ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

শ্রাবণী আক্তার সান

প্রতিপক্ষ এবার বদলে যাওয়া ইংল্যান্ড

প্রকাশিত: ০৬:৩২, ৫ অক্টোবর ২০১৬

প্রতিপক্ষ এবার বদলে যাওয়া ইংল্যান্ড

ঘরের মাটিতে অপ্রতিরোধ্য বাংলাদেশ। র‌্যাঙ্কিংয়ের ছয়ে উঠে আসার পথে টাইগাররা একে একে ভূপতিত করেছে পাকিস্তান, ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকার মতো পরাশক্তিকে। এমন কি গত বিশ্বকাপে এই ইংল্যান্ডকে গ্রুপপর্ব থেকে বিদায় করে দিয়েছিল মাশরাফি-বাহিনী। অনেকে তাই এবারও বাংলাদেশকে নিয়ে অতি উৎসাহী। কিন্তু মাঝের সময়টাতে রঙিন পোশাকের ইংল্যান্ড যে কতটা বদলে গেছে, অনেকেই সেটি ভাবছেন না। ভয় ডরহীন ক্রিকেট খেলে পঞ্চাশ ওভারের ম্যাচে আলোচিত ইয়ন মরগান-জস বাটলাররা। যদিও নিরাপত্তার অজুহাতে বাংলাদেশে আসেনি নিয়মিত ওয়ানডে অধিনায়ক মরগান। তবে বাটলারের অধীনে এই ইংল্যান্ডও কম ভয়ঙ্কর নয়। আছেন জেসন রয়, জনি বেয়ারস্টো, বেন স্টোকসের মতো ব্যাটসম্যান, স্পিনে মঈন আলি, আদিল রশীদ, পেস আক্রমণে স্টিভেন ফিন, লিয়াম প্লাঙ্কেট। সঙ্গে তরুণ ব্যাটসম্যান বেন ডাকেটের কথাও আলাদা করে বলতে হয়। সুতরাং অতি আত্মবিশ্বাসী বাংলাদেশকে হতাশায় ডোবাতে পারে বদলে যাওয়া ইংল্যান্ড। নিয়মিত ওয়ানডে অধিনায়ক ইয়ন মরগান আসেননি, একই পথ বেছে নিয়েছেন দলটির হালের অন্যতম সফল ব্যাটসম্যান এ্যালেক্স হেলসও। জস বাটলারের নেতৃত্বাধীন রঙিন পোশাকের ইংল্যান্ড তাই তারুণ্যনির্ভর। ঘরের মাটিতে অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠা বাংলাদেশ অতিথিদের জন্য যে চ্যালেঞ্জিং হবে- ঢাকায় পা রেখেই সেটি তারা স্বীকার করছেন। তবে উল্টো টাইগারদের জন্য হুমকি হতে পারেন আনকোড়া এক ইংলিশ ব্যাটসম্যান। নাম তার বেন ডাকেট। সম্প্রতি দেশটির ঘরোয়া ক্রিকেটে আলো ছড়িয়ে আলোচনায় ২১ বছর বয়সী কেন্ট-বিস্ময়। এক কথায় অবিশ্বাস্য ব্যাটিং করে প্রথমবারের মতো জাতীয় দলে জায়গা করে নিয়েছেন তিনি। মরগান-হেলসদের অনুপস্থিতিতে একাদশেও যে ঢুকে পড়বেন সেটিও অনুমিত। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, এবারের কাউন্টি ও রয়্যালস কাপের সেরা ক্রিকেটার বাংলাদেশের বিপক্ষে সিরিজে ইংলিশদের ‘তুরুপের তাস’ হিসেবে আবির্ভূত হতে পারেন। এমনকি বাঁ-হাতি রোমাঞ্চকর ব্যাটসম্যান হতে পারেন নতুন আন্তর্জাতিক আবিষ্কার। ডাকেট এই গ্রীষ্মে ২,৭০৬ রান করেছেন। গত সপ্তাহেই প্রথম ইংলিশ ক্রিকেটার হিসেবে একই সঙ্গে ইংল্যান্ড এ্যান্ড ওয়েলস ক্রিকেট বোর্ডের (ইসিবি) ‘ঘরোয়া বর্ষসেরা’ ও ‘বর্ষসেরা তরুণ’ খেলোয়াড়ের দু-দুটি পুরস্কার পকেটে পুড়েছেন। স্থানীয়ভাবে যেটিকে ‘অনন্য ডাবল’ বলে আখ্যায়িত করা হচ্ছে। কিভাবে এতটা সফল তিনি? ঢাকায় পা রেখে ডাকেন বলেন,‘আমি যেমন নই, তেমনটি খেলতে গিয়েই আগে ব্যর্থ হতাম। আর এখন আমি আমার মতো করে খেলি!’ ডাকেট জানেন, মরগান-হেলসের মতো গুরুত্বপূর্ণ দুই ক্রিকেটারের শূন্যতা পূরণের জন্যই তাকে ডাকা হয়েছে। জানেন দারুণ কিছুই করে দেখাতে হবে। সুযোগটা নিতে দু-হাত বাড়িয়ে অপেক্ষায় আছেন,‘অল্প বয়সেই আমি এমন একটি সফরে দলের সঙ্গী হতে পেরেছি। তাই খুব ভাল লাগছে। যতটুকো সুযোগ পাব তার পুরোটার সদ্ব্যবহার করতে চাই।’ এবার জেনে নেয়া যাক কেন তাকে নিয়ে এত আলোচনা? ইংল্যান্ডে এই মৌসুমটা শুরুই করেছেন ২৮২ রানের ম্যারাথন ইনিংস দিয়ে। এরপর হাঁকিয়েছেন আরও দুটি ডাবল সেঞ্চুরি। ইংল্যান্ড লায়ন্সের হয়ে শ্রীলঙ্কা ‘এ’ দলের বিপক্ষে অপরাজিত ২২০। পাকিস্তান ‘এ’ দলের বিপক্ষে খেলেন ১৬৩ রানের ইনিংস। রয়্যাল লন্ডন ওয়ানডে কাপে নর্দাম্পটনশায়ারের হয়ে পঞ্চাশ ওভারের ম্যাচেও রয়েছে সেঞ্চুরি। কাউন্টি চ্যাম্পিয়নশিপে একটি ডাবল ও দুটি সেঞ্চুরি। সর্বশেষ ৬ সেপ্টেম্বর কেন্টের বিপক্ষে খেলেছেন ২০৮ রানের মনোমুগ্ধকর ইনিংস। নামের সঙ্গে ‘রান-মেশিন’ উপমাও আর যথেষ্ট নয়! লিস্ট-এ ক্রিকেটে গত জুলাই মাসেই করেছেন ৬৫০ রান, গড় ১৩০.০০! আর চ্যাম্পিয়নশিপে পাওয়া চার সেঞ্চুরির ছোট্টটি ১৮৫ রানের। দীর্ঘ পরিসরে রান ১,৩৩৮ রান। স্ট্রাইক রেট ৭৯.৪৫! এমন ব্যাটিংয়ের পর তাঁকে নিয়ে আলোচনা না হলে সেটিই বরং অস্বাভাবিক। প্রয়োজনে ক্ল্যাসিক্যাল, কিংবা মারদাঙ্গা, ক্রিজে নামলে থামাথামি নেই। আগ্রাসী ব্যাটসম্যানের অভিষেকটা হয়ত সময়ের ব্যাপার। ৭ অক্টোবর মিরপুরে প্রথম ওয়ানডে, তার আগে মঙ্গলবার ফতুল্লায় বিসিবি একাদশের বিপক্ষে একটি একদিবসীয় প্রস্তুতি, সেখান থেকেই কি শুরু ডাকেট-ঝলক? মরগান-হেলস নেই, ওয়ানডেতে বিশ্রাম দেয়া হয়েছে সময়ের সেরা জো রুটকে। ইংলিশ টপ-অর্ডারে তাই কিছুটা হলেও শূন্যতা। ডাকেট ওয়ানডে অভিষেকেই জেসন রয়ের সঙ্গে ওপেনিংয়ের সুযোগটা পেয়ে যেতে পারেন। টেস্টে অবশ্য নিয়মিত ওপেনার অধিনায়ক এ্যালিস্টার কুকের সঙ্গী হতে টিন-এজার হামিদ হাসিবের সঙ্গে লড়তে হবে। ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকত নিরাপত্তারক্ষী। সকালে দরজা খুললেই সবার আগে চোখে পড়ত বুট আর বন্দুক। পাকিস্তান সফরের বিভীষিকা ভুলতে পারেন না পল ফারব্রেস। সেই তুলনায় বাংলাদেশে অনেক বেশি স্বস্তিতে আছেন, জানালেন ইংল্যান্ডের সহকারী কোচ। ২০০৯ সালে লাহোরে শ্রীলঙ্কা ক্রিকেট দলের ওপর সন্ত্রাসী হামলার সময় ওই