ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

৩৬ শতাংশ অর্থের যোগান দিয়েছে বেসরকারী খাতের ব্যাংকগুলো ;###;শূন্য দশমিক ৬৪ শতাংশ খেলাপী

২০ বছরে ৭৬ হাজার কোটি টাকার সিন্ডিকেট ঋণ

প্রকাশিত: ০৪:২৪, ৭ অক্টোবর ২০১৬

২০ বছরে ৭৬ হাজার কোটি টাকার সিন্ডিকেট ঋণ

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ ১৯৯৫ সাল থেকে শুরু হলেও মূলত ২০০৫ সাল থেকেই সিন্ডিকেট ঋণ জনপ্রিয় হতে শুরু করে। গত ২০ বছরের বেশি সময়ে প্রায় ৭৬ হাজার ৫২৮ কোটি টাকার সিন্ডিকেট ঋণ দিয়েছে দেশের কার্যরত ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো। এই সময় দেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তির ১২ খাতের ৩৯৮ প্রকল্পে এসব ঋণ দেয়া হয়েছে। এসব ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে প্রধান সমন্বয়ক হিসেবে ৪৫ দশমিক ৭৩ শতাংশ প্রকল্পের এবং মোট ঋণের ৩৬ শতাংশ অর্থের যোগান দিয়েছে বেসরকারী খাতের ব্যাংকগুলো। গত ২০ বছরে সিন্ডিকেট ঋণ দিতে গিয়ে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মাত্র শূন্য দশমিক ৬৪ শতাংশ খেলাপী হয়েছে। এই সময় সিন্ডিকেট ঋণের শূন্য দশমিক ৫২ শতাংশ ঋণ পুনর্গঠন করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার রাজধানীর মিরপুরে বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব ব্যাংকের ম্যানেজমেন্ট (বিআইবিএম) আয়োজিত এক কর্মশালায় এসব তথ্য উঠে আসে। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গবর্নর এস কে সুর চৌধুরী। ‘ঋণ সিন্ডেকেট বাংলাদেশ : অবস্থা এবং চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক কর্মশালায় গবেষণাপত্র উপস্থাপন করেন বিআইবিএমের অধ্যাপক হেলাল আহমেদ চৌধুরী। আরও বক্তব্য রাখেন অগ্রণী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শামস উল ইসলাম, এনসিসি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক গোলাম হাফিজ, আইডিএলসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আরিফ খান। সঞ্চালকের ভূমিকা পালন করেন বিআইবিএমের মহাপরিচালক ড. তৌফিক আহমেদ চৌধুরী। প্রধান অতিথির বক্তব্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গবর্নর এস কে সুর চৌধুরী বলেন, কোন প্রকল্পে বড় আকারে ঋণ দেয়ার জন্য এটি একটি ভাল সুযোগ। বিআইবিএমের গবেষণায় উঠে এসেছে এখানে খেলাপী ঋণের পরিমাণ খুবই কম। যেখানে ব্যাংকগুলো অনেকদিন ধরে খেলাপী গ্রাহকদের হাত থেকে বের হয়ে আসার জন্য কাজ করছে সেখানে এটি একটি ভাল সুযোগ বলতেই হবে। কারণ এখানে বিভিন্ন ধাপে, কয়েকটি মাধ্যম মিলে ঋণটি পর্যবেক্ষণ করতে থাকে বলেই আদায় বেশি হয়। অগ্রণীর ব্যবস্থাপনা পরিচালক শামস উল ইসলাম বলেন, ব্যাংকটি এখন পর্যন্ত বিভিন্ন প্রজেক্টে ২ হাজার ৬ কোটি টাকা অর্থায়ন করেছে। যার সবই সিন্ডিকেট ঋণের আওতায়। এর মধ্যে ১৬ প্রকল্পে অগ্রণী ব্যাংক প্রধান সমন্বয়কের (লিড এ্যারেঞ্জার) ভূমিকায় ছিল। তবে এনসিসি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক গোলাম হাফিজ বলেন, গ্রাহকরা অনেক সময় নিয়মকানুন মানতে চান না। তারা যত দ্রুত সম্ভব টাকাটা চান। কিন্তু সবকিছু সমন্বয় করতে যে সময়ের প্রয়োজন তা তারা দিতে চান না। এতে করে অনেক সময় ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে বিপদে পড়তে হয়। তবে যেসব ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান সিন্ডিকেট ঋণ দেয় সেখানে কোন ধরনের জটিলতা তৈরি হলেই সমন্বয়হীনতা তৈরি হয় বলে জানালেন তিনি। তিনি বলেন, এসব ক্ষেত্রে প্রধান সমন্বয়ক অন্যদের সঙ্গে যোগাযোগ কমিয়ে দেন। তবে সবকিছুর পরও ৫০, ৬০ বা ১শ’ কোটি টাকার বেশি প্রজেক্ট ফাইন্যান্সে সিন্ডিকেট ঋণ দেয়াই অনেক যুক্তিযুক্ত। এখানে এককভাবে যাওয়া উচিত নয়। বাংলাদেশ ব্যাংককে এ বিষয়ে একটি নীতিমালা এমনভাবে তৈরি করার অনুরোধ করেন তিনি, যেখানে এ বিষয়ে যেন কাউকে বাধ্য না করা হয়। আইডিএলসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আরিফ খান বলেন, ১৯৯৫ সাল থেকে শুরু হলেও মূলত ২০০৫ সাল থেকেই সিন্ডিকেট ঋণ জনপ্রিয় হতে শুরু করে। এসব ঋণের জন্য ১০ থেকে ১৫ বছরের সময় দিতে পারলে ভাল হয়। কিন্তু আমরা গ্রাহকদের ৫-৭ বছরের বেশি দিতে পারি না। কর্মশালায় গবেষণাপত্রে উল্লেখ করা হয়, ১৯৯৫ থেকে ২০১৬ সালের জুন পর্যন্ত ৩৯৮ প্রকল্পে মোট ৭৬ হাজার ৫২৮ কোটি টাকার সিন্ডিকেট ঋণ দেয়া হয়। এই সময় সবচেয়ে বেশি পরিমাণে ঋণ দেয়া হয় জ্বালানি খাতে। এ খাতের ৬৩ প্রকল্পে বিতরণ করা হয় ২২ হাজার ১৭১ কোটি টাকা। যা মোট প্রকল্পের ১৫ দশমিক ৮৩ শতাংশ ঋণ দেয়া হয়েছে জ্বালানি খাতে। অন্যদিকে মোট সিন্ডিকেট ঋণের ২৮ দশমিক ৯৭ শতাংশ বিতরণ করা হয়েছে এ খাতে। এরপরেই রয়েছে টেলিকম খাত। এ খাতের ২৯ প্রকল্পে ১৩ হাজার ৬৮৫ কোটি ১৮ লাখ টাকার সিন্ডিকেট ঋণ দেয়া হয়। যা মোট সিন্ডিকেট ঋণের ১৭ দশমিক ৮৮ শতাংশ। প্রকৌশল ও ইস্পাত খাতের ৪৯ প্রকল্পে বিতরণ করা হয় ৯ হাজার ৪৯৬ কোটি টাকা। যা মোট ঋণের ১২ দশমিক ৪১ শতাংশ। গার্মেন্টস টেক্সটাইল এবং স্পিনিং এই তিন খাত নিয়ে পোশাক শিল্পের ৮৫ প্রকল্পে বিতরণ করা হয় ৬ হাজার ৫৫১ কোটি টাকা। যা মোট প্রকল্পের ২১ দশমিক ৩৬ শতাংশ। অন্যদিকে ৮ দশমিক ৫৬ শতাংশ সিন্ডিকেট ঋণ বিতরণ করা হয়েছে দেশের অন্যতম রফতানি শিল্প খাতে। এছাড়া বিমান ও পরিবহন খাতের ১২ প্রকল্পে ৬ হাজার ২২ কোটি ৮৫ লাখ টাকার সিন্ডিকেট ঋণ দেয়া হয়, যা মোট ঋণের ৭ দশমিক ৮৭ শতাংশ। খাদ্য, পানীয় এবং কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণ ২৬ প্রকল্পে ঋণ দেয়া হয় ২ হাজার ৩৫৫ কোটি ৩১ লাখ টাকা, যা মোট সিন্ডিকেট ঋণের ৩ দশমিক ৮ শতাংশ। সিমেন্ট ও সিরামিক্স খাতের ২৩ প্রকল্পে ১ হাজার ৯শ’ কোটি টাকার সিন্ডিকেট ঋণ দেয়া হয়, যা মোট ঋণের ২ দশমিক ৪৮ শতাংশ। ওষুধ ও রাসায়নিক খাতের ১৫ প্রকল্পে ১ হাজার ৩৩০ কোটি টাকা দেয়া হয়, যা মোট সিন্ডিকেট ঋণের ১ দশমিক ৭৪ শতাংশ। সেবা খাতের ২১ প্রকল্পে ১ হাজার ৮৩২ কোটি টাকা এবং বিবিধ খাতের ৪১ প্রকল্পে ৫ হাজার ৫৫৮ কোটি ২৬ লাখ টাকার ঋণ দেয়া হয়েছে। যা মোট সিন্ডিকেট ঋণ যথাক্রমে ২ দশমিক ৩৯ শতাংশ ও ৭ দশমিক ২৬ শতাংশ। সিন্ডিকেট ঋণ অনুমোদনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখে প্রধান সমন্বয়ক (লিড এ্যারেঞ্জার) ব্যাংক। বিআইবিএমের গবেষণায় দেখা গেছে, ১৯৯৫-২০১৬ সালের জুন পর্যন্ত মোট সিন্ডিকেট ঋণের ৪৫ দশমিক ৭৩ শতাংশ প্রকল্পের বেশিরভাগই প্রধান সমন্বয়েক ছিল বেসরকারী খাতের ব্যাংকগুলো। এর মধ্যে ১৮ দশমিক ৮৪ শতাংশ প্রকল্পে বেসরকারী খাতের ব্যাংকগুলো এবং ১৭ দশমিক ৩৪ শতাংশ প্রকল্পে সরকারী, বিদেশী ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো প্রধান সমন্বয়ক (লিড এ্যারেঞ্জার) ভূমিকা পালন করেছে। গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা যায়, গত ২০ বছরের বেশি সময়ে প্রধান সমন্বয়ক ব্যাংক হিসেবে বিতরণকৃত মোট ঋণের ৪১ শতাংশ অর্থের যোগান দিয়েছে বিদেশী খাতের ব্যাংকগুলো। পাশপাশি প্রধান সমন্বয়ক হিসেবে ৩৬ শতাংশ অর্থের যোগান দিয়েছে বেসরকারী খাতের ব্যাংকগুলো। আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো দিয়েছে ১৫ শতাংশ অর্থের যোগান এবং সবচেয়ে কম সংখ্যক ৮ শতাংশ অর্থের যোগান দিয়েছে সরকারী খাতের ব্যাংকগুলো।
×