ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

রায়হান আহমেদ তপাদার

মধ্যপ্রাচ্যে অশান্তি বাড়ছে

প্রকাশিত: ০৩:৩৮, ৬ অক্টোবর ২০১৬

মধ্যপ্রাচ্যে অশান্তি বাড়ছে

মধ্যপ্রাচ্যে অশান্তি ক্রমেই বাড়ছে। আক্রান্ত হচ্ছে নতুন নতুন দেশ। ফলে মধ্যপ্রাচ্য থেকে ইউরোপে অবৈধ অভিবাসনও বেড়ে চলেছে। একই সঙ্গে বিপজ্জনকভাবে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিতে গিয়ে মারা যাচ্ছে বহু মানুষ। বিগত সময়ে প্রায় হাজারখানেক মানুষের লাশ ভেসে গেছে ভূমধ্যসাগরের উত্তাল জলরাশিতে। বিশ্ব রাজনীতির প্রত্যক্ষ শিকারে পরিণত হয়ে যেসব ভাগ্যহীন আফ্রো-এশীয় আরব অভিবাসন প্রত্যাশী মৎস্য নৌকা ও ক্ষুদ্র ডিঙি নৌকায় ভর করে পার্শ্ববর্তী ইউরোপে নিরাপদ আশ্রয়ের প্রত্যাশায় ভূমধ্যসাগরের উন্মত্ত তরঙ্গ উপেক্ষা করে গন্তব্যহীন যাত্রায় শরিক হয়েছিল, সেই অভিজাত ও আরব শিশু, নারী, যুবতী-জায়া তাদের অনেকেরই সলিল সমাধি রচিত হয়েছে ভূমধ্যসাগরের তলদেশে। বিশ্ব যখন তাদের ফিরিয়ে দিয়েছে সাগর তাদের দুই বাহু বাড়িয়ে কোলে তুলে নিয়েছে। গত কয়েক মাস আগে যখন একের পর এক সাগরের প্রমত্ত জলরাশিতে শরণার্থীদের সলিল সমাধির ঘটনা ঘটছিল, তখন তারই পাশে জাপানের আলো ঝলমল পরিবেশে বিশ্বের সাতটি ধনী রাষ্ট্রের স্পর্ধিত নেতাদের শীর্ষ মিটিং চলছিল। বিশ্বের নানা ইস্যু যেমন উন্নয়ন, জলবায়ু, সহযোগিতা, সন্ত্রাস প্রভৃতি জি-সেভেন শীর্ষ বৈঠকে আলোচিত হলেও বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা-সংশ্লিষ্ট বিষয়টি ওই শীর্ষ আলোচনায় স্থান পায়নি। সেই ইস্যুটি হলো বিশ্ব রাজনীতির শিকারে পতিত এ্যারিস্টোক্র্যাটিক আরব জনগণ, যারা বাস্তুচ্যুত, বৃন্তচ্যুত ও যাদের অভিবাসন প্রয়োজন। মানবাধিকার প্রতিটি মানুষের এক ধরনের অধিকার; যেটা তার জন্মগত ও অবিচ্ছেদ্য। মানুষ এ অধিকার ভোগ করবে এবং চর্চা করবে। তবে এ চর্চা অন্যের ক্ষতিসাধন ও প্রশান্তি বিনষ্টের কারণ হওয়া উচিত নয়। মানবাধিকার সব জায়গায় এবং সবার জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য। এ অধিকার একই সঙ্গে সহজাত ও আইনগত অধিকার। স্থানীয়, জাতীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক আইনের অন্যতম দায়িত্ব হলো এসব অধিকার রক্ষণাবেক্ষণ করা থেকে মানবাধিকারের এমন একটি সংজ্ঞা পেয়েছি। আরও সহজভাবে বলতে গেলে মানবাধিকারের প্রধান বিষয়গুলো দাঁড়ায়, জীবনধারণের অধিকার, সম্পদের অধিকার, মান-মর্যাদা ও ইজ্জতআব্রু রক্ষার অধিকার, ব্যক্তিস্বাধীনতার অধিকার, ব্যক্তিগত ও পারিবারিক গোপনীয়তা রক্ষার অধিকার, বিবেক ও বিশ্বাসের স্বাধীনতা, আর্থিক নিরাপত্তা