ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

চীনে লাখ লাখ শিশু যৌন নিগ্রহের শিকার

প্রকাশিত: ০৬:৪৬, ৫ অক্টোবর ২০১৬

চীনে লাখ লাখ শিশু যৌন নিগ্রহের শিকার

চীনে যৌন নিগ্রহের শিকার শিশুর সংখ্যা কয়েক লাখ। এই অপরাধ নিয়ে প্রকাশ্যে আলোচনা কর্মকর্তারা এতদিন পারতপক্ষে এড়িয়ে চলত। সম্প্রতি তারা নির্যাতিতদের দুর্ভোগের কথা স্বীকার করতে শুরু করেছে। শিশুদের যৌন নিগ্রহ সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য বেজিংয়ে গার্লস প্রটেকশন ফাউন্ডেশন নামে একটি সাহায্য সংস্থা গঠিত হয়েছে। গত মে মাসে সংস্থার পরিচালিত একটি সমীক্ষায় দেখানো হয় যে ২০১৩ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে শিশু যৌন নিগ্রহের ৯৬৮টি ঘটনার কথা মিডিয়ায় এসেছে যেখানে এই নির্যাতনের শিকার হয়েছে ১ হাজার ৭৯০ জন। প্রতিটি প্রকাশিত ঘটনার স্থলে থাকে কমপক্ষে ৭টি অপ্রকাশিত ঘটনা। সে হিসেবে ওই সময়ের মধ্যে চীনে ১২ হাজার শিশুর ওপর যৌন নিপীড়ন চালানো হয়েছে। অনলাইনে এর ওপর নানাজনের নানা মন্তব্য এসেছে। একজন বলেছে, ‘শিশু যৌন নিগ্রহের এত বেশি ঘটনা এর আগে কখনও শুনিনি।’ আরেকজনের মন্তব্য : ‘পাঁচ বছর আগেও যেখানে এমন ঘটনা কদাচিৎ শোনা যেত এখন এতসব কাহিনী মিডিয়ায় আসছে কিভাবে?’ এর জবাব হলো সামাজিক মনোভঙ্গি বদলে যাচ্ছে। আগে এ সমস্যা নিয়ে প্রকাশ্যে আলোচনা এক ধরনের ট্যাবু (নিষিদ্ধ ব্যাপার) হিসেবে গণ্য হতো। এখন আর হয় না। ২০১৫ সালে স্থানীয় সমীক্ষার ভিত্তিতে ফু’র জন্য প্রণীত এক রিপোর্টে বলা হয়, চীনে ৯.৫ শতাংশ মেয়ে ও ৮ শতাংশ ছেলে প্রাপ্তবয়স্কদের হাতে কোন না কোনভাবে যৌন নিগ্রহের শিকার হয়েছে। অনাকাক্সিক্ষত দৈহিক স্পর্শ থেকে শুরু করে ধর্ষণ সবই ছিল এর মধ্যে। ছেলেদের ক্ষেত্রে এই হারটা বৈশ্বিক হারের সমান। আর মেয়েদের ওই হারটা বৈশ্বিক হারের কিছু কম। দেশটার বিশালত্বের কারণে চূড়ান্ত সংখ্যাটা বের করা দারুণ কষ্টকর ব্যাপার। তথাপি ধরে নেয়া যায় যে ১৮ বছরের কম সম্ভবত আড়াই কোটি চীনা ছেলেমেয়ে যৌন নিগ্রহের শিকার। চীনারা তাদের পারিবারিক নিরাপত্তা নিয়ে গর্ববোধ করে থাকে। তার পরও সন্তানরা প্রায় বৈশ্বিক গড় হারে যৌন নিগ্রহের শিকার কেন তা ভেবে অনেকে বিস্মিত। আসলে বিস্মিত হওয়ার কারণ নেই। কেননা অন্যসব জায়গার মতো চীনেও শিশুরা তাদের এ সংক্রান্ত অভিজ্ঞতা গোপন রাখে বা চেপে যায়। মূল চীনের তুলনায় হংকংয়ে সেক্স নিয়ে অপেক্ষাকৃত খোলামেলা আলোচনা হয়। সেখানেও এক সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, ২০০২ সাল থেকে জরিপকৃত যৌন হয়রানির শিকার ৬০ শতাংশ ছেলে ও ৬৮ শতাংশ মেয়ে তাদের ওপর এই নিগ্রহের কথা কাউকে বলেনি। এই না-প্রকাশ করার হারটা পাশ্চাত্যের তুলনায় যথেষ্ট বেশি। যে কোন দেশে শিশু যৌন নিগ্রহের সংখ্যা নিরূপণ করা কঠিন। চীনে তো আরও বেশি। কারণ চীনে কখনই