ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

অজয় দাশগুপ্ত

সিডনির মেলব্যাগ ॥ সুরক্ষা কোথায় আমাদের?

প্রকাশিত: ০৩:৫৪, ৭ অক্টোবর ২০১৬

সিডনির মেলব্যাগ ॥ সুরক্ষা কোথায় আমাদের?

ভেবেছিলাম শারদীয় দুর্গাপূজা নিয়ে লিখব। নানা সমস্যার পরও দেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের মনে ভালবাসা জাগিয়ে আসা এ উৎসব। এখনও কাটেনি আঁধার। এখনও ভয়। তারপরও সবাই মাতোয়ারা হোক। জীবন জাগুক জীবনের নিয়মে। বলছিলাম এই উৎসবের আগেও এত অঘটন কেন? আমরা এত আগ্রাসী জাতি হলাম কবে থেকে? কোন্্কালে যুবক-যুবতীরা প্রেম করেনি? কোন্্কালে মানব-মানবীর চোখে ভাললাগা ছিল না? যেভাবেই বিশ্বাস করি ভালবাসা থেকে ধরণীর সৃষ্টি। আদম ইভ, এডাম ইভ যে নামেই ডাকি না কেন নিষিদ্ধ ফল না খেলে দুনিয়ায় আসত না তারা। তাদের ভেতর মিলন না হলে মানুষ জন্মাত না। আবার এই যে নদী সাগর পাহাড় সমতল সেও আমরা বলি ঈশ্বরের দান। কেমন দান? ভালবাসার। ভালবেসে সৃজন না করলে এত সুন্দর নীল চোখ হতো সাগরের? পর্বত পেত এমন চমৎকার মাথার মুকুট? নদীর জলে ঝর্ণার পায়ে এমন নূপুরের শব্দ দিল কে? সে প্রকৃতি বা বিধাতা যাই বলি না কেন সব এসেছে ভালবাসার হাত ধরে। ভালবাসার মানে জানতাম ঘোরে থাকা। একে অপরের জন্য পাগল হয়ে ওঠা। ভালবাসার জন্য জান কোরবানি মানে ছিল নিজেকে বিলিয়ে দেয়া। কচিৎ দু-একটি আত্মঘাতী ঘটনা ছাড়া ভালবাসা ঘাতক হতে পারে এটা আমরা দেখিনি কখনও। আজ বাংলাদেশের দিকে তাকালেই এর বিপরীত দিকটা চোখে পড়ে। এ লেখা যখন লিখছি খাদিজা তখনও বেঁচে। এই বাঁচাটা তার কাছে মৃত্যুর চেয়েও করুণ। এটা কোন বাঁচা হবে না। আর মরণ? সে তো চাপাতি তাকে জানিয়েই দিয়েছে কত নির্মম হতে পারে আঘাত। খাদিজা এখন আর কোন তরুণীর নাম নয়। সে এখন বাংলাদেশে উন্মাদনা আর হত্যাপ্রবণ উন্মাদ সমাজের নিয়ত শিকার এক তরুণীর মুখচ্ছবি। বদরুল নামের যে ছেলেটি তাকে কুপিয়েছে সেও আজ আর কোন ছেলে বা মানুষের নাম বহন করে না। রাজনীতি সমাজ আর দানবতন্ত্র মিলে ঘরে ঘরে কত বদরুলের পয়দা করেছে কে জানে! কে কখন কোথায় ঘাপটিমেরে আছে আর কাকে ঘায়েল করবে সেটা এখন সময়ের ব্যাপার। এ ঘটনা আমাদের সাময়িকভাবে নাড়া দিলেও এর রেশ বা জের খুব বেশি দিন থাকবে না এটা নিশ্চিত। এখন এমন হয়েছে এ জাতীয় ঘটনা না ঘটলে বরং সবাই উসখুস করতে থাকে। ফেসবুক টুইটার সামাজিক মাধ্যমে সময় হয়ে যায় নিথর। জমে ওঠে না গরম আড্ডা। হট টপিকের অভাবে মাঠে মারা যায় মানুষের লাইক ডিসলাইক। আসলেই এমন ঘটনায় অভ্যস্ত হয়ে গেছে দেশ। হবে নাইবা কেন? এ লেখা লেখার সময় দেখলাম হাসনাত ও তাহমিদকে ৫৪ ধারা থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। ৫৪, ৫৭ এগুলো তো আসলে সংখ্যা। মূল ঘটনা অব্যাহতি। ভিডিও ফুটেজে হাতেনাতে ধরা খাওয়ার পরও যদি হত্যার মতো বীভৎস ঘটনা থেকে কেউ রেহাই পায় বা পেতে পারে সে আইনের অধীনে এসব মামুলি ঘটনা অচিরেই ডুবে যাবে এটাই স্বাভাবিক। গুলশান হত্যাকা- এ দেশের সামাজিক জীবনে সবচেয়ে বড় হত্যাকা-ের ঘটনা এই কারণে যে, এর সঙ্গে আছে উন্মাদনা