ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ড. আর এম দেবনাথ

‘রেমিটেন্স’ হ্রাস ॥ অতিদারিদ্র্য বিমোচন বিঘ্নিত হবে কি?

প্রকাশিত: ০৩:৫৬, ৭ অক্টোবর ২০১৬

‘রেমিটেন্স’ হ্রাস ॥ অতিদারিদ্র্য বিমোচন বিঘ্নিত হবে কি?

আলোচ্য সপ্তাহে তিন-চারটি অর্থনৈতিক খবর আছে- যা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ‘জিডিপি’র প্রবৃদ্ধি হার, অতিদরিদ্রের সংখ্যা, মূল্যস্ফীতি ও রেমিটেন্সের কথাই আমি বলছি; আমদানি-রফতানির খবরটি থাকলে আরও ভাল হতো, কিন্তু তা নেই। ‘জিডিপি’ প্রবৃদ্ধির অর্জিত হার ৭ দশমিক এক শতাংশ। ২০১৫-১৬ অর্থবছরের এই অর্জিত হারের বিপরীতে সরকার ২০১৬-১৭ অর্থবছরের জন্য লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে ৭ দশমিক ২ শতাংশ। এই মোতাবেকই কাজ চলছে। এর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত দারিদ্র্য হ্রাসের প্রশ্নটি এবং সবার জন্য উন্নয়নের (ইনক্লুসিভ গ্রোথ) বড় মাপকাঠি এটি। বছরের মাত্র তিন মাস গেছে। অর্থাৎ জুলাই, আগস্ট ও সেপ্টেম্বরের কাজ হয়েছে। এটি অক্টোবর মাস। গেল মাসে ঈদ উপলক্ষে বড় ছুটি গেছে। দুর্গাপূজা উপলক্ষে আরেকটি ছুটির আমেজ এই মুহূর্তে বিদ্যমান। এরই ফাঁকে বিশ্বব্যাংক, এডিবি এবং আইএমএফ নামীয় চারটি গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান ‘জিডিপি’ এবং দারিদ্র্য হ্রাসের সম্পর্কে কথা বলা শুরু করেছে। অর্থনীতির সমস্যা ও সম্ভাবনা সম্পর্কে তারা মতামত দিচ্ছে। বিশ্বব্যাংক ’১৫-১৬ অর্থবছরের অর্জিত ‘জিডিপি’র হার নিয়ে খুব বেশি কথা না বলে ২০১৬-১৭ অর্থবছর সম্পর্কে একটা ভবিষ্যদ্বাণী করেছে। তাদের মতে, চলতি অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রা মাফিক ৭ দশমিক ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হবে না। তারা বলছে, প্রবৃদ্ধি হবে বড়জোর ৬ দশমিক ৮ শতাংশ। আরও খারাপ ভবিষ্যদ্বাণী তারা করেছে ২০১৭-১৮ অর্থবছরের জন্য। ঐ বছর প্রবৃদ্ধির হার হবে ৬ দশমিক ২ শতাংশ মাত্র। এবার ভবিষ্যদ্বাণীর ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) এবং আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) মধ্যে বড় বেশি পার্থক্য নেই। বিশ্বব্যাংকের হিসাব হচ্ছে ৬ দশমিক ৮ শতাংশ এবং বাকি দুটি সংস্থার হিসাব হচ্ছে ৬ দশমিক ৯ শতাংশ। আমি প্রবৃদ্ধির হারের ক্ষেত্রে যে ভবিষ্যদ্বাণী করা হচ্ছে সে সম্পর্কে কোন বিতর্কে যাব না। ‘ফলেন পরিচয়তে’- ফলেই পরিচয় পাওয়া যাবে। জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার বাদে আরেকটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ে বিশ্বব্যাংক আলোকপাত করেছে। বিষয়টি আমাদের জন্য জীবন-মরণ সমস্যা-গরিবকে বাঁচানোর সমস্যা। দেখা যাচ্ছে তাদের হিসাবে বাংলাদেশ এই ক্ষেত্রে প্রশংসনীয় ফল দেখিয়েছে। অতিদরিদ্রের সংখ্যা ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ১২ দশমিক ৯ শতাংশে নেমে এসেছে। ২০১০-১১ অর্থবছরে দেশে অতিদরিদ্রের সংখ্যা ছিল ১৭ দশমিক ৪ শতাংশ। এই হিসাবে বর্তমান সরকারের আমলে সাড়ে চার শতাংশ লোক অতিদরিদ্রের খাতা থেকে নাম কাটিয়েছে। এটা বড় সাফল্য। তবে, প্রায় ১৩ শতাংশ লোক কিন্তু সংখ্যার হিসাবে কম নয়। দুই কোটির ওপর। আশা করা যায়, যদি বর্তমান প্রবৃদ্ধি হার অর্জনের গতি অব্যাহত থাকে তাহলে অচিরেই অতিদরিদ্রের সংখ্যা বিলুপ্ত করা সম্ভব হবে। বিশ্বব্যাংকের পর্যালোচনা মতে, দারিদ্র্য নির্র্মূল করতে হলে বছরে গড়ে ৮ দশমিক ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে হবে। আমাদের অর্জনের বর্তমান হার মাত্র ৭ দশমিক ১ শতাংশ। বিশ্বব্যাংক অবশ্য একটা ছাড় দিয়ে আরেকটা হিসাব দিয়েছে। যদি ‘ইনক্লুসিভ গ্রোথ’ নিশ্চিত করা যায় তাহলে জিডিপি অর্জনের হার ৬ দশমিক ১ শতাংশ হলেও চলবে। কিন্তু এখানেই হচ্ছে মুশকিল। আমরা যে উন্নয়ননীতি অনুসরণ করছি তাতে ‘সবার জন্য উন্নয়নের’ কথা বলা হলেও বাস্তবে উন্নয়নের ফসল খেয়ে ফেলছে সমাজের অল্পসংখ্যক মানুষ। গরিবের পাতে পড়ছে খুবই কম। অতএব, বলা যায় ৮ দশমিক ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধিই অর্জন করতে হবে যদি সবার জন্য উন্নয়ন নিশ্চিত করতে চাই। এই কাজটি খুবই কঠিন কাজ। এর জন্য যে বিনিয়োগ দরকার তার কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। আমরা বলেছি উন্নয়ন বা জিডিপি প্রবৃদ্ধির হারের সঙ্গে দারিদ্র্য বিমোচনের একটি বড় সম্পর্ক রয়েছে। আবার দারিদ্র্য বিমোচনে বড় ভূমিকা রাখে ‘রেমিটেন্স’। বাংলাদেশী গরিব কৃষকের সন্তানরা পৃথিবীর প্রচুরসংখ্যক দেশে শ্রমজীবী হিসেবে কাজ করে দেশে টাকা (ডলার) পাঠায়। বস্তুত তাদের পাঠানো অর্থই অর্থনীতির দুই স্তম্ভের এক স্তম্ভ। প্রচার করা হয় গার্মেন্টস রফতানি থেকে প্রাপ্ত ডলারই আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার অন্যতম উৎস বা এক নম্বর উৎস। কিন্তু প্রকৃত হিসাবে তা নয়। গার্মেন্টস রফতানির জন্য প্রচুর কাপড়, তুলা, সুতা, রং, বোতাম ও বক্রম কাপড় আমদানি করতে হয়। গার্মেন্টস শিল্পে বহু বিদেশী কাজ করে। তারা বছরে প্রায় দুই-তিন বিলিয়ন ডলার তাদের স্বস্ব দেশে নিয়ে যায়। গার্মেন্টস মালিকরা রফতানি আয়ের ১৫ শতাংশ বিদেশে খরচ করতে পারেন। এসবের নিরিখে ‘রেমিটেন্সই’ আমাদের প্রধানতম বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের উৎস। প্রায় এক কোটি বাংলাদেশী শ্রমিক বিদেশে কর্মরত। তার