ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

কোরানের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে এদের জঙ্গী বানানো হয়েছিল;###;‘আপনার সন্তানকে ভুল পথ থেকে ফিরিয়ে আনুনÑ ওই পথে মৃত্যু ছাড়া কিছু নেই’- ফিরে আসা জঙ্গী মাহমুদুলের মায়ের আকুতি

যশোর ও বগুড়া মিলে নয় জঙ্গীর আত্মসমর্পণ ॥ ভুল বুঝতে পেরে ফিরেছি

প্রকাশিত: ০৫:৩২, ৬ অক্টোবর ২০১৬

যশোর ও বগুড়া মিলে নয় জঙ্গীর আত্মসমর্পণ ॥ ভুল বুঝতে পেরে ফিরেছি

জনকণ্ঠ রিপোর্ট ॥ ‘আমি ভুল করে যে পথে গিয়েছিলাম সেটা ছিল অন্ধকার পথ। আমাকে ইসলামী জেহাদের কথা বলে উৎসাহিত করা হয়েছিল। আমি ভুল বুঝতে পেরে ফিরে এসেছি। আমি জঙ্গীবাদে বিশ্বাস করি না।’ বগুড়ার শাজাহানপুর উপজেলার কামারপাড়ার আব্দুর রহমানের ছেলে আব্দুল হাকিমের সরল স্বীকারোক্তি এটি। এই হাকিম আকস্মিক জীবনের স্বাভাবিকতা ছেড়ে জঙ্গীতে পরিণত হয়েছিল এখন আবার আলোর পথে ফিরেছেন। শুধু হাকিম নয়, বগুড়ায় হাকিমের সঙ্গে আরও একজন আর যশোরে আরও সাত জন জঙ্গীবাদ ছেড়ে সুস্থ জীবনে ফিরে আসার জন্য আত্মসমর্পণ করেছে। এই আলোর পথে যাত্রাকে স্বাগত জানিয়েছে দেশের মানুষ। অতীতেও বিভিন্ন সময়ে দেশের সংকটকালে মানুষ দিগ্ভ্রান্তদের পথে ফিরে আসার উৎসাহ যুগিয়েছে। এবারও তার ব্যতিক্রম হলো না বগুড়া আর যশোরে। বগুড়ার শাজাহানপুর উপজেলার কামারপাড়া গ্রামের আব্দুল হাকিম (২২) ও গাইবান্ধার সাঘাটা উপজেলার হাটভরতখালি গ্রামের মামুদুল হাসান বিজয় (১৭) বুধবার আত্মসমার্পণ করেন। আব্দুল হাকিম নিষিদ্ধ ঘোষিত জেএমবির সদস্য ছিল। সে গত ১ জুলাই ঢাকার গুলশানে হলি আর্টিজান রেস্তরাঁয় হামলায় নিহত জঙ্গী বগুড়ার শাজাহানপুরের খায়রুল আলম বাঁধন ওরফে পায়েলের বন্ধু। সে হাকিমকে অন্ধকারের পথে নিয়ে আসে। অপরজন গাইবান্ধার মাহমুদুল হাসান। দুজই আত্মসমর্পণ করতে এসে নিজেদের ভুল বুঝতে পারে। অন্যদিকে যশোরে পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করে শহরের পুরাতন কসবা কদমতলার আব্দুল আজিজের ছেলে তানজিব ওরফে আশরাফুল (২৬), তার ভাই তানজির আহমেদ (২২), বোন মাছুমা আক্তার (২৮), শহরতলীর খোলাডাঙ্গা কদমতলা এলাকার শফিয়ার রহমানের ছেলে সাদ্দাম ইয়াসির সজল (৩২), ধর্মতলা মোড়ের আবদুস সালামের ছেলে রায়হান আহমেদ (২০) এবং খোলাডাঙ্গা কদমতলার এ কে এম শরাফত মিয়ার ছেলে মেহেদি হাসান পাশা (২০)। যশোর শহরের আরবপুর এলাকার আবদুর রাজ্জাকের ছেলে যশোর পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের ছাত্র ফখরুল আলম তুষার (২২)। ইসলামী চিন্তাবিদরা বলছেন, জিহাদ হচ্ছে ধর্মরক্ষার যুদ্ধ। বাংলাদেশের মানুষ অন্য যে কোন দেশের চেয়ে বেশি ধর্মপ্রাণ। সকল ধর্মের মানুষের সহঅবস্থানের অনন্য নজির রয়েছে এই মাটিতে। এখানে কেউ ইসলামকে গালি দেয় না। অপমানও করে না। ইসলাম নিয়ে দেশের মধ্যে কোন বিভেদ নেই। সেখানে জিহাদের প্রয়োজনীয়তা আসে কি করে? নিরীহ সাধারণ মানুষের বুকে গুলি চালিয়ে জিহাদ হয় না। ধর্মপ্রাণ বাংলাদেশের মানুষ যখনই বুঝতে পেরেছে ধর্মের নামে অধর্ম হচ্ছে, ইসলামকে কলঙ্কিত করা হচ্ছে, জিহাদের নামে সন্ত্রাস হচ্ছে তখনই সামাজিকভাবে প্রতিরোধ শুরু হয়েছে। এতে সংকুচিত হয়ে এসেছে জঙ্গীদের বিচরণ এলাকা। মানুষ হত্যা করে মানুষের ভালবাসার বদলে ঘৃণা পাওয়া যায় না তা সম্প্রতি প্রমাণ হয়ে গেছে। দেশের নিহত জঙ্গীদের দাফন হয়েছে বেওয়ারিশ লাশের সারিতে। জঙ্গীবাদের দায়ে অভিযুক্তদের পরিবারও তাদের পরিচয় দিতে লজ্জা বোধ করছে, ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। শুরুতে ব্লগারদের নাস্তিক আখ্যা দিয়ে জঙ্গিরা হত্যা করে আসছিল। পরবর্তী সময়ে প্রকাশক এবং মুক্তমনা লেখকদেরও হত্যা মিশন নিয়ে মাঠে নামে। তখনও জঙ্গিরা প্রচারে সক্ষম হয় এরা নাস্তিক। এদের হত্যাকরা ইসলাম সম্মত। কিন্তু ব্লগারদের বিরুদ্ধে ধর্ম অবমাননার তেমন প্রমাণ কেউ হাজির করতে পারেনি। এরপর এইসব জঙ্গিরা হাত বাড়ায় বিদেশী নাগরিকদের প্রতি। তখন মানুষ বিষ্মিত হয় কেন কি কারণে নিরিহ বিদেশীদের হত্যা করা হচ্ছে। এরমধ্যেই জঙ্গিদের চাপাতির আঘাতে কয়েকজন হিন্দু পুরহিত এবং খ্রিস্টান ধর্মজাজক নিহত হলে সাধারণ মানুষ বুঝতে পারে এটা কোন জিহাদ নয়। এরমধ্যে অন্য কিছু রয়েছে। মক্কা বিজয়ের পর যখন কাফিররা দিগবিদিক ছোটাছুটি করছিলো তখন হযরত মহম্মদ (স:) তাদের কাছে জানতে চান তোমরা কেন এভাবে ছুটোছুটি করছো। ভয়ে ভীত হয়ে কাফেররা বলে, পাছে তুমি আমাদের আবার কতল করে দেও তাই! তখন হযরত মহম্মদ (স:) বলেন তোমরা নির্ভয়ে সকল অধিকার নিয়ে মক্কায় বসবাস করবে। কেউ তোমাদের কিছু বলবে না। এমন শান্তির ধর্ম ইসলামে যেখানে মানুষ হত্যাকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে সেখানে এই জঙ্গিবাদের নামে নিরিহ মানুষ হত্যা কেন তা নিয়ে প্রশ্ন দানাবাধতে শুরু করে সারাদেশের মানুষের মনে। গুলশানে হলি আর্টিজান রেস্তরাঁয় হামলা এবং শোলাকিয়া ঈদ জামাতে জঙ্গী হামলার পর মানুষ পরিষ্কার বুঝতে পারে। এরা বাংলাদেশের শান্তি বিনষ্ট করতে চায়। এরা ভ্রান্ত পথে পরিচালিত হচ্ছে। সঙ্গত কারণে সামাজিক প্রতিরোধে ঝাঁপিয়ে পড়ে মানুষ। মিরপুরের পল্লবীতে সেনাবাহিনীর সাবেক মেজর জাহিদুলকে পুলিশের হাতে ধরিয়ে দিতে সাধারণ মানুষই সব থেকে বেশি কাজ করেছে। যেখানেই যাকে সন্দেহ হচ্ছে সেখানেই পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করে তথ্য দিচ্ছে সাধারণ মানুষ। পুলিশ সেই কৃতজ্ঞতা স্বীকারও করেছে। পুলিশ এবং র‌্যাবের বিশেষ এ্যাপসে সাধারণ মানুষের অভূতপূর্ব সাড়া মিলেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্পষ্ট করেছেন বাংলাদেশ কোন সন্ত্রাসী উগ্রবাদীর ঘাটিতে পরিণত হবে না। তিনি সামাজিকভাবে এই সব ভ্রান্ত পথে পরিচালিত মানুষদের প্রতিরোধের আহ্বান জানিয়েছে। প্রত্যেক এলাকায় জঙ্গীবাদ প্রতিরোধে পৃথক কমিটি করে মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়েছে জঙ্গীবাদ প্রতিরোধে। সাধারণ ধর্মপ্রাণ বাঙালী বলতেই শান্তিপ্রিয়। এই শান্তির মাঝে অশান্তির কোন স্থান নেই দেশের জঙ্গীরা তা বুঝতে পেরেছে। জঙ্গীবাদ প্রতিরোধে পুলিশ কঠোর হওয়ার পাশাপাশি সহায়তার হাতও বাড়িয়ে দেয়। পুলিশ মহাপরিদর্শক এ কে এম শহীদুল হক এরমধ্যে ঘোষণা দিয়েছেন কোন জঙ্গী যদি স্বাভাবিক জীবনে ফেরত আসতে চায়, তাহলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তরফ থেকে তাকে এবং তার পরিবারকে সব ধরনের সহযোগিতা দেয়া হবে বলে ঘোষণা দিয়েছেন পুলিশ মহাপরিদর্শক একেএম শহীদুল হক। জঙ্গীদের পরিবার থেকেও চাপ দেয়া হয় তাদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে। জঙ্গীরা শুধু তাদের নিজের জীবনকেই নয়, তাদের স্ত্রী এবং সন্তানদের জীবনকেও ঝুঁকিপূর্ণ করে তোলে। কিন্তু এর বিনিময়ে কি পাবে কি না পাবে তা একবারও হিসাব করে না। ইসলামে যেসব কাজের জন্য পারলৌকিক জীবনে চরম শাস্তির কথা বলা হয়েছে সেই সব কাজ করে পরকালে পুরস্কার লাভের প্রত্যাশাও ভুল ধারণা তা নিজেরাও উপলব্ধি করতে পেরেই তারা আলোর পথে