এ নিয়ে দেশব্যাপী জরিপ চালানো হয়নি। তার পরও যেটুকু তথ্য পরিসংখ্যান পাওয়া গেছে তার ভিত্তিতে বলা চলে যৌন নিগ্রহের দিক থেকে চীনেই শিশুরা বা ছেলেমেয়েরা ক্রমবর্ধমান হুমকির মুখে এবং সেটা বিশ্বাস করার কারণও আছে। প্রথমত, চীনে বাবা-মা কর্তৃক স্বজনদের কাছে রেখে যাওয়া শিশুর সংখ্যা বিশাল। ইউনিসেফের এক তথ্য অনুযায়ী ১৭ বছরের কম বয়সী ৬ কোটি ১০ লাখ ছেলেমেয়েকে গ্রামের বাড়িতে রেখে বাবা-মা অন্যত্র কাজ করতে চলে গেছে। ৩ কোটিরও বেশি ছেলেমেয়ে বাবা-মা থেকে এমনকি দাদা-দাদি থেকে অনেক দূরে গ্রামের বোর্ডিং-স্কুলে থাকে। এদের কারোর বয়স চার বছর। আরও সাড়ে তিন কোটিরও বেশি ছেলেমেয়ে বাবা-মার সঙ্গে অন্য শহরে পাড়ি জমিয়েছে। তবে তাদের বাবা-মা এত ব্যস্ত থাকে যে সন্তানদের ঠিকমতো দেখাশোনা করতে পারে না। স্বজনদের কাছে রেখে যাওয়া প্রায় ১ কোটি শিশুর সঙ্গে তাদের বাবা-মায়ের বছরে একবার দেখা হয়। মাঝে মাঝে টেলিফোনে তাদের কথা হয় বটে, তবে টেলিফোনে তারা যৌন নিগ্রহের মতো স্পর্শকাতর বিষয় বাবা-মাকে বলতে পারে না। বিপন্নতা বেশি বলেই এই ধরনের রেখে যাওয়া ছেলেমেয়ের যৌন হয়রানির শিকার হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। আরেকটা ঝুঁকির বিষয় হলো অজ্ঞতা, লজ্জা ও আইনগত অনিশ্চয়তার কারণে এই ছেলেমেয়েদের পক্ষে নিজেদের রক্ষা করা অনেক কঠিন হয়ে পড়ে। চীনে যৌন শিক্ষা এক বিরল ব্যাপার। যৌন হয়রানির প্রসঙ্গ কখনও তোলা হয় না। ‘গার্লস প্রোটেকশন ফাউন্ডেশন’ নামক এনজিও জানায় যে গত বছর এক সমীক্ষায় তারা মাধ্যমিক স্কুলের ৪ হাজার ৭শ’ ছেলেমেয়েকে জিজ্ঞেস করেছিল ‘গোপনাঙ্গ’ বলতে কি বোঝায়। জবাবে ৪৫ শতাংশ ছেলেমেয়ে বলেছে তারা জানে না। বিষয়টি কর্তৃপক্ষের গোচরীভূত করলে তারা তেমন কিছুই করেনি। চীনে যৌন অপরাধীদের কোন জাতীয় রেজিস্টার নেই। যৌন অপরাধের ক্ষেত্রে সুবিকশিত কোন আইন নেই। তার ফলে যৌন নিগ্রহের শিকাররা প্রায়ই সুবিচার থেকে বঞ্চিত হয়। লিয়াওনিং প্রদেশে একবার ১২ থেকে ১৭ বছর বয়সী ৮ জন স্কুল পড়ুয়া মেয়েকে অপহরণ করে হোটেল রুমে নেয়া হয়। সেখানে তাদের নগ্ন করে পুরুষরা পালাক্রমে ধর্ষণ করে। একজনকে ধর্ষণের সময় বাকি মেয়েদের তা দেখতে বাধ্য করে এতে না চাইলে প্রহার করে। পুরুষদের কাছ থেকে এক এক ভিজিটের জন্য ২৭০ ডলার দেয়া হয়। পরে এরা ধরে পড়ে। পুরুষদের বিরুদ্ধে অল্প বয়সী পতিতাদের সঙ্গে যৌনকর্মে লিপ্ত হওয়ার অভিযোগ আনা হয়। ওই অভিযোগ শুনে যৌন নিগৃহীতরা লজ্জায় চুপ হয়ে গিয়েছিল। তবে আরেকটা দিক হলো চীন এখন যৌনতার ক্ষেত্রে বিপ্লবের মাঝামাঝি পর্যায়ে আছে। বিয়ের আগে সেক্স অধিকতর সাধারণ ব্যাপার। প্রথম যৌন অভিজ্ঞতার বয়স কমে আসছে। কিছু কিছু গবেষক মনে করেন যৌনতার ক্ষেত্রে এই পরিবর্তনের সঙ্গে শিশুদের বিরুদ্ধে যৌন নিগ্রহের একটা সম্পর্ক আছে। চলমান ডেস্ক সূত্র : দি ইকোনমিস্ট
×