লাভের অধিকার, বসবাস, যাতায়াত ও স্থানান্তরের অধিকার, গণতান্ত্রিক অধিকার, পারিশ্রমিক লাভের অধিকার, নারীর অধিকার, সংখ্যালঘুদের অধিকার, আইনের দৃষ্টিতে সমতা ও শ্রমিকের অধিকার ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। শরণার্থীরা বাধ্য হয়েই তারা দেশ ছেড়েছে। তাদের ভবিষ্যতে কী অপেক্ষা করছে, তা-ও তারা জানে না। তবে দেশে যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে, তাতে দেশে থাকা সম্ভব নয়। এমন যুদ্ধবিধ্বস্ত শরণার্থীদের জন্য বিশ্বের মোড়লদের সমন্বিত উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন। একই সঙ্গে ইউরোপের অন্য দেশগুলোকে তাদের নিজেদের সামর্থ্য অনুযায়ী অবৈধ এসব অভিবাসীকে তাদের দেশে আশ্রয় দিয়ে মানবিকতার দিকটি বিবেচনায় নিয়ে আসবেন এবং সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেবেন। জানা গেছে, মেসিডোনিয়া পেরিয়ে সার্বিয়া হয়ে ইইউভুক্ত দেশ হাঙ্গেরি সীমান্তের দিকে ধাবমান আশ্রয় প্রার্থী মানুষের সংখ্যা ক্রমে বাড়ছে। অবশ্য ঝুঁকিপূর্ণ ও কষ্টকর পথের যাত্রা শেষে ভাগ্যান্বেষী এসব মানুষের ভাগ্যে কী অপেক্ষা করছে, তা বলা এখনই কঠিন। হাঙ্গেরি এরই মধ্যে আশ্রয় প্রার্থীদের প্রবেশ ঠেকাতে ১৭৫ কিলোমিটার সীমান্তে ১৩ ফুট উঁচু কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে রেখেছে। এসব নাগরিকের করুণ অবস্থা দেখে যে কারও মনে হবে কোথায় আমাদের মনুষ্যত্ব, কোথায় বিবেক। পত্রপত্রিকায় শরণার্থীদের যে ছবি প্রকাশিত হচ্ছে, সেই ছবির মানুষগুলোর দিকে একটু তাকালে দেখা যাবে, কত পরিশীলিত, মার্জিত, রুচিশীলতার উৎকর্ষ ঘিরে পরিব্যক্ত রয়েছে ওই অসহায় মানুষগুলোর সাংস্কৃতিক চৌহদ্দির সামষ্টিক পরিচয়। আধুনিকতা-ধার্মিকতার অপূর্ব সমন্বয় তাদের পোশাক-পরিচ্ছদে, শিক্ষা-বিদ্যার দ্যুতি তাদের চোখেমুখে, আন্তরিক সমাজ-বন্ধনের নিয়ত চিত্র তাদের পরিবার ঐতিহ্যের শান্তিময়তার পেলব-পরশে। যে মানুষগুলো এই কিছুদিন আগেও দুই বাহু বাড়িয়ে আলিঙ্গন করেছে ভিনদেশী অতিথিকে, যারা দুম্বা-খাসি-উটের গোশতের সুস্বাদু রেসিপি সাজিয়েছে অতিথি আপ্যায়নে, যারা তাদের ঘরবাড়িকে পরিপাটি করে তৈরি করেছে পরদেশী অতিথির আগমনী বার্তার সম্মানে, সেই অতিথিপরায়ণ চির আপন আরবদের আজ বিশ্ব রাজনীতির কুটিল মারপ্যাঁচে আশ্রয় প্রার্থীর কাতারে আসতে হয়েছে। অসহায় আরবরা তুরস্ক পাড়ি দিয়ে গ্রীস হয়ে ইউরোপে ঢুকতে পারত, চির জানা এ পথে তাদের সুবিধা ছিল প্রচুর। জার্মানরা মানবতার ডানা মেলে দিয়েছিল শরণার্থীদের আলিঙ্গনে। কিন্তু শীঘ্রই আরবদের সে যাত্রাভঙ্গ হয় তুরস্ক ও ইইউয়ের মধ্যকার সম্পাদিত