ফেরার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। পুলিশ বলছে, এই আত্মসমর্পণ প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকবে। তাদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে সকল সুবিধা দেয়া হবে। সমুদ্র হক/মাহমুদুল আলম নয়ন বগুড়া থেকে জানান, বগুড়ায় বুধবার দুপুরে র‌্যাবের আয়োজনে সর্বস্তরের সুধী সমাবেশে দুইজন তরুণ জঙ্গী আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ করে। এর আগে দুই জঙ্গীর অভিভাবকগণ তাদের সন্তানদের নিয়ে র‌্যাব-১২ অফিসে গিয়ে অন্ধকারের পথ থেকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার অঙ্গীকার করে আত্মসমর্পণ করায়। এই অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন। এই দুই জঙ্গী হলো : বগুড়ার শাজাহানপুর উপজেলার কামারপাড়া গ্রামের আব্দুল হাকিম ও গাইবান্ধার সাঘাটা উপজেলার হাটভরতখালি গ্রামের মামুদুল হাসান বিজয়। আব্দুল হাকিম নিষিদ্ধ ঘোষিত জেএমবির সদস্য ছিল। সে গত ১ জুলাই ঢাকার গুলশানে হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় হামলায় নিহত জঙ্গী বগুড়ার শাজাহানপুরের খায়রুল আলম বাঁধন ওরফে পায়েলের বন্ধু। সে হাকিমকে অন্ধকারের পথে নিয়ে আসে। অপরজন গাইবান্ধার মাহমুদুল হাসান উচ্চ মাধ্যমিকে পড়ার সময় শিবিরের রাজনীতির সঙ্গে ছিল। পরে সে কথিত জেএমবির সঙ্গে যুক্ত হয়। আত্মসমর্পণকারী দুই তরুণের প্রত্যেককে পুনর্বাসনের জন্য ৫ লাখ টাকা করে চেক তুলে দেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। অনুষ্ঠানে র‌্যাবের মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ বলেন, জঙ্গীরা তাদের ভুল বুঝতে পেরে আত্মসমর্পণ শুরু করেছে। যশোরের তিন জন ও বগুড়ায় দুইজন আত্মসমর্পণের পর আরও অনেক অভিভাবক বিপথে যাওয়া তাদের সন্তানদের র‌্যাবের কাছে আত্মসমর্পণ করাবার প্রস্তুতি নিয়েছেন। শীঘ্রই আরও অনেক জঙ্গী আত্মসমর্পণ করবে। র‌্যাবের মহাপরিচালক জানান, দেশের প্রতি ইঞ্চি ভূমি খুঁজে জঙ্গীদের বের করে আনা হবে। সামান্য কয়েকটি পিস্তল আর গ্রেনেড দিয়ে জঙ্গীরা পার পাবে না। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন বলেন, জঙ্গীদের বেশিরভাগই জামায়াত-শিবিরের সদস্য। দেশকে অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত করতে বিদেশী মদদে জঙ্গী উস্কে দেয়া হয়েছে। সরকার জঙ্গী উৎখাতে সকল ব্যবস্থা নিয়েছে। পুলিশ র‌্যাব আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর হাত থেকে জঙ্গীরা পার পাবে না। যারা জঙ্গীদের মদদ দিচ্ছে অর্থ দিচ্ছে তাদেরও তালিকা করে খুঁজে বের করা হচ্ছে। বগুড়া শহরের শহীদ টিটু মিলনায়তনে এক জনাকীর্ণ সুধী সমাবেশে র‌্যাব-১২ এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। তিন স্তরের কঠোর নিরাপত্তায় আমন্ত্রিত অতিথিরা মিলনায়তনে প্রবেশ করেন। অতিরিক্ত ডিআইজি ও র‌্যাব-১২ এর অধিনায়ক মোঃ শাহাবুদ্দিন খানের সভাপতিত্বে এই আড়ম্বরপূর্ণ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ছাড়াও বিশেষ অতিথি ছিলেন অতিরিক্ত আইজিপি ও র‌্যাব ফোর্সের মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ, জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মমতাজ উদ্দিন, বগুড়া সদর আসনের সংসদ সদস্য নুরুল ইসলাম ওমর, জেলা প্রশাসক মোঃ আশরাফ উদ্দিন ও পুলিশ সুপার মোঃ আসাদুজ্জামান। মঞ্চে অতিথিদের আসন গ্রহণ ও র‌্যাব-১২ এর অধিনায়কের স্বাগত বক্তব্যের পর হেলমেট ও র‌্যাবের বুলেট প্রুফ জ্যাকেট পরিহিত