ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

জনপ্রতিনিধি ও ডিলারদের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী

দশ টাকার চাল বিতরণে অনিয়ম হলে কঠোর ব্যবস্থা

প্রকাশিত: ০৫:৩৩, ৬ অক্টোবর ২০১৬

দশ টাকার চাল বিতরণে অনিয়ম হলে কঠোর ব্যবস্থা

সংসদ রিপোর্টার ॥ প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা শেখ হাসিনা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি ও ডিলারদের উদ্দেশে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছেন, যতদিন প্রয়োজন হবে ততদিন দেশের হতদরিদ্রের মধ্যে ১০ টাকা কেজি করে চাল বিতরণ কর্মসূচী অব্যাহত থাকবে। তবে এই চাল বিতরণ এবং হতদরিদ্রের তালিকা প্রণয়নে কোন অনিয়ম বা গরমিল সহ্য করা হবে না। চাল বিতরণে অনিয়ম পাওয়া গেলে ডিলারদের ডিলারশীপ বাতিল এবং তালিকা প্রণয়নে কোন গরমিল বা অনিয়ম পাওয়া গেলে জড়িত নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের বিরুদ্ধেও কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। এ ব্যাপারে সকল সংসদ সদস্য এবং দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকারী কর্মকর্তাদের স্ব স্ব এলাকায় তালিকা যাচাই-বাছাই ও অনিয়ম খুঁজে বের করার নির্দেশ দেন তিনি। স্পীকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে বুধবার জাতীয় সংসদে প্রধানমন্ত্রীর জন্য নির্ধারিত ত্রিশ মিনিটের প্রশ্নোত্তর পর্বে সরকারী দলের সংসদ সদস্য মীর শওকত আলী বাদশার এক সম্পূরক প্রশ্নের জবাবে শেখ হাসিনা এ হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন। তিনি বলেন, দেশের মানুষ হতাশা থেকে এখন আলোর মুখ দেখতে শুরু করেছে। দেশের মানুষকে বঞ্চনা থেকে মুক্ত করে তাদের জীবনকে হাসি-খুশিতে ভরে দেয়া এবং বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়ে তোলাই আমার একমাত্র লক্ষ্য। ব্যথার পাথর বুকে নিয়ে চলছি একটাই লক্ষ্য নিয়ে তা হচ্ছে মানুষের মুখে হাসি ফোটানো। আর দেশ থেকে যেভাবে দারিদ্র্য দূর হচ্ছে, মানুষের আর্থিক সক্ষমতা তৈরি হচ্ছে- ইনশাআল্লাহ ভবিষ্যতে আর কাউকে সাহায্য দেয়ার প্রয়োজন পড়বে না। এক সম্পূরক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে ১০ টাকা কেজি করে চাল দেয়ার কোন প্রতিশ্রুতি ছিল না। ’৯৬ সালের আগে নির্বাচনী বক্তৃতায় আমি ১০ টাকা কেজি চালের কথা বলেছিলাম। তিনি বলেন, ’৯৬ সালে ৪০ লাখ মেট্রিক টন খাদ্য ঘাটতি নিয়ে ক্ষমতা গ্রহণ করেছিলাম। মাত্র ৫ বছরে খাদ্য ঘাটতি পূরণ করে দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করেছিলাম। ক্ষমতা ছাড়ার সময় ২৬ লাখ মেট্রিক টন খাদ্য উদ্বৃত্ত রেখে গিয়েছিলাম। কিন্তু ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় এসে আবারও দেশকে খাদ্য ঘাটতির দেশে পরিণত করে। ২০০৯ সালে যখন ক্ষমতা গ্রহণ করি তখনও দেশে খাদ্য ঘাটতি ছিল ৩৫ লাখ মেট্রিক টন। পরবর্তীতে আবারও দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করার পাশাপাশি এখন বাংলাদেশ খাদ্য রফতানির সক্ষমতাও অর্জন করেছে। ১০ কেজি করে চাল প্রদান সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, প্রতি পাঁচশ’ জনের জন্য একজন করে ডিলার নিয়োগ করা হয়। ইউপি চেয়ারম্যানসহ নির্বাচিত প্রতিনিধিরা হতদরিদ্র্যদের তালিকা তৈরি করে। এই তালিকায় যদি কোন সক্ষম মানুষের নাম উঠে অবশ্যই তা বাদ দিতে হবে। এক্ষেত্রে সকল এমপিকে এবং এ কাজে জড়িত সরকারী কর্মকর্তাদের প্রতি অনুরোধ করব- স্ব স্ব এলাকায় এসব তালিকা পরীক্ষা করুন। কোন অনিয়ম বা গরমিল ধরা পড়লে অবশ্যই জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। ইস্রাফিল আলমের সম্পূরক প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে সরকার প্রধান আরও বলেন, ১০ কেজি করে চাল প্রদানের কর্মসূচী দীর্ঘদিন চালু থাকবে। আওয়ামী লীগ যখনই ক্ষমতায় আসে তখনই দরিদ্র্যবান্ধব কর্মসূচী নেয়। এ প্রসঙ্গে তিনি ’৯৮ সালের ভয়াবহ বন্যার কথা উল্লেখ করে বলেন, দীর্ঘস্থায়ী ওই বন্যার সময় দেশের ৭০ ভাগ এলাকা পানির নিচে চলে গিয়েছিল। তখন বিবিসি, বিশ্বব্যাংকসহ অনেক আন্তর্জাতিক সংস্থা তখন বলেছিল- ২ কোটি লোক না খেয়ে মারা যাবে। আমরা বলেছিলাম একটি লোকও না খেয়ে মারা যাবে না। বন্যার সময় এবং পরবর্তী দীর্ঘ ৯ মাস পর্যন্ত আমরা ৫৫ লাখ মানুষের কাছে বিনামূল্যে ২০ কেজি করে চাল পৌঁছে দিয়েছিলাম। তাই যতদিন প্রয়োজন পড়বে ততদিন এ কর্মসূচী অব্যাহত থাকবে। ‘শেখ হাসিনার বাংলাদেশ, ক্ষুধা হবে নিরুদ্দেশ’ ॥ সরকারী দলের সংসদ সদস্য ইস্রাফিল আলমের প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী জানান, আওয়ামী লীগ যখনই নির্বাচিত হয়ে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব পেয়েছে তখনই জনগণ বিশেষ করে দরিদ্র্য জনগোষ্ঠীর কল্যাণে কাজ করেছে। আমাদের সরকারের দরিদ্র্যবান্ধব কর্মসূচী প্রান্তিক জনগণের জন্য নিবেদিত। এ লক্ষ্যে সারাদেশে ইউনিয়ন ও গ্রাম পর্যায়ে গ্রামীণ জনপদের অতিদরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য চলতি বছরের সেপ্টেম্বর থেকে প্রতিকেজি ১০ টাকা করে কার্ডের মাধ্যমে খাদ্যশস্য বিতরণ কার্যক্রম চালু করেছি। এ প্রসঙ্গে সংসদ নেতা আরও জানান, ইউনিয়ন পর্যায়ের জনগোষ্ঠীর জন্য স্থানীয় কমিটির মাধ্যমে ৫০ লাখ পরিবারকে কার্ড প্রদান করে কার্ড প্রতি প্রতিবছর সেপ্টেম্বর থেকে নবেম্বর এবং মার্চ-এপ্রিল এই ৫ মাস প্রতিমাসে ৩০ কেজি করে চাল বিক্রির কার্যক্রম চালু করা হয়েছে এবং এ কর্মসূচী দীর্ঘমেয়াদী চলবে। এতে দেশের আড়াই থেকে তিন কোটি লোক উপকৃত হবে এবং দেশের আর কেউ না খেয়ে কষ্ট পাবে না। তিনি জানান, এ কর্মসূচীর নাম হচ্ছে ‘খাদ্যবান্ধব’ কর্মসূচী এবং এর স্লোগান হচ্ছে ‘শেখ হাসিনার বাংলাদেশ, ক্ষুধা হবে নিরুদ্দেশ’। এই কর্মসূচী আমার বিশেষ উদ্যোগের অন্যতম কার্যক্রম। জঙ্গীবাদ-সন্ত্রাসবাদ দমনে সরকার দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ॥ আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্য হাবিবুর রহমানের প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী জানান, বর্তমান সরকার জঙ্গীবাদ ও সন্ত্রাসবাদ রোধসহ জনগণের জানমালের নিরাপত্তা বিধান এবং সার্বিক আইনশৃঙ্খলা রক্ষার মাধ্যমে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, জনগণের মৌলিক ও মানবাধিকার সমুন্নত রাখতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। সব ধরনের নাশকতা ও সহিংসতার সঙ্গে জড়িতদের আইনের আওতায় আনতে ও তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সরকার পুলিশসহ সকল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাকে নির্দেশ প্রদান করেছে। তিনি জানান, ইতোপূর্বে সন্ত্রাসী/ নাশকতা/ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ রয়েছে এমন ব্যক্তিদের কর্মকা- ও গতিবিধি সম্পর্কে গোয়েন্দা কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। জঙ্গী-সন্ত্রাসীসহ সকল অপরাধীদের কর্মকা- রোধে তাদের অর্থের যোগানদাতা ও অর্থের উৎস সন্ধান করে প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে। সকল প্রকার নাশকতা, ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ ও সহিংসতা প্রতিরোধ করার জন্য সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে কমিউনিটি পুলিশিং ব্যবস্থা জোরদার করাসহ নিয়মিতভাবে সভা-সমাবেশের আয়োজন করা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী জানান, পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিরলসভাবে দায়িত্ব পালন করে সাম্প্রতিক সময়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে সন্ত্রাসী হামলা সংক্রান্ত মামলার রহস্য উদঘাটতে সফলতার পরিচয় দিয়েছে। বর্তমান গণতান্ত্রিক সরকার কর্তৃক গৃহীত নানা পদক্ষেপের ফলে দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক আছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তৎপর থাকার ফলে দেশে সন্ত্রাসবাদ এবং জঙ্গীবাদ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়েছে। ফলে