না। কেন্দ্র এ অপকর্মে আছে।