আর জঙ্গী যোগাযোগ। বিদেশী মেহমানদের মারার পরও যদি সন্দেহভাজনরা এভাবে ছাড়া পায় তাহলে বদরুলরা কি শেখে? এর আগে তারা দেখেছে তনু হত্যা, সাত খুন, রানা প্লাজার ঘটনায় তেমন কিছু হয়নি। মিতু নামের পুলিশ অফিসারের বউকে দিবালোকে খুন করার পরও তা নিয়ে চলছে নানা নাটক। তো খুনী কি বসে থাকবে? এই যে মেয়েটিকে কোপানো হলো তার ভিডিও করল কারা? তাদের কেন আইনের আওতায় আনা হচ্ছে না? তাদের ডবল অপরাধ। এমন নৃশংস ঘটনা তারা ঠা-া মাথায় ভিডিও করতে পেরেছে, আর পুলিশ না ডেকে, এগিয়ে না গিয়ে মারতে সাহায্য করেছে এরা। সামাজিক মিডিয়ায় এর আগেও আমরা এসব ঘটনা দেখেছি। একটি কিশোর ছেলেকে লিকলিকে এক বড় ভাই ইচ্ছামতো মারছিল। তার বন্ধুরা মনের সুখে ভিডিও করছিল আর বলছিল এবার ছাইড়া দে। পথচারীও ছিল কয়েকজন। কেউ ফিরে তাকালেও থামেনি। এসব ঘটনার সামাজিক তাৎপর্য বাদ দিন। মানসিক দিকটা দেখুন। এরাও যদি উন্মাদ না হয়, এদের যদি মানসিক বিকৃতি না থাকে এরা তা করছে কিভাবে। আমরা তো ভিডিওটাও পুরো দেখতে পারি না। আমাদের কারও মাথা ঘোরে, কারও বুক ধড়ফড় করে, কারও মনে অসুখ বেঁধে যায়। আজ বাংলাদেশে সবকিছু রাজনীতি। খবরে যখন যে অপরাধ দেখি তার সঙ্গে সরকারী দলের নাম জুড়ে থাকে। সবটা যেমন সত্য না আবার মিথ্যাও না। সরকারী দলের প্রশ্রয় বড় মারাত্মক। তারা এদের পোষে, পুষে বড় করে। তাতে এককালে মাঠ দখলের কাজ হতো। এখন তো সে দরকার দেখি না। মাঠে কোন প্রতিদ্বন্দ্বী নেই। আর রাজনীতি আজকাল মাঠে হয় না। এখন প্রযুক্তির যুগ। মানুষ বোতাম টিপেই পৌঁছে যায় তার গন্তব্যে। তাকে মাঠে নিয়ে ভাষণ শোনাতে হয় না। কোন খবর বা ঘোষণা জানার জন্য সমাবেশে যাওয়ার দরকার পড়ে না। মিছিল-মিটিং এখন অতীতকালের কাহিনী। মূলত জনসমর্থন বা তাদের পাশে পাওয়াটা মিডিয়ানির্ভর বা প্রযুক্তিনির্ভর। এরকম যুগে এরা ছাত্রলীগের নামে খুন করে, নারী ধর্ষণ করে মেরে পার পেয়ে যাবে এটা কোন্ ধরনের যুক্তি? আসলে আমাদের সমাজে আজ এক ধরনের পাপ বাসা বেঁধেছে। দেখবেন কথায় কথায় আমরা অন্যদের গাল দেই। তাদের সমালোচনা করি। বিশেষত প্রতিবেশী দেশটির ওপর আমাদের বেজায় রাগ। রাগবার কারণও আছে বৈকি। কিন্তু আমরা একবারও ভাবি না সে বঙ্গে কেন এত উত্তেজনা নেই? কেন নেই এত খুন, মারামারি এমন অনাচার। আইনের শাসন ও গণতন্ত্রের ধারা বজায় থাকলে এক সময় মানুষ নিয়ম মানে, নিয়ম মানার সমাজ তৈরি হয়ে যায়। আমাদের দেশে তা ঘটেনি। ঘটবার সম্ভাবনা থাকলেও তাকে প্রায় নিঃশেষ করে আনছি আমরা। আজ যে মেয়েটিকে নিয়ে সমাজ-সংসারে এত হট্টগোল সেটা থেমে যাবে, যেমন থেমে গেছে কিশোরীর আর্তনাদ। থামিয়ে দিয়েছি মায়ের কান্না। বাপের আহাজারি। একটা অশুভ পরিবেশ আজ চারদিকে। উন্নয়নের ধারাকে পায়ে দলে সামনে যেতে চাইছে এই ধারা। এগুলো তার সূচনা, তার ধারাবাহিকতা। কে ঠেকাবে? কারা ঠেকাবে? কেউ জানে না। জানলে আমাদের জানাবেন, আমরাও শামিল হব আপনাদের সঙ্গে। ভালবাসার মতো নরম মৃদুল মায়াবী ঐশ্বর্য এভাবে খুন হয়ে গেলে আমাদের প্রজন্ম বাঁচবে কিভাবে? ভালবাসা তোমাকে আমরা বাঁচাব কিভাবে?
×