অর্থ প্রায় চার কোটি লোক এর সুবিধাভোগী। প্রকৃত হিসাবে বেশি হওয়ার সম্ভাবনা। দেশের যে অঞ্চল থেকে শ্রমিকরা বিদেশে গিয়েছে সে অঞ্চলে দারিদ্র্য নেই। বৃহত্তর সিলেট, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম ও ফরিদপুরের বিস্তীর্ণ এলাকার লোকজন বিদেশে। তাদের অঞ্চলে দারিদ্র্য অনুপস্থিত। ক্যাশ টাকার আমদানি সেখানে বেশি। যে অঞ্চলের লোক বিদেশে যেতে পারেনি তারাই বেশি দরিদ্র। পদ্মার পশ্চিমপারের লোক, রাজশাহী ও রংপুর বিভাগ, খুলনা ও বরিশাল বিভাগের লোকজন অপেক্ষাকৃত অধিকতর দরিদ্র। যাক, যে কথা বলছিলাম প্রবাসীদের পাঠানো টাকা (ডলার) দারিদ্র্য বিমোচনে বড় ভূমিকা রাখছে। এখন দেখা যাচ্ছে সেই রেমিটেন্সে টান পড়ছে। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে পূর্ববর্তী বছরের তুলনায় রেমিটেন্স কম এসেছে; ২ দশমিক ৫৫ শতাংশ। একই প্রবণতা চলতি অর্থবছরেও অব্যাহত। জুলাই-আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে রেমিটেন্স প্রবাহ গেল অর্থবছরের জুলাই-আগস্ট ও সেপ্টেম্বরের তুলনায় কম ছিল, বেশ কম। ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরের তুলনায় ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে রেমিটেন্স হ্রাস পেয়েছে প্রায় ২৩ শতাংশ। উল্লেখ্য, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে প্রচুর শ্রমিক বিদেশে গিয়েছে। এর মানে দাঁড়াচ্ছে, শ্রমিকের সংখ্যা বেশি হওয়া সত্ত্বেও রিমিটেন্স হ্রাস পাচ্ছে। দেখা যাচ্ছে উপসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোতে জিনিসপত্রের দাম বেশ বৃদ্ধি পেয়েছে। এক হিসাবে দেখা যায় নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের দাম সেসব দেশে বেড়েছে প্রায় সাড়ে সাত শতাংশ। এতে প্রবাসী বাংলাদেশীদের দৈনন্দিন খরচ বেড়ে গেছে। সৌদি আরবসহ বহু দেশের সরকার এখন ঘাটতিতে রয়েছে। তাদের ধার-দেনা করতে হচ্ছে। ওসব দেশে বেকার শ্রমিকের সংখ্যা বাড়ছে। সৌদি আরবেই বেকার শ্রমিকের সংখ্যা সাড়ে এগারো শতাংশ। অনেক দেশে শ্রমিকদের চাকরিচ্যুত করা হচ্ছে। সরকার বড় বড় প্রকল্পে অর্থায়ন বন্ধ করে দিয়েছে। মাঝারি ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত। ইউরোপীয় টেকনিক্যাল লোকজন, বিনিয়োগকারীরা মধ্যপ্রাচ্য ছাড়ছে। অনেক দেশ প্রবাসীদের ওপর করারোপ করছে। এসব কারণে প্রবাসীদের আয় কমেছে, অথচ খরচ বেড়েছে। এদিকে দেশে ডলারের বিপরীতে টাকা বেশ শক্তিশালী। কিছু টাকা আবার ‘হুন্ডি’তেও আসে, অবশ্য তা আগেও আসত। অতএব, বড় প্রশ্ন এখন রেমিটেন্স নিয়ে। রেমিটেন্স প্রবাহ ঠিক না থাকলে, রেমিটেন্স প্রবাহ না বাড়লে দেশে দারিদ্র্যের অবস্থা কী দাঁড়াবে