দেশের সার্বিক উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রয়েছে, বৈদেশিক বিনিয়োগ বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং দেশের অর্থনৈতিক ভিত্তি দৃঢ়তর হচ্ছে। সংসদ নেতা আরও জানান, বর্তমান সরকার দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর আইনশৃঙ্খলা উন্নয়নের লক্ষ্যে বিভিন্ন জেলা/ ইউনিটের চাহিদার ভিত্তিতে অস্ত্র-গোলাবারুদ, জনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা সামগ্রী ক্রয় করে বরাদ্দ প্রদান করা হয়েছে। ফলে দেশে আইনশৃঙ্খলার উন্নয়নসহ সন্ত্রাসী কর্মকা- অনেকাংশে হ্রাস পেয়েছে। গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তরাঁ, শোলাকিয়া ঈদগাহ মাঠ, ঢাকার কমলাপুর, রূপনগর ও নারায়ণগঞ্জে জঙ্গী/ সন্ত্রাসী কর্মকা- দক্ষতার সঙ্গে প্রতিহত ও জঙ্গীদের দ্রুততম সময়ের মধ্যে সফলভাবে গ্রেফতার করা সম্ভব হয়েছে। সরকারের অগ্রাধিকারই হচ্ছে দারিদ্র্য দূরীকরণ ॥ জাতীয় পার্টির সংরক্ষিত নারী আসনের সংসদ সদস্য বেগম নুর-ই-হাসনা লিলি চৌধুরীর প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী জানান, জাতি হিসেবে জন্মলগ্ন থেকেই আমাদের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত লক্ষ্য হচ্ছে দারিদ্র্যদূরীকরণ ও অর্থনেতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করা। অর্থনীতির শক্তিশালী ভিত রচনার মাধ্যমে দেশকে উন্নত অবস্থানে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে সরকার নির্বাচনী অঙ্গীকারের সনদ ‘রূপকল্প ২০২১’-এর আলোকে বিগত মেয়াদের শুরুতেই প্রণয়ন করে প্রেক্ষিত পরিকল্পনা (২০১০-২০২১)। এর ফলে দীর্ঘায়িত বৈশ্বিক অর্থমন্দা সত্ত্বেও ২০০৯ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত গড়ে ৬ দশমিক ১৬ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি অর্জন হয়। বিবিএস-এর সাময়িক হিসাবমতে ২০১৬ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার দাঁড়িয়েছে ৭ দশমিক ০৫ শতাংশে। জিডিপি প্রবৃদ্ধির পাশাপাশি মাথাপিছু আয় বেড়েছে এক হাজার ৪৬৬ মার্কিন ডলার। অর্থনৈতিক অগ্রগতির ধারা অব্যাহত রাখাসহ বাংলাদেশকে অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী করতে সরকার উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে। ২০২১ সালের মধ্যে আইসিটি রফতানি ৫ বিলিয়ন ডলার ॥ সরকারী দলের সংসদ সদস্য কামরুল আশরাফ খানের প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী জানান, জাতির জনকের স্বপ্নের সোনার বাংলার আধুনিক রূপের প্রতিফলন-ই হচ্ছে আজকের এই ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’। তথ্যপ্রযুক্তি নির্ভর জ্ঞানভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা এবং ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত করার লক্ষ্য পূরণে ২০০৯ সাল থেকে শুরু হয় ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণের যাত্রা। এ অভিযাত্রাকে কাক্সিক্ষত গন্তব্যের পথে এগিয়ে নিতে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ বিভিন্ন প্রকল্প, কর্মসূচী, প্রচার ও প্রতিযোগিতামূলক উদ্যোগ গ্রহণ করে আসছে। তিনি জানান, এসব কর্মসূচী ও উদ্যোগের মধ্যেও রয়েছে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য। যার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ২০২১ সালের মধ্যে আইসিটি রফতানি ৫ বিলিয়ন ডলার ও আইটি পেশাজীবীদের সংখ্যা ২০ লাখে উন্নীত করা এবং জিডিপিতে আইসিটি খাতের অবদান ৫ শতাংশ নিশ্চিত করা। এ লক্ষ্য বাস্তবায়নে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ আইসিটি অবকাঠামো উন্নয়ন, কানেক্টিভিটি স্থাপন, ই-গবর্নেন্স প্রতিষ্ঠা, দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি, মোবাইল এ্যাপস উন্নয়ন এবং ই-কমার্স প্রসারসহ নানাবিধ প্রকল্প ও কর্মসূচী বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে বাস্তবায়িত প্রকল্প ও কর্মসূচীর সুফলও পাচ্ছে দেশের মানুষ।
×