ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

কোন উন্নতি নেই খাদিজার, স্বীকার করে জবানবন্দী দিয়েছে বদরুল

প্রকাশিত: ০৫:৩৫, ৬ অক্টোবর ২০১৬

কোন উন্নতি নেই খাদিজার, স্বীকার করে জবানবন্দী দিয়েছে বদরুল

সালাম মশরুর, সিলেট অফিস ॥ সিলেটে ছুরিকাঘাতে গুরুতর আহত কলেজছাত্রী খাদিজা বেগম নার্গিসের অবস্থার উন্নতি হয়নি। রাজধানীর পান্থপথের স্কয়ার হাসপাতালে ৭২ ঘণ্টার পর্যবেক্ষণে রয়েছেন খাদিজা। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ইতোমধ্যেই ১২ ঘণ্টা পার হয়েছে। অবস্থার উন্নতি হয়নি। আরও ৪৮ ঘণ্টা পর জানা যাবে খাদিজার সর্বশেষ অবস্থা। তবে চিকিৎসকরা বলেছেন, খাদিজা এখন জীবনমৃত্যুর সন্ধিক্ষণে রয়েছেন। বেঁচে থাকার আশা ক্ষীণ হয়ে আসছে। খাদিজার এমন পরিস্থিতিতে সিলেটজুড়ে চলছে বিক্ষোভ। আর খাদিজার পরিবারে চলছে শোকের মাতম। সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ শাখার বহিষ্কৃত সহসাধারণ সম্পাদক বদরুল আলম হত্যাচেষ্টার দায় স্বীকার করে সিলেট আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দী দিয়েছে। বদরুলের গ্রামের বাড়ির অনেকেই লোকলজ্জার ভয়ে আত্মগোপনে চলে গেছেন। বাড়ি লক্ষ্য করে থু-থু ছিটিয়ে ও ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে ঘৃণা প্রকাশ করেছেন বিক্ষুব্ধ গ্রামবাসী। এদিকে খাদিজাকে স্কয়ার হাসপাতালে দেখতে যান বন ও পরিবেশমন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু। তিনি খাদিজা ও তার পরিবারকে সব ধরনের সহায়তা করার কথা বলেছেন। গত ৩ অক্টোবর সোমবার বিকেলে দ্বিতীয় বর্ষের পরীক্ষা দিয়ে সিলেট সরকারী মহিলা কলেজের ছাত্রী খাদিজা বেগম নার্গিস বাড়ি ফেরার পথে হামলার শিকার হন। এমসি কলেজের পুকুরপাড়ে খাদিজাকে ধাক্কা দিয়ে মাটিতে ফেলে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে গুরুতর জখম করে বদরুল আলম। নৃশংস কায়দায় কোপানোর সেই দৃশ্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে দেশজুড়ে তোলপাড় শুরু হয়। হত্যাচেষ্টার সময় খাদিজার চিৎকারে স্থানীয়রা এগিয়ে এলে বদরুল পালানোর চেষ্টা করে; কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। জনতার হাতে ধরা পড়ে গণধোলাইয়ের শিকার হয় সে। পরে জনতা তাকে পুলিশে সোর্পদ করে। খাদিজাকে দ্রুত সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে অবস্থার অবনতি হলে সোমবার মধ্যরাতেই তাকে রাজধানীর পান্থপথের স্কয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। হাসপাতালের নিউরোসার্জারি বিভাগের চিকিৎসক এ এম রেজাউস সাত্তারের অধীনে খাদিজার চিকিৎসা চলছে। ভর্তির পর থেকেই কয়েক দফায় অস্ত্রোপচার করা হয় খাদিজার শরীরে। বর্তমানে খাদিজা ৭২ ঘণ্টার পর্যবেক্ষণে রয়েছেন। হাসপাতালের দায়িত্বশীল চিকিৎসকরা সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, খাদিজার মাথায় গুরুতর আঘাত লেগেছে। মাথার খুলি ভেদ করে ব্রেইনে ইনজুরি হয়েছে। সেটার অপারেশন হয়েছে। হামলার সময় খাদিজা হাত দিয়ে হামলা ঠেকাতে চেষ্টা করায় তার হাতেও গভীর ক্ষত হয়েছে। খাদিজার অবস্থার তেমন কোন উন্নতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। তারপরও চেষ্টা অব্যাহত আছে। তার অবস্থা খুবই সঙ্কটাপন্ন। খাদিজার অবস্থা খুবই খারাপ। বাঁচার আশা খুবই ক্ষীণ। তারপরও খাদিজাকে বাঁচানোর জন্য প্রাণান্তকর চেষ্টা করছেন চিকিৎসকরা। খাদিজাকে ৭২ ঘণ্টার পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে। ইতোমধ্যেই ১২ ঘণ্টা পার হয়েছে। তবে অবস্থার কোন উন্নতি হয়নি। আরও ৪৮ ঘণ্টা পরই জানা যাবে খাদিজার প্রকৃত অবস্থা। খাদিজাকে হত্যাচেষ্টাকারী বদরুলকে বুধবার দুপুরে সিলেট আদালতে হাজির করে মামলাটির তদন্তকারী সংস্থা সিলেটের শাহপরাণ থানা পুলিশ। আদালতে বদরুল ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দেয়। অতিরিক্ত মহানগর মুখ্য হাকিম শারাবান তহুরার আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দেয় বদরুল। জবানবন্দীতে প্রেমের টানাপোড়েনে সে এ কাজ করে বলে স্বীকার করেছে। জবানবন্দী শেষে কড়া পুলিশ প্রহরায় বদরুলকে আদালত থেকে সিলেট জেলা কারাগারে পাঠানো হয়। সিলেটজুড়ে বিক্ষোভ ॥ খাদিজাকে কুপিয়ে হত্যাচেষ্টাকারী বদরুল আলমের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন স্থানে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ সমাবেশ করেছেন সিলেটের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষ। জেলার সদর উপজেলার টুকেরবাজার তেমুখীতে মানববন্ধন করেছেন স্থানীয়রা। বুধবার দুপুরে ‘সদর উপজেলার সচেতন নাগরিকবৃন্দ’র ব্যানারে আয়োজিত এ মানববন্ধনে একই কাতারে দাঁড়িয়ে বদরুলের শাস্তির দাবি জানান আওয়ামী লীগ-বিএনপির নেতারা। মানববন্ধনে বক্তারা বলেন, ছাত্র নামধারী বখাটে নরপশু বদরুল আলমকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। তাকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিলে ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা ঘটাতে অন্য কেউ দ্বিতীয়বার ভাববে। কিন্তু তার শাস্তি যদি নিশ্চিত না হয়, তবে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটবে। মানববন্ধনে সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি বদর উদ্দিন কামরান, সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শফিকুর রহমান চৌধুরী, সিলেট জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আলী আহমদসহ বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ উপস্থিত ছিলেন। সিলেট সরকারী মহিলা কলেজের শিক্ষক শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ ॥ খাদিজাকে হত্যাচেষ্টাকারী বদরুলের ফাঁসির দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল ও সড়ক অবরোধ করেছেন তার সহপাঠীরা। বুধবার সকাল ১০টায় কলেজ ক্যাম্পাস থেকে মিছিল বের করে নগরীর প্রধান প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ করে পুনরায় কলেজ ক্যাম্পাসের সামনের সড়কে এসে অবস্থান নেন তারা। এ সময় তাদের হাতে বদরুলের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবি সংবলিত বিভিন্ন ধরনের প্ল্যাকার্ড শোভা পাচ্ছিল। তাদের কণ্ঠে ‘ফাঁসি’ ‘ফাঁসি’ সেøাগানে মুখর হয়ে উঠে পুরো এলাকা। বিভিন্ন শ্রেণীর সাধারণ মানুষকেও তাদের বিক্ষোভে একাত্ম হতে দেখা যায়। এ সময় তাদের অবরোধের কারণে চৌহাট্টা-জিন্দাবাজার সড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। ঘণ্টাব্যাপী সড়কে অবস্থানের পর কলেজের শিক্ষকদের আশ্বাসের প্রেক্ষিতে আন্দোলনরত খাদিজার সহপাঠীরা রাস্তা ছেড়ে ক্যাম্পাসের ভেতরে চলে যায়। একই দাবিতে জেলা প্রশাসক বরাবর স্মারকলিপিও দিয়েছেন শিক্ষার্থীরা। সিলেট সরকারী মহিলা কলেজের শিক্ষার্থী ও এ আন্দোলনের আহ্বায়ক ফজিলাতুন্নেসা বলেন, আমরা নিরাপত্তাহীনতা বোধ করছি। আমাদের মা-বাবা আমাদের স্কুল-কলেজে পাঠান; আসলে কি সেখানে আমরা নিরাপদ। কোপানোর সংস্কৃতি আজ কলেজে ঢুকে গেছে। আর কত খাদিজা আঘাত পেলে আমরা নিরাপত্তা পাব। বৃহস্পতিবার সিলেটের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের নিয়ে বিক্ষোভ সমাবেশ সফল করার জন্য তিনি আহ্বান জানান। সিলেট সরকারী মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ ড. মোহাম্মদ নুরুল ইসলাম বলেন, প্রকাশ্যে দিবালোকে একটা ক্যাম্পাসে এ ধরনের হামলা বর্বরতম। এমন ঘটনা মেনে নেয়া যায় না। হামলাকারীর দৃষ্টান্তমূলক বিচার চাই আমরা। শাবিপ্রবি ছাত্রলীগের বিক্ষোভ ॥ সিলেটের এমসি কলেজ ক্যাম্পাসে সংঘটিত নৃশংসতার ঘটনায় শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগকে জড়ানোয় এর প্রতিবাদ করেছে শাখা ছাত্রলীগ। এ উপলক্ষে বুধবার দুপুর ২টায় শাবি প্রেসক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলন করে তারা। সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন সভাপতি সঞ্জীবন চক্রবর্তী পার্থ এবং সাধারণ সম্পাদক ইমরান খানসহ সিনিয়র নেতাকর্মীরা। লিখিত বক্তব্যে সঞ্জীবন চক্রবর্তী পার্থ বলেন, সন্ত্রাসী বদরুল আলমের এই নৃশংসতা একান্তই তার ব্যক্তিগত। এ অপরাধের দায়ভার কোনভাবেই শাবি ছাত্রলীগের ওপর আসতে পারে না। জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের বিক্ষোভ ॥ সিলেট এমসি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ ছাত্রদল এক যুক্ত বিবৃতিতে সরকারী মদদে ছাত্রলীগ সন্ত্রাসীরা তাদের কু-কর্মের দ্বারা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে অপবিত্র করে তুলছে। শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাস সৃষ্টি করে শিক্ষার স্বাভাবিক পরিবেশ বিঘিœত করা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এসব নোংরামি সভ্য সমাজের পরিপন্থী এবং তাদের রাজনৈতিক দেউলিয়াপনার পরিচয়। এমন ঘটনায় হতবাক খাদিজার গ্রামবাসী ॥ সিলেট শহরতলীর হাউসা গ্রামের সৌদিপ্রবাসী মাসুক মিয়ার মেয়ে কলেজছাত্রী খাদিজা আক্তার নার্গিসকে কয়েক বছর ধরে উত্ত্যক্ত করে আসছে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সহসাধারণ সম্পাদক বদরুল আলম। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এ ঘটনার আগে ২০১২ সালের ১৩ জানুয়ারি মহানগর পুলিশের জালালাবাদ থানার ‘জাঙ্গাইল সফির উদ্দিন স্কুল এ্যান্ড কলেজে’ গিয়ে খাদিজাকে উত্ত্যক্ত করে বখাটে বদরুল। এ কারণে খাদিজার স্বজনরা তাকে ধরে গণপিটুনিও দিয়েছিলেন। তখন বদরুল বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে খাদিজার পরিবারের লোকজনসহ এলাকার বেশ কয়েকজন ছাত্রের বিরুদ্ধে মামলা করে। খাদিজার চাচা আবদুল কুদ্দুস জানান, ৭-৮ বছর আগে খাদিজাদের বাড়ি লজিংমাস্টার হিসেবে থাকত বদরুল। এরপর থেকে সে খাদিজাকে বিভিন্ন সময় উত্ত্যক্ত করে আসছিল। তার আচরণের কারণে তাকে লজিংমাস্টার থেকে বের করে দেয়া হয়। এরপরও মেয়েটির পিছু ছাড়েনি বখাটে বদরুল। বদরুলের সহপাঠীরা জানান, ২০০৮-০৯ শিক্ষাবর্ষে সে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। তার সহপাঠীদের বিশ্ববিদ্যালয়ের কোর্স বেশ আগেই শেষ হয়েছে। তবে সে এখনও কোর্স শেষ করতে পারেনি। বদরুলের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকা-ের অভিযোগ রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সহসম্পাদকের দায়িত্ব পাওয়ার পর সে আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে। বদরুল বর্তমানে শাবির শাহপরাণ হলে থেকে লেখাপড়া করত। খাদিজার ওপর হামলার ঘটনা নিয়ে গ্রামবাসী ক্ষুব্ধ। ওই গ্রামের কয়েক বাসিন্দা জানান, শিক্ষা-দীক্ষায় এ গ্রাম অনেকটা পিছিয়ে। কিন্তু নার্গিসদের পরিবারের লোকজন সবাই শিক্ষিত। প্রবাসে থাকা মাসুক মিয়া অনেক কষ্ট করে জীবনের সব সঞ্চয় দিয়ে সন্তানদের পড়ালেখা চালিয়ে নিচ্ছেন। তার তিন ছেলে ও এক মেয়ে। বড় ছেলে শাহিন আহমদ চীনে লেখাপড়া করছেন। নার্গিস কলেজে পড়েন। এলাকার লোকজন এ ঘটনায় হতবাক। তাদের একটাই দাবি ফাঁসি দিতে হবে ওই জঘন্য অপরাধীকে। বদরুলের বাড়িতে থু-থু ও ইটপাটকেল নিক্ষেপ ॥ হত্যাচেষ্টাকারী বদরুল আলমের বাড়ি সুনামগঞ্জ জেলার ছাতক উপজেলার সুনাইঘাতী গ্রামে। পিতার নাম সাইদুর রহমান। বদরুলের এমন কর্মকা-ে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছেন গ্রামবাসী। তারা বাড়ির বাসিন্দাদের নানা কথাবার্তায় ভর্ৎসনা করছেন। বাড়ির অনেক বাসিন্দাই লোকলজ্জার ভয়ে আত্মগোপনে চলে গেছেন। বাড়িটি লক্ষ্য করে অনেকেই ঘৃণা আর ক্ষোভে ইটপাটকেল থু-থু নিক্ষেপ করছেন।
×