তা অতীব জরুরী বিষয় হিসাবে উঠে আসছে। এরই মধ্যে খারাপ খবর আরেকটি। সেটি ‘ব্রেক্সিট’ সম্পর্কিত। যুুক্তরাজ্য ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে গেছে। সম্পূর্ণ মুক্ত হওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হবে ২০১৭ সালের প্রথমার্ধে। এতদিন জোর গুজব ছিল যুক্তরাজ্যের পাউন্ডের দাম পড়ে যাবে। এখন দেখা যাচ্ছে সর্বশেষ খবরে পাউন্ডের দাম ডলারের বিপরীতে পড়ে গেছে। এখন এতে আমাদের সমস্যা কী? যুক্তরাজ্যে আমাদের তৈরি পোশাক যায়। এর দাম পাউন্ডে ‘সেটেল’ হয়। আমাদের বস্ত্রের দাম কমবে। রফতানিকারকরা টাকায় কম অর্থ পাবে। এছাড়া ‘ব্রেক্সিট’ পুরোপুরি কার্যকর হলে একটা নতুন ব্যবসায়িক সম্পর্কের প্রশ্ন উঠবে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে। এটা আরেক অনিশ্চয়তা! অর্থাৎ গার্মেন্টস শিল্প এমনিতেই অনিশ্চয়তার মধ্যে আছে। তার ওপর নতুন করে অনিশ্চয়তার সৃষ্টি হচ্ছে। অধিকন্তু যদি বর্তমানের গ্যাস ও বিদ্যুত সঙ্কট চালু থাকে তাহলে পরিস্থিতি কী দাঁড়াবে তা সহজেই অনুমেয়। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে দরিদ্র এবং অতিদরিদ্রদের বাঁচানোর যে প্রয়াস তা আগামী দিনে বাধাগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তবে শুধু দরিদ্র ও অতিদরিদ্রদের জন্য নয়, দেশের সবার জন্য যে অর্থনৈতিক উন্নয়ন দরকার তার মূল চাবিটি বিনিয়োগের হাতে। বিনিয়োগ বলতে বিদেশী বিনিয়োগ এবং দেশী বিনিয়োগ; উভয়ের কথাই বলছি। এর মধ্যে বেশি গুরুত্বপূর্ণ বেসরকারী বিনিয়োগ। তাদের দাবি ছিল ‘কম সুদ’। এই দাবির সিংহভাগ মেটানো হয়েছে। আমানতকারীদের স্বার্থের হানি করে হলেও ব্যাংকগুলো এক ডিজেটের কাছাকাছি সুদের হার কায়েম করেছে। জায়গার অভাব, গ্যাস ও বিদ্যুতের অভাব অন্যতম সমস্যা। এসব সমস্যা সমাধানের জন্য সরকার এক শ’টি বিশেষ অর্থনৈতিক জোন নির্মাণে হাত দিয়েছে। জাপান, চীন, ভারত, কোরিয়া প্রভৃতি দেশের জন্য বিশেষ জোন তৈরি হচ্ছে। বেশ কয়েকটা বেসরকারী অর্থনৈতিক জোনও তৈরি হচ্ছে। অচিরেই এসব কাজে যাবে। এতদসত্ত্বেও দেখা যাচ্ছে গ্যাস ও বিদ্যুতের বিদ্যমান অবস্থাতে শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এই মুহূর্তে সাভার, আশুলিয়া, টঙ্গী অঞ্চলে গ্যাস নিয়ে তুলকালাম ঘটনা ঘটছে। বিদ্যুতের এত উন্নতি হওয়া সত্ত্বে ঢাকা বাদে সারা দেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে বিদ্যুতের অভাব ঘটছে। গ্রামাঞ্চল, মফঃস্বল শহর ১২ ঘণ্টাও বিদ্যুত পাচ্ছে না। এই সমস্যার দিকে নজর দেয়া দরাকার। কারণ, বিনিয়োগ না বাড়াতে পারলে অতিদরিদ্রের সমস্যার সমাধান করা যাবে না। লেখক : সাবেক শিক্ষক, ঢাবি
×