ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

নিয়ামত হোসেন

চক্ষু মেলিয়া

প্রকাশিত: ০৩:৫৪, ৭ অক্টোবর ২০১৬

চক্ষু মেলিয়া

তুমি আজ কত দূরে মেরি এবং ক্যাথি ঘনিষ্ঠ বন্ধু। পরিচয় হয়েছিল সেই কবে, যখন দু’জনেই এক ক্লাসে, ক্লাস টেনের ছাত্রী। দু’জনের এমন বন্ধুত্ব হলো যাতে কেউ কাউকে ক্লাসের পরও আরও একবার না দেখে পারে না। এমন বন্ধুত্ব অনেকের মধ্যেই হয়। এতে বিস্ময়ের কিছু নেই। কিন্তু মেরী ও ক্যাথির বন্ধুত্বের ঘটনা এমন পর্যায়ে পৌঁছে যাতে বিশ্ব মিডিয়ার খবরে এসেছে তাদের নাম। ১৯২৯ সালে তাদের পরিচয়। ১৯৩৯ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরুর পাককালে বিয়ে হয়ে যায় ক্যাথির। স্বামীর সঙ্গে সে চলে যায় কনওয়েলে। যাবার সময় দু’জনই কড়ার করে রোজ একটা করে চিঠি লিখতে হবে। একদিনও বাদ যাবে না এবং এই চিঠির কথা কেউ জানবেও না। চিঠিতে থাকবে দুই বান্ধবীর মনের কথা। কথা মতো কাজ- সেই থেকে চিঠি লেখা শুরু। এই বছর মৃত্যু হয়েছে ক্যাথির। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত চিঠি বিনিময় হয়েছে মোট ৫৬,২১০টি। এটা একটা রেকর্ড তাই মিডিয়ার খবর। মেরি এখন একা। বান্ধবীবিহীন তিনি এখনও মনে করেন তার ৭৭ বছরের বান্ধবীর কথা। ভীষণ শূন্যতা ঘিরে ধরেছে তাকে। এই চিঠিই ছিল তার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। চিঠিই ছিল তার ধ্যান-জ্ঞান। এ চিঠিতে জীবনের যাবতীয় কথা তিনি উল্লেখ করেছেন বান্ধবী ক্যাথির কাছে। ক্যাথিও বিপরীতে তাই করেছে। দুই বন্ধুর জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিল এই চিঠি। চিঠির কথা উঠলে মনে পড়ে যায় অনেক কথা। এই কিছুকাল আগেও যোগাযোগের বড় মাধ্যম ছিল পত্র তথা চিঠি। আজকের দিনে এই চিঠির রূপ পাল্টেছে। আগে ছিল হাতের লেখা চিঠি এখন তার বদলে মোবাইল ফোনে এসএমএস- সংক্ষিপ্ত চিঠি বা খবর। বঙ্কিম চন্দ্র বলেছেন, ‘লাঠি তোমার দিন গিয়াছে’। এটা তার যুগ হলে তিনি নিশ্চয়ই বলতেন, ‘চিঠি তোমারও দিন গিয়াছে’। সত্যি বলতে কি চিঠির গেছে এক স্বর্ণ যুগ। সে সময় কে-না লিখেছে চিঠি! যিনি লিখতে পারেন তিনিও লিখেছেন, যিনি পড়ালেখা জানেন না তিনি অন্যকে দিয়ে লিখিয়েছেন। প্রাপক যদি অক্ষর জ্ঞানহীন হন তাহলে তার কাছে আসা চিঠি অন্যকে দিয়ে পড়িয়ে নিয়েছেন। কত চিঠি- খামে পোস্ট কাডে, অনেক সময় হাতে হাতে। তখন চিঠির জন্য ছিল ডাকঘর পিয়ন, চিঠি বহনকারী রানার। কবি সুকান্তর সেই বিখ্যাত লাইন ‘রানার চলেছে তাই ঝুম ঝুম ঘণ্টা বাজছে রাতে’ কবিতা তথা এই কবিতা তথা গানের কথা সবার জানা। তাতে তিনি লিখেছেন ‘কত চিঠি লেখে লোকে/কত সুখে প্রেমে আবেগে-স্মৃতিতে, কত দুঃখে ও শোকে।’ এ তো গেল আমজনতার চিঠি লেখার খবর। দুনিয়ার বিশিষ্টজনেরা অনেকের কাছে অনেক চিঠি লিখেছেন সেগুলো সবার কাছে হয়ে উঠেছে অমূল্য সম্পদের মতো। রবীন্দ্রনাথকে এ ব্যাপারে স্মরণ করতে হয় সবার আগে। যার চিঠির জগত বিরাট। ছিন্নপত্র বাংলা সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। রবীন্দ্রনাথ যে কত চিঠি লিখেছেন তার সংখ্যা সঠিকভাবে হয়ত এখনও নির্ণয় করা যায়নি। কত বিচিত্র বিষয় নিয়ে তার চিঠি তা চিন্তা করা যায় না। তার চিঠি নিয়ে অনেক গ্রন্থের খ- প্রকাশিত হয়েছে। তিনি চিঠি লিখেননি কার কাছে! লিখেছেন বিখ্যাত বিজ্ঞানী আইনস্টাইনকে তেমনি লিখেছেন একজন সাধারণ মানুষকেও। আইনস্টাইন বা অপরাপর বিশিষ্ট মানুষেরা তার কাছে চিঠি লিখতেন। রবীন্দ্রনাথ তার জবাব দিতেন। আবার সাধারণ যে কোন ব্যক্তি রবীন্দ্রনাথকে চিঠি লিখলে সে নির্ঘাত রবীন্দ্রনাথের চিঠি পেত। এ প্রসঙ্গে মজার দু’একটা ঘটনা উল্লেখ করা যেতে পারে। একটা ছোট্ট মেয়ে চিঠি লিখে পাঠাল কবিগুরুর কাছে অভিযোগ করে। একটি বইতে কবির ছড়া পড়ে মেয়েটি সরাসরি কবির কাছে অভিযোগ জানায়- ‘এক শালিকে রাঁধে বাড়ে,/দুই শালিকে খায়; আরেক শালিক না পেয়ে বাপের বাড়ি যায়।’ মেয়েটির অভিযোগ হচ্ছে, কবি লিখেছেন তিনটে শালিকের কথা কিন্তু তার বইতে দেখা যাচ্ছে যে ছবি আছে দুটো শালিক পাখি। কেন এমন হলো? মেয়েটির এ চিঠিরও জবাব দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ, এই বলে যে সত্যি সত্যি ব্যাপারটা ভুল হয়ে গেছে। তিনি মেয়েটিকে আশ্বাস দিয়েছেন, যে শিল্পী ছবিটি এঁকেছেন তাকে তিনি ভুলটি ধরিয়ে দিবেন, যাতে সে আর কখনও ভুল না করে! রবীন্দ্রনাথের এক কবিতায় আছে ‘আজি আসিয়াছ ভুবন ভরিয়া, গগনে ছড়ায়ে এলো চুল/চরণে জড়ায়ে বনফুল।’ তেমনি এক স্থানে আছে ‘এই বেতসের বাঁশিতে পড়ুক তব নয়নের পরসাদ।’ কবিতাটি পড়ে এক পাঠক চিঠি লিখল রবীন্দ্রনাথকে অভিযোগ করে, কবি বেতসের বাঁশি কোথায় পেলেন? বেতস তো বেত। বেত তো ফাঁপা নয় নিরেট, তাঁর বাঁশি হয় কি করে! অতএব কবি ভুল লিখেছেন। এরও উত্তর দিলেন কবি। তিনি লিখলেন ‘তুমি কোন কৃপণ অভিধানের দোহাই পেড়ে আমাকে গালি দিয়েছো বুঝতে পারলাম না। বেতস মানে যে এক ধরনের সরু বাঁশ সেটাও অভিধানে থাকা উচিত ছিল। অতএব বেতস শুধু বেত নয়, সরু বাঁশও। রবীন্দ্রনাথের বিখ্যাত বই ‘রাশিয়ার চিঠি’ সে দেশে গিয়ে তিনি তাঁর ছেলে ও বউমাকে যে সব চিঠি লিখেছেন সে চিঠিগুলোরই সংকলন এ বইটি। এটিও সাহিত্যের এক বিখ্যাত সম্পদ, ঐতিহাসিক দলিলও। তবে সাধারণভাবে চিঠির কথা উঠলে যে বিষয়টি মনে না পড়ে পারে না, সেটা হচ্ছে, ‘তুমি আজ কত দূরে/আঁখির আড়ালে চলে গেছ তবু রয়েছো হৃদয়জুড়ে।’ বাংলা ভাষাভাষী কয়েক প্রজন্মের মানুষের অত্যন্ত প্রিয় এ গান। গেয়েছেন যিনি তিনিও গানের সঙ্গে অমর হয়ে রয়েছেন। তিনি সুরসাগর জগন্ময় মিত্র। এই চিঠির যুগ এখন দূরস্মৃতির মতো। কোথায় যেন হারিয়ে গেল! চিঠির ঐ গানের মতই বলতে হয় তুমি আজ কত দূরে। ক্যাথি চলে গেছেন স্মৃতিভারে পড়ে আছেন বান্ধবী মেরি। এখন তারও মনের কথা হয়ত: তুমি আজ কত দূরে। বাঘের মাসির গল্প চমৎকার চাকরি করছে একটি বিড়াল। বয়েস তার ৯ বছর। কিসের চাকরি? রিসেপশনিস্ট কাম দারোয়ান কাম আরও অনেক কিছু। দক্ষতার সঙ্গে কাজ করে চলেছে সে। তার মানুষ সহকর্মীদের সবার প্রশংসা ও আদর পাচ্ছে প্রতিনিয়ত। তাই দিন দিন তার কাজে উন্নতি হচ্ছে, অর্থাৎ বাড়ছে দক্ষতা। সবাই তাতে খুশি। নিউইয়র্কের নিউ টাউন অঞ্চলের এক বিপণি বিতানে চাকরি করছে এই বিড়ালটি। সবকিছুর ওপর সারাক্ষণ নজর তার। ওদেশে না বলে কেউ কিছু নিলে ধরা পড়ে যাবে। যাতে কেউ কোনভাবেই হাত সাফাই করে কিছু জিনিস লোপাট করতে না পারে সেটা তাকে দেখতে হয়। দরজা খুলে কোন ক্রেতা তথা খরিদ্দার এলেই শুনবেন মিহি গলার স্বাগত বাণী : ‘ম্যাঁও’! কেউ কিছু কিনতে যদি তাঁদের নিজেদের পোষা প্রাণীকে সঙ্গে নিয়ে আসেন, তাহলে সেগুলোরও দেখাশোনার দায়িত্ব এই বিড়ালটির। ভালভাবে সে দায়িত্ব পালন করে চলেছে সে। সেজন্য খরিদ্দারদেরও ভালবাসায় সিক্ত হয় সে। বিড়ালটি দেখতেও সুন্দর। নামটাও তার মিষ্টি। নাম তার বোবো। নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে সে নজর কেড়েছে সবার। বিড়ালদের লোকে ছিঁচকে টাইপের চৌর্যবৃত্তের প্রাণী বলে মনে করে। কারও বাড়িতে ঢুকে হাঁড়ির ঢাকনা ফেলে দুধের সর খেয়ে সটকে পড়া অথবা রান্নার মাছ মুখে করে চম্পট দেয়া- এটা তাদের প্রধান কাজ বলে সবার জানা। এদের নিয়ে কবি নজরুলের বিখ্যাত একটি হাসির গান রয়েছে: ‘হুলো রে তুই রাত-বিরেতে ঢুকিস নে হেঁসেল/কবে বেঘোরে প্রাণ হারাবি বুঝিসনে রাস্কেল!’ নিউইয়র্কের ঐ বোবোটির ঘটনায় বোঝা গেল একটু ভাল কাজকর্ম পেলে ওরা চৌর্যবৃত্তি ছেড়ে মানুষের একটু কাজেও লাগতে পারে। তাহলে চুরির দায়ে ঠ্যাঙানি খাওয়া থেকে বাঁচতে পারে তারা।
×