জঙ্গীদ্বয় আত্মসমর্পণ করে। এরপর আত্মসমর্পণ করা জঙ্গীরা কিভাবে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসে তার বর্ণনা দেন। বগুড়ার শাজাহানপুরের আব্দুর রহমানের ছেলে আব্দুল হাকিম বলেন, গত বছর মাদ্রাসা থেকে আলিম পাস করার পর সে ও পায়েল (হলি আর্টিজানে নিহত জঙ্গী) একসঙ্গে জঙ্গী কর্মকা-ের সঙ্গে যোগ দেয়। সেখানে জঙ্গী ‘বড় ভাই’ তাদের জিহাদী বই পড়া শেখায় ও ইসলাম ধর্মের নানা কথা বলে। তারপর তাদের গোপনে অস্ত্র চালনা শেখায়। পায়েল অস্ত্র ভাল চালাতে পারত বলে তাকে হলি আর্টিজানের অপারেশনে পাঠায়। পায়েল নিহত হওয়ার পর হলি আর্টিজানে নিহতদের বীভৎস দৃশ্য দেখে এবং শোলাকিয়া ঈদগাহে হামলার পর তার মনে অনুশোচনার সৃষ্টি হয়। এ সময় সারা দেশে এই ঘটনার সমালোচনা শুরু হলে সে বুঝতে পারে অন্ধকারের পথে সে রয়েছে। আর পুলিশ ও র‌্যাব যে ভাবে অভিযান চালাচ্ছে তাতে পালিয়ে থাকার কোন উপায় নেই। এরই মধ্যে সরকার বিপথগামীদের অন্ধকার পথ ছেড়ে আলোর পথে আসার আহ্বান জানলে সে তার বাবা ও ভাইকে নিয়ে র‌্যাব-১২ অফিসে গিয়ে আত্মসমর্পণ করে। বক্তব্য দেয়ার সময় সে ক্ষমা চায় ও ভাল হয়ে থাকার জন্য দোয়া চেয়ে ভুল পথে যাওয়া অন্য জঙ্গীদের আত্মসমর্পণ করে ফিরে আসার আহ্বান জানায়। আত্মসমর্পণ করা আরেক জঙ্গী গাইবান্ধার মৃত সেকেন্দার আলীর ছেলে মাহমুদুল হাসান বিজয় তার বক্তব্যে বলে, মাদ্রাসা পাঠ দিয়ে তার শিক্ষা জীবনের শুরু। ৮ম শ্রেণীতে সে মাধ্যমিক স্কুলে ভর্তি হয়। উচ্চ মাধ্যমিকে পাঠের সময় সে ছাত্র শিবিরে যোগ দেয়। পরে ধর্মীয় উগ্রবাদীতে আকৃষ্ট হয়ে কথিত জেএমবিতে যোগ দেয়। সে বোনারপাড়া মহিমাগঞ্জ সারিয়াকান্দি ও বগুড়ায় গোপন সভায় যোগদান করে অস্ত্র প্রশিক্ষণ নেয়। সে অস্ত্র কেনার জন্য অর্থ সংগ্রহ করে। প্রশিক্ষণের সময় জঙ্গী বড় ভাইয়েরা কোরানের সূরা বাকারা, সূরা আল ইমরান, সূরা নিসার কয়েকটি আয়াত মুখস্থ করতে বলে। তারপর ভুল ব্যাখ্যা দেয়া হয়। ব্রেন ওয়াশ করা হয় নানাভাবে। শিয়া মুসলমান, খ্রীস্টান নাগরিক, হিন্দু পুরোহিতকে টার্গেট করে হত্যার উৎসাহ দেয়া হয়। ওয়েব সাইটের থ্রিমা ও ভিপিএম এ্যাপসের মাধ্যমে যোগাযোগ করার প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। এরই মধ্যে দেশে জঙ্গীবাদবিরোধী মনোভাব প্রচার, মানুষের সচেতনতা আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সাঁড়াশি অভিযানে সে ভীত হয়ে পড়ে। বুঝতে পারে অন্ধকারের এই পথে থাকলে নিশ্চিত মরণ। আত্মগোপন কোন সমাধান নয়। সে তার কৃতকর্ম পরিবারকে অবগত করলে পরিবারের সদস্যগণ তাকে র‌্যাব-১২-এর কাছে নিয়ে গিয়ে আত্মসমর্পণ করায়। অনুষ্ঠানে মাহমুদুল হাসান বিজয়ের মা আক্তার জাহান তার ছেলে স্বাভাবিক পথে ফিরে আসায় আবেগে বলেন, ছেলে বিপথে যাওয়ার খবর শুনে মায়ের যে কি অবস্থা হয় তা তিনি বুঝতে পারেন। আবেগের কান্নায় তিনি বিপথে যাওয়া সকল সন্তানের মায়েদের উদ্দেশে বলেন, ‘আপনার সন্তানদের ভুল অন্ধকার পথ থেকে আলোর পথে ফিরিয়ে আনুন। অন্ধকার ওই পথে সন্তানের মৃত্যু ছাড়া কিছু নেই।’ অনুষ্ঠানে বগুড়া জেলা ইমাম মোয়াজ্জেম সমিতির সভাপতি আলহাজ মাওলানা আব্দুল কাদের মসজিদের ইমামদের উদ্দেশে প্রতি জু’মার খুতবায় সন্ত্রাস ও জঙ্গীদের বিরুদ্ধে বলে জনমত গড়ে তোলার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, পবিত্র কোরানের যে কয়টি সূরার আয়াতের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে জঙ্গীদের বোঝানো হয় তা যে কত বড় বিভ্রান্তি তা নামাজের খুতবায় পরিষ্কার করে বলার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, দেশের মানুষের কাছে ইমামদের একটা মর্যাদা আছে। ইমামদের কথা সমাজের লোকজন মান্যগণ্য করে। সমাজের প্রতি ইমামদেরও দায়-দায়িত্ব আছে। এই দায়িত্ব পালনে ইমামদের এগিয়ে আসা উচিত। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেন, জঙ্গীবাদের কারণে মুসলমান কলঙ্কিত হচ্ছে। বিশ্ব যখন বাংলাদেশকে উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে বলছে, তখন দেশকে অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত করতে আন্তর্জাতিক চক্রান্ত শুরু হয়েছে। এ দেশ সম্প্রীতির দেশ, এ দেশে সকল ধর্মের মানুষ মানুষের মমত্বে বাস করে। আমাদের ধর্মেও আছে যে যার ধর্ম পালন করবে। জঙ্গীদের বিদেশী হত্যার কারণ তারা যেন দেশে না থাকে কোন অর্থায়ন না হয়। সে ধারণা যে বৃথা যাবে তার প্রমাণ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দিচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, এ দেশে জঙ্গীদের কোন স্থান নেই। যেখানেই থাকুক তাদের খুঁজে বের করা হবে। গোয়েন্দা বাহিনীর নজর চারদিকে আছে। জঙ্গীবিরোধী সচেতনতা গড়ে তুলতে প্রধানমন্ত্রীর আহ্বানে সাড়া দিয়ে দেশের সর্বস্তরের মানুষ আজ এক কাতারে দাঁড়িয়েছে। জঙ্গীরা বুঝে গেছে তাদের পরিণতি কি হতে পারে। পুলিশের অতিরিক্ত আইজি ও র‌্যাবের মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ জানান, র‌্যাবের কঠোর গোয়েন্দা নজরদারি ও অভিযানে জঙ্গী সংগঠনগুলোর নেতাকর্মীরা সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হচ্ছে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার হাতে আটক হচ্ছে। নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গী সংগঠন জেএমবি, হুজিবি, হিযবুত তাহরীর, আনসারুল্লাহ বাংলা টিম শহীদ হামজা ব্রিগেডসহ জঙ্গী সংগঠনের ১ হাজার ২শ’ ১৬ সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়েছে। যার মধ্যে জেএমবির সদস্য ৬৪৩ জন। উদ্ধার করা হয়েছে ৪শ’ ৪টি গ্রেনেড/ বোমা, ১শ’ ৩টি বিভিন্ন প্রকার অস্ত্র, ৫ হাজার ৮১ রাউন্ড গুলি, প্রায় ২ হাজার কেজি বিস্ফোরক, বোমা তৈরির বিপুল সরঞ্জাম ইলেকট্রনিক্স যন্ত্রপাতি ও জিহাদী বই। এ ছাড়াও জঙ্গী সংগঠনের অর্থায়নের অভিযোগে তিনজন আইনজীবী, একজন গার্মেন্টস ব্যবসায়ীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। গুলশান হামলার পর দক্ষিণাঞ্চলের জেএমবির আমীর মোঃ মাহমুদুল হাসান তানভীরসহ ৪ জন, আল অনসারের সমন্বয়কারী রাশিদুল আলমসহ হুজির ৫ সদস্য, জঙ্গী ওয়েবসাইটের এ্যাডমিন ইঞ্জিনিয়ার মোস্তাফিজুর রহমান সিফাতসহ ৬ জন, জঙ্গী নেত্রী আকলিমা রহমানসহ ৪ নারী জঙ্গী, জেএমবির মহিলা শাখার প্রশিক্ষক রাশেদুজ্জামান রোজসহ ৫ জন, বিদেশে যাওয়ার প্রস্তুতিকালে জেএমবির দুই দম্পতিকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তিনি বলেন, এ দেশের জঙ্গী শকুনিদের ডানা ভেঙ্গে কলিজা ছিঁড়ে ফেলা হবে। ইসলামে জঙ্গীদের কোন স্থান নেই। এ দেশের মানুষ শান্তিপ্রিয়। জঙ্গীদের দমনে যা করা দরকার তাই করা হবে। যেভাবে আব্দুল হাকিম জঙ্গী হলো জঙ্গী আব্দুল হাকিমের (২২) বাড়ি বগুড়ার শাজাহানপুর উপজেলার কামারপাড়া গ্রামে। বাবা আব্দুর রহমান। ব্র্যাক স্কুলে লেখাপড়া শুরু করে। এরপর কামারপাড়া সরকারী প্রাথমিক স্কুলে ৩য় শ্রেণীতে ভর্তির পর ব্রিকুষ্টিয়া হাফেজিয়া মাদ্রাসায় প্রথম শ্রেণীতে ভর্তি হয়। ২০১৩ সালে দাখিল ও গত বছর আলিম পাস করে। তার