শরণার্থী চুক্তির কারণে। এরপর অসহায় আরবরা লিবিয়া হয়ে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালির ভেতর দিয়ে ইউরোপে যাওয়ার বিকল্প পথে অগ্রসর হতে থাকে। এরই ফলে দুঃসহ এ সাগর যাত্রায় করুণ-দুঃখময় খবর বেরোতে থাকে বিশ্ব মিডিয়ায়। শরণার্থী ইস্যুটি শুধু আরবদের আঞ্চলিক সমস্যা নয়, এটি বৈশ্বিক ও বিশ্ব রাজনীতির শক্তিশালী ঝাঁকুনিতে সমস্যাটি ঘনীভূত হচ্ছে। জি-সেভেন মিটিং ও আসেম শীর্ষ সম্মেলনে সমস্যাটির সমাধানে একটি দিকনির্দেশনা ঠিক করার সুযোগ ছিল। কিন্তু দুঃখজনকভাবে তার বদলে বিশ্ব রাজনীতির অন্যতম শক্তিশালী পক্ষ রাশিয়ার প্রতি নানা বিষোদ্গার করা হয়েছে, চীনকে হুমকি দেয়া হয়েছে এবং ইউক্রেন ইস্যুতে রাশিয়াকেও ছাড়া হয়নি। ইউক্রেনের মুষ্টিমেয় কিছু মানুষের জন্য, ছোট্ট একটি ভূখণ্ডের জন্য বিশ্ব মোড়লদের এত উৎকণ্ঠা অথচ আফ্রো-এশিয়ার দুটি মহাদেশের কোটি কোটি মানুষ ও লাখ লাখ বর্গমাইল ভূখণ্ডের জন্য বিশ্ব নেতাদের মাথাব্যথা নেই কেন? এ যেন বিবেকহীন বিশ্ব রাজনীতি! এমন পরিস্থিতিতে মধ্যপ্রাচ্যে ব্যাপক হাঙ্গা-দাঙ্গামা চালিয়ে বিভিন্ন স্থাপনা ধ্বংস করছে জঙ্গী সংগঠন ইসলামিক স্টেটের (আইএস) ও তাদের সমর্থক সদস্যরা। একের পর এক বিস্ফোরণ ও স্থাপনা দখলের মধ্য দিয়ে তারা বিশ্বের মানুষের কাছে কী বার্তা দিতে চাইছে, তা এখন অনেকের কাছে বোধগম্য নয়। বিশ্বের যেখানেই জঙ্গী সংগঠনগুলো আস্তানা গেড়েছে, সে অঞ্চলের ঐতিহাসিক স্থাপনা তাদের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইরাক ও সিরিয়ায় খেলাফত ঘোষণার পর আইএস একের পর এক প্রতœতাত্ত্বিক অমূল্য সব সাংস্কৃতিক নিদর্শন সম্পদ ধ্বংস করেছে। লিবিয়া, মালি ও আফগানিস্তানের মতো বিভিন্ন জায়গায় সাংস্কৃতিক শুদ্ধি অভিযানের নামে প্রাচীন সভ্যতার অনেক নিদর্শন তারা লুট করেছে। মহামূল্যবান এসব নিদর্শন তারা চোরাবাজারে বিক্রিও করে দিয়েছে। প্রাণের ভয়ে একের পর এক দেশ ছাড়তে বাধ্য হচ্ছে নাগরিকরা। হাজার হাজার শরণার্থী নিজ মাতৃভূমি ছেড়ে অন্যত্র চলে যাচ্ছে। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত ছবি ও ভিডিওতে দেখা গেছে, বৈরী আবহাওয়ার মধ্যে নারী-শিশুরা সীমান্ত পার হওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। মায়ের কোলে ক্ষুধার্ত শিশু। বাবার কাঁধে ক্রন্দনরত সন্তান। কাঁটাতারের সীমান্ত ছিন্ন করে তারা পার হতে চায়। সামনে তাদের অজানা ভবিষ্যত। সামনে ধূসর পথ। কবে ফিরবে মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি। কবে বন্ধ হবে এই রক্তের হোলি খেলা। এর জবাব আছে কি বিশ্ব নেতত্বের কাছে। [email protected]
×