ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

সাজ সাজ রব শাঁখারীবাজারে

ঐতিহ্যবাহী শাঁখা শিল্পের নিদর্শন, মাঙ্গলিক সামগ্রীর পসরা

প্রকাশিত: ০৫:৪৮, ৬ অক্টোবর ২০১৬

ঐতিহ্যবাহী শাঁখা শিল্পের নিদর্শন, মাঙ্গলিক সামগ্রীর পসরা

মোরসালিন মিজান ॥ শাঁখারীবাজারে অনেকেই গিয়েছেন। তা যান। পুজোয় গিয়েছেন কী? পুজো সামনে রেখে যাওয়া হয়েছে কখনও? উত্তর ‘না’ হলে এখন একবার ঘুরে আসুন। সরু গলি। সরু-ই আছে। ঘরগুলো একইরকম ছোট। কিন্তু জায়গাটি ঘিরে উৎসবের বিপুল বর্ণাঢ্য আয়োজন। সর্বত্রই একটা সাজ সাজ রব। হরেকরকম পণ্যের পসরা সাজিয়েছেন দোকানিরা। শাঁখারীবাজার যেহেতু, শাঁখা গড়া হয়েছে সবচেয়ে বেশি। শঙ্খ আছে। ঐতিহ্যবাহী কাসা পিতল শিল্পের নিদর্শন বিভিন্ন দোকানে। শোলা শিল্পও বাদ যায়নি। প্রতিমা সাজানোর শাড়ি গহনা মুকুট- সবই তৈরি হচ্ছে চোখের সামনে। কত কত শিল্পী! তাদের সৃজনশীলতা মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখে। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত হতে পূজারীরা আসছেন। বিচিত্র কেনা-বেচা। খুঁটিয়ে দেখলে অবাক হতে হয়। শাঁখারীদের কথাই আগে বলা চাই। বিশেষ এ পেশার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কারিগররা এখানে বহুকাল ধরে একত্রে বসবাস করছেন। ইতিহাসবিদদের মতে, সতেরো শতকে মুঘলদের সঙ্গেই ঢাকায় আসেন শাঁখারীরা। সেই থেকে এখনও একই জায়গায় আছেন। পারিবারিক পেশা ধরে রেখেছেন অনেকেই। শাঁখারীদের মতে, শঙ্খ অসুর নামে এক দানবকে অগস্ত্য মুনি হত্যা করেছিলেন। হত্যায় ব্যবহার করেছিলেন যে ধরনের করাত, সে ধরনের করাত দিয়ে শাঁখারীরা শাঁখা কাটতেন। এখন মেশিনে হয় কাজ। সামনে পুজো। তাই ট্রাঙ্কভর্তি শাঁখা। গ্লাস শোকেসেও সাজিয়ে রাখা হয়েছে। রাস্তার দুই ধারে বেশ কয়েকটি দোকান। লক্ষ্মী ভা-ার নামের একটি দোকানের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় দাঁড়াতে হলো। দেখেই বোঝা যায়, কালের সাক্ষী। ঘরের ভেতরের রূপটিও অভিন্ন বার্তা দেয়। মেঝে থেকে সামান্য উঁচুতে একটি চৌকি পাতা। চৌকির উপর ট্রাঙ্ক। একটি খোলা বাক্স। খোলা বাক্সে বিভিন্ন ডিজাইনের শাঁখা। কয়েক জোড়া চৌকির উপর গড়াগড়ি খাচ্ছিল। সেগুলো সামনে নিয়ে বসেছিলেন দোকানের মালিক অমিয় কুমার সুর। এক পরিবারের চার নারী সদস্য তার কাস্টমার। প্রত্যেকের হাতে শাঁখা পরিয়ে দিচ্ছিলেন। খুলছিলেন। বার বার। কাস্টমার নিয়ে ব্যস্ত। তাই কথা বলার তেমন আগ্রহ দেখাচ্ছিলেন না। এরপরও যা জানা গেল তা বিস্ময়কর বৈকি। দোকানটির বয়স নাকি ৬০ থেকে ৭০ বছর! আগে তিনি নিজে কাজ করতেন এখন কারিগররা করেন। বললেন, সারা বছর কম বেশি বিক্রি হয়। এখন তো পুজোর সময়। তাই বিক্রি ভাল। প্রায় সমান বয়সের আরেকটি দোকান মা মনসা শঙ্খ শিল্পালয়। এখানেও ব্যাপক ভিড়। জানা গেল, মালিকের নাম সদানন্দ নাগ। ৬০ বছর ধরে এই পেশায় আছেন। তার ছেলে বসেছিলেন দোকানে। বললেন, গত কয়েক মাস ধরে রাত-দিন কাজ করছি। পুজোর দিন পর্যন্ত বিক্রি চলবে। তবে শাঁখারীবাজারে এখন আর শুধু শাঁখা বিক্রি হয় না। নানা রকমের পণ্য। সবই পুজোর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। বিভিন্ন দোকান ঘুরে দেখা গেল, বিশালাকার মুকুট গড়ার কাজ হচ্ছে। জরি পুঁতি পাথর বসানো মুকুট ঝলমল করছে। মা বাসন্তী ভা-ার নামের একটি দোকানে গিয়ে দেখা গেল, পাঁচ-ছয়জনের মতো কারিগর। সবাই ব্যস্ত। চোখের সামনে কাগজ কাটছে। তার উপর আঠা দিয়ে পুঁতি পাথর জরি বসানোর কাজ করছেন। দেখতে দেখতেই তৈরি হয়ে যাচ্ছে মুকুট। দোকানের মালিক শঙ্কর সরকার নিজেও মুকুট গড়ার কাজ করছিলেন। বললেন, এসব মুকুট বিভিন্ন প্রতিমার মাথায় পরানো হয়। ডিজাইনের যেমন ভিন্নতা আছে, তেমনি আছে নামের পার্থক্য। বাংলা চূড়া, ওরিয়েন্টাল, লক্ষ্মী বাংলা- কত কত নাম! দূর দূরান্ত থেকে লোকজন কিনে নিয়ে যান। এখন চাহিদা প্রচুর। গত তিন মাস ধরে দিন-রাত কাজ করছেন বলে জানান তিনি। বিভিন্ন দোকানে আবার বাহারি শাড়ি। গহনা। দোকানিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, এগুলোও প্রতিমার গায়ে পরানো হবে। পোশাক ঘর নামের একটি দোকানভর্তি শাড়ি। চুমকি, কারচুপি, সুতার সুন্দর কাজ করা। দোকানের মালিক স্বপন জানালেন, শাড়িগুলো বিভিন্ন মাপের। প্রতিমার মাপ অনুযায়ী কেটে বিক্রি করা হয়। পুজোর সামগ্রীও চাই। সেন ব্রাদার্স নামের একটি দেকানে পুজোর সামগ্রী। সবই কাসা পিতলের। দোকানি বরুণ সেন জানালেন, পুজোর যত রকমের মাঙ্গলিক সামগ্রী প্রয়োজন হয়, সবই তাদের আছে। ছোট্ট বাজারে ক্রেতাও অনেক। হৈ হুল্লোড় লেগেই আছে। তারও বেশি উৎসবের আমেজ। দুর্গোৎসবের আগেই উৎসবের রংটা ছড়িয়ে দিচ্ছে শাঁখারীবাজার।
×