বন্ধু পায়েলের সঙ্গে সে জঙ্গীতে যোগ দেয়। জঙ্গী প্রশিক্ষণে পায়েল (যার আসল নাম খায়রুল আলম) এগিয়ে ছিল। পায়েল হলি আর্টিজান হামলায় নিহত হয়। হাকিমকে প্রথমে ঢাকার মীরপুরে জঙ্গী আস্তানায় নেয়া হয়। হাকিমকে নিয়মিত জঙ্গী উগ্রবাদের পুঁথিগত শিক্ষায় দীক্ষা দেয়া হয়। অস্ত্র চালনা শারীরিক কসরত, প্রশিক্ষণ চলতে থাকে। প্রশিক্ষণের নানা নিয়ম ছিল। বাইরে কোন কাগজ ফেলা চলবে না। জানালার কাছে দাঁড়ানো চলবে না। দরজায় টোকা দিলে খোলা হবে না। নির্দিষ্ট ব্যক্তিরা দরজা খুলবে। হাকিম কৌশলে একদিন প্রশিক্ষণের দরোজায় উঁকি দিয়ে দেখে সেখানে কয়েকজন জঙ্গী ল্যাপটপ প্রিন্টার নানা ধরনের কেমিক্যাল অস্ত্র দিয়ে মহড়া দিচ্ছে। সেখানে যুদ্ধের ক্লাস নেয়া হয়। সে জড়িয়ে পড়ে জঙ্গীতে। পরে সে ভুল বুঝতে পারে। জঙ্গী মাহমুদুল হাসান ॥ বাড়ি গাইবান্ধার সাঘাটার হাটভরতখালী। মাদ্রাসায় পাঠের পর উচ্চ মাধ্যমিকে পড়ার সময় শিবিরের সঙ্গে যুক্ত হয়। সে মুফতি জসীম উদ্দিন রাহমানির ওয়াজ ও লিখিত বই অধ্যয়ন করে ধর্মীয় উগ্রবাদীতে আকৃষ্ট হয়ে জঙ্গীদের সহচার্যে আসে। সে সারিয়াকান্দির চরে অস্ত্র প্রশিক্ষণ নেয়। তাকে বোঝানো হয় জিহাদের মাধ্যমেই জান্নাত লাভ করা সম্ভব। জেএমবির বিভিন্ন সভায় সে যোগদান করে। অস্ত্র প্রশিক্ষণে উতীর্ণ হওয়ার পর ১০ হাজার টাকা নিয়ে প্রস্তুত থাকতে বলা হয়। প্রশিক্ষণের জন্য ঢাকায় যেতে বলা হয়। পরীক্ষা ও অর্থাভাবে ঢাকায় যেতে পারে না। এরই মধ্যে জঙ্গী দমনে সাঁড়াশি অভিযান শুরু হলে এবং সাধারণের মধ্যে জঙ্গী বিরোধী মনোভাব সৃষ্টি হলে সে বুঝতে পারে এই পথে একমাত্র ফল মৃত্যু। সে আত্মসমর্পণের সিদ্ধান্ত নিয়ে অভিভাবকদের জানায়। যশোর অফিস থেকে সাজেদ রহমান জানান, সীমান্তবর্তী জেলা যশোরে অসাম্প্রদায়িক ও মুক্তমনা মানুষের বসবাসই বেশি। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে প্রথম শত্রুমুক্ত এ জেলা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির উর্বর ভূমি হিসেবেও পরিচিত। তথ্য প্রযুক্তির যথাযথ ব্যবহারের কারণে দেশের প্রথম ডিজিটাল জেলা হওয়ারও গৌরব অর্জন করেছে যশোর। কিন্তু এতসব অর্জনে কালিমা লেপন হওয়ার উপক্রম হয়েছে এ জেলা থেকেই জঙ্গীগোষ্ঠীর উত্থানের কারণে। এতে যশোরের সবমহলই উদ্বিগ্ন। তারা বলছেন, প্রশাসনিক দুর্বলতা আর অপরাজনীতির কারণেই এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। দেশে জঙ্গীদের অপতৎপরতা থাকলেও গুলশান আর শোলাকিয়া হামলার পর বিষয়টি নতুন করে ব্যাপক আকারে আলোচনায় আসে। এরপর র‌্যাবসহ সরকারের বিভিন্ন সংস্থা জঙ্গী হিসেবে সন্দেহভাজনদের যে তালিকা প্রকাশ করে তাতে যশোরের আধিক্য দেখা যায়। এ অবস্থায় নড়েচড়ে বসে যশোর প্রশাসনও। যশোরের পুলিশ জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেয়া ছাড়াও সচেনতামূলক কার্যক্রমও শুরু করে। এরপরই দৃশ্যপট পাল্টে যায়। নিখোঁজ থাকা কেউ বাড়ি ফিরতে শুরু করে। আবার কেউ কেউ করে আত্মসমর্পণ করে। যশোর সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি ডিএম শাহীদুজ্জামান বলেন, যশোরে জঙ্গীবাদের উত্থান এখনই প্রথম নয়। যশোরে জঙ্গীবাদের বিষবৃক্ষটির জন্ম হয়েছে অনেক আগেই। দেশে জঙ্গীদের রক্তের হোলিখেলা শুরু হয় উদীচী যশোরের অনুষ্ঠানে বোমা হামলার মধ্য দিয়ে। ১৯৯৯ সালের ৬ মার্চ সংগঠনটির দ্বাদশ জাতীয় সম্মেলনে হামলা চালিয়েই আত্মপ্রকাশ ঘটায় জঙ্গীরা। ওই হামলায় ১০ জন নিহত ছাড়াও বহুমানুষ আহত হন। ইতোমধ্যে স্বাভাবিক জীবনে ফেরার আসায় যশোরে নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গী সংগঠন হিযবুত তাহরীরের নেতাকর্মী তিন ভাই-বোনসহ ৭ জন জঙ্গী পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। নিজের ভুল বুঝতে পেরে বিবেকের তাড়নায় তারা যশোর পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে বলে জানায়। এরা হলেন শহরের পুরাতন কসবা কদমতলার আব্দুল আজিজের ছেলে তানজিব ওরফে আশরাফুল (২৬), তার ভাই তানজির আহমেদ (২২), বোন মাছুমা আক্তার (২৮), শহরতলীর খোলাডাঙ্গা কদমতলা এলাকার শফিয়ার রহমানের ছেলে সাদ্দাম ইয়াসির সজল (৩২), ধর্মতলা মোড়ের আবদুস সালামের ছেলে রায়হান আহমেদ (২০) এবং খোলাডাঙ্গা কদমতলার এ কে এম শরাফত মিয়ার ছেলে মেহেদি হাসান পাশা (২০)। যশোর শহরের আরবপুর এলাকার আবদুর রাজ্জাকের ছেলে যশোর পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের ছাত্র ফখরুল আলম তুষার (২২)। যশোর পুলিশ সুপার আনিসুর রহমান জানান, গত ৩ অক্টোবর আত্মসমর্পণ করা ৩ ভাই-বোনই যশোর পুলিশের জঙ্গী তালিকাভুক্ত। জঙ্গী হিসেবে গত বছর গ্রেফতার এই ৩ ভাই-বোন জামিন নিয়ে পলাতক ছিলেন। পুলিশ জানায়, গত ৬ সেপ্টেম্বর ১১ জন পলাতক জঙ্গীর তালিকা প্রকাশ করে যশোর পুলিশ। এর মধ্যে চার ভাই-বোনসহ ৬ জন একই পরিবারের সদস্য ছিল। এরা হলেন শহরের পুরাতন কসবা কদমতলার আব্দুল আজিজের ছেলে তানজিব ওরফে আশরাফুল, তার ভাই তানজির আহমেদ, বোন মাছুমা আক্তার ও মাকসুদা খাতুন, মাকসুদার স্বামী শাকির আহম্মেদ ও মাসুমার স্বামী নাজমুল হাসান। এদের মধ্যে তানজিব, তানজির ও মাছুমা বিভিন্ন সময়ে আটক হলেও আদালত থেকে জামিনে মুক্তি পেয়ে পালিয়ে যায়। কিন্তু সম্প্রতি দেশে ঘটে যাওয়া জঙ্গী-নৃশংসতা ঘটনার পর নাড়া দেয় তার বিবেক। পরে সরকারের আহ্বানও বিশ্লেষণ করে নিজের ভুল বুঝতে পারছেন তারা। আর তাই এখন স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে চান তারা। আত্মসমর্পণকারী হিযবুত তাহরীরের মোশারফ সদস্য তানজিব আহম্মেদ আশরাফুল জানান, না বুঝেই জঙ্গী তৎপরতার সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন তিনি। প্রথমে চায়ের দোকানের আড্ডায় ইসলাম ও নামাজের দাওয়াত দেয়। তখন তাকে সংগঠন সম্পর্কে কোন ধারণা দেয়া হতো না। তার হাতে তুলে দেয় ইসলামের বইপত্র। এগুলো পড়ে যখন তিনি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন তারপর বলা হয় সে হিযবুত তাহরীরের সদস্য এবং খেলাফত প্রতিষ্ঠার জন্য তাকে জিহাদি পথে এগোতে হবে। তাকে সাবাব সদস্য প্রদানের পর বিভিন্ন সময়ে ঢাকা থেকে মোসাব্বির, সাকিন, সাকিবগন এসে তাদের ক্লাস নিত। এর আগে গত ১১ আগস্ট নিষিদ্ধ ঘোষিত হিযবুত তাহরীরের তিন নেতা স্বাভাবিক জীবনে ফেরার জন্য পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করে। সাদ্দাম ইয়াসির সজল, মেহেদী হাসান পাশা ও রায়হান আহমেদ এই তিনজনকে যশোরের পুলিশ সুপার আনিসুর রহমানের কাছে তার অভিভাবকরা হস্তান্তর করেন। তারা তিনজনই হিযবুত তাহরীরের নেতা। এদের মধ্যে সাদ্দাম ইয়াসির সজলের পদবি ‘মোশরেক’। বাকি দুইজন ‘শাবাব’ পদবিধারী। ক্যাডারভিত্তিক সংগঠনটিতে মোশরেক অপেক্ষাকৃত উঁচু পদ। শাবাব তার নিচের পদ। গত জুলাই মাসে পুলিশ জঙ্গীদের প্রথম ১০ জনের তালিকা প্রকাশ করে। সেই তালিকায় রায়হানের নাম ছিল। যশোর পুলিশ জানায়, রায়হানের বিরুদ্ধে একটি মামলা আছে। বাকি দুজনের নামের মামলা ছিল না। তবে তারা জঙ্গীবাদে জড়িয়ে পড়েছিল বলে এলাকাবাসী জানায়। যশোর সদর উপজেলার আরবপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান শাহারুল ইসলাম বলেন, পুলিশের ঘোষণা শুনে ওই তিনজনের অভিভাবকরা যোগাযোগ করে। পরে পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করে আত্মসমর্পণের ব্যবস্থা করা হয়। যশোর সদর উপজেলার আরবপুর ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বর ও সাদ্দাম ইয়াসির সজলের চাচা তরিকুল ইসলাম বলেন, সজলের আব্বা মারা যাওয়ার পর ওদের আর্থিক অবস্থা ভাল ছিল না। এরপর ঢাকায় একটি কোম্পানিতে চাকরি নিয়ে বাড়ি থেকে কয়েক বছর আগে চলে যায়। বাড়ির কেউ জানত না সজল হিযবুত তাহরীরের সঙ্গে যুক্ত। সজল ওর মাকে ফোনে জানায় সে জঙ্গীবাদে জড়িয়ে পড়েছে। সে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে চায়। সজলের মা টিভিতে পুলিশের আইজি স্যারের বক্তব্য শুনে আমাকে জানায়। এরপর স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যানের মাধ্যমে পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণের ব্যবস্থা করেছি। তিনি আরও বলেন, তিনজনই আমাদের এলাকার ছেলে। ওরা স্বাভাবিক জীবনের ফিরতে আসতে পুলিশের কাছে আইনী সহায়তা চেয়েছে। পুলিশের আশ্বাসের ভিত্তিতে তারা আত্মসমর্পণ করল। অন্যদিকে ‘মামাত ভাইয়ের মাধ্যমেই ভুল পথের যাত্রা শুরু। এরপর চায়ের দোকানে আড্ডার মাঝেই ক্লাস নেয়া হতো।’ এভাবেই জঙ্গী সংগঠন হিযবুত তাহরীরের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন যশোর পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের ছাত্র ফখরুল আলম তুষার (২২)। স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার পর পুলিশের কাছে ২৬ আগস্ট আত্মসমর্পণ করে তুষার এভাবেই তার বক্তব্য উপস্থাপন করেন। জঙ্গীর আত্মসমর্পণ উপলক্ষে পুলিশ সুপার আয়োজিত প্রেস ব্রিফিংয়ে ফখরুল ইসলাম তুষার বলেন, দুই বছর আগে শহরের ধর্মতলা এলাকার চায়ের দোকানে আড্ডায় হিযবুত তাহরীরের সদস্যদের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। এই পরিচয় ঘটিয়ে দেয় তার মামাত ভাই রায়হান আহমেদ। (যে ১১ আগস্ট আত্মসমর্পণ করে হিযবুত তাহরীর সদস্য হিসেবে পুলিশের কাছে)। এরপর থেকে চায়ের দোকানোর আড্ডায় ২-৩ জন হিযবুত তাহরীর সদস্য তাকে ধর্মীয় নানা বিষয় সম্পর্কে তাদের ভাবনার কথা বলত। ধর্মীয় সাধারণ বিষয়বস্তু নিয়ে কিছুদিন আলোচনার পর ইসলামী আইন-কানুন সম্পর্কে তাদের মতো করে ব্যাখ্যা করত। তুষার জানান, তারা বলত ইসলামিক দৃষ্টিতে দেশ পরিচালিত হচ্ছে না। তারা ইসলামিক আইন রাষ্ট্র পরিচালনার কথা বলত। তুষার উল্লেখ করেন, ‘তারা যখন এসব বিষয় বলতে শুরু করল, তখন আমি বুঝতে পারি তারা কোন জঙ্গী দলের সদস্য। আমাকে ভুল বুঝিয়ে ভুল পথে নেয়ার চেষ্টা করছে। তাদের সঙ্গে থেকে তাদের সদস্য হওয়ার ভুল বুঝতে পেরে আমি আত্মসমর্পণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি। তুষার আরও বলেন, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষণা দিয়েছেন যারা ভুল পথে গিয়েছে তারা ফিরে আসলে আইনী সহায়তা দিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যাওয়ার সুযোগ প্রদান করা হবে। এরপর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি আত্মসমর্পণ করব। এরপর আত্মসমর্পণ করেছি। তুষার উল্লেখ করেন, এসব সংগঠন যেসব কথা ইসলামের নামে বলে তা সঠিক নয়। ইসলামের সঙ্গে এর কোন সংযোগ নেই। তাই তার মতো যারা ভুল পথে আছেন তাদেরও স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার জন্য আহ্বান জানান তিনি।
×