বাসেই ছিলেন ফারব্রেস। তখন তিনি লঙ্কানদের সহকারী কোচ। ওই হামলার পর আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এক রকম একঘরে হয়ে যায় পাকিস্তান। গত জুলাইয়ে গুলশানে সন্ত্রাসী হামলার পর বাংলাদেশেও ইংল্যান্ডের আসা নিয়ে ছিল শঙ্কা। তবে ফারব্রেস সফরে আসার ব্যাপারে শুরু থেকেই ছিলেন ইতিবাচক। বাংলাদেশে এসেও অস্বস্তিকর কিছু খুঁজে পাচ্ছেন না সহকারী কোচ, ‘ভাল ব্যাপার হলো, বাংলাদেশে শেষবার আমরা এসে যেমন দেখেছিলাম, তার চেয়ে এবার ভিন্ন কিছু দেখছি না। হোটেলে আমাদের ঘাড়ের ওপর কেউ দাঁড়িয়ে নেই। পাকিস্তানে যেমন নিরাপত্তারক্ষী দরজার বাইরে বসে থাকত অস্ত্র হাতে। সকালে ঘুম থেকে উঠে প্রথমেই চোখে পড়ত বুট আর বন্দুকের বাট।’ তিনি আরও যোগ করেন, ‘এখানে পরিস্থিতি সেরকম নয়। এখানে থাকলেই কেবল বোঝা যাবে। সবাই কথা বলতে চায় ক্রিকেট নিয়েই। আমার মনে হয় না, এর চেয়ে ভাল জায়গায় আমরা থাকতে পারতাম।’ মুখোমুখি লড়াইয়ের সাম্প্রতিক ইতিহাস বাংলাদেশের পক্ষে। উইকেট-কন্ডিশনও প্রতিপক্ষ ইংলিশদের। তবে সাম্প্রতিক সময়ে দারুণ আগ্রাসী ক্রিকেট খেলে নজর কাড়া ইংল্যান্ড একইভাবে বাংলাদেশের চ্যালেঞ্জ জিততে চায়। আর অধিনায়ক জস বাটলারের চূড়ান্ত লক্ষ্য ওয়ানডের বিশ্বসেরা দল হওয়া। দুই দলের সবশেষ চার ম্যাচের তিনটিতেই জিতেছে বাংলাদেশ। সবশেষটি ছিল গত বছর বিশ্বকাপে। এ্যাডিলেইডে ইংল্যান্ডকে বিদায় করেই কোয়ার্টার-ফাইনালের টিকেট পায় বাংলাদেশ। তবে সেই ব্যর্থতা থেকেই শুরু বাঁকবদলের। তলানিতে ঠেকার পর দারুণভাবে উঠে আসে ইংল্যান্ড। নিজেদের পরিচিত ঘরানা থেকে বেরিয়ে এসে অসাধারণ আক্রমণাত্মক ক্রিকেট খেলে গত দেড় বছরে তারা পেয়েছে দারুণ সব সাফল্য। দেশের মাটিতে বাংলাদেশের টানা ছয় সিরিজ জয় ও কন্ডিশন বিচেনায় সিরিজে বাংলাদেশ একটু হলেও এগিয়ে থাকবে কিনা, সংবাদ সম্মেলনে এই প্রশ্নে মুচকি হেসে বাটলার বললেন, ‘হতে পারে!’ তবে পরক্ষণেই অধিনায়কের কণ্ঠে আগ্রাসী ক্রিকেট খেলার প্রতিজ্ঞা, ‘গত দেড় বছর ধরে আমরা খুব ভাল করছি এবং রোমাঞ্চকর ঘরানার ক্রিকেট খেলছি। এখানে কন্ডিশনের অবশ্যই ভূমিকা থাকবে খেলার ধরনে। তবে আমি ছেলেদের বলব সামনে এগিয়ে আক্রমণ করতে।’ দেশের মাটিতে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ফর্ম জানা আছে বাটলারের। তবে এই চ্যালেঞ্জ জেতার প্রত্যয় তো আছেই, ইংল্যান্ডের ভারপ্রাপ্ত অধিনায়কের দৃষ্টি আরও দূরে, ‘নিজের কন্ডিশনে বাংলাদেশ দারুণ সাফল্য পেয়েছে। তবে আমরা সাধারণত নিজেদের দিকেই মন দেয়ার চেষ্টা করি। দারুণ কিছু তরুণ নিয়ে প্রতিভাবান এক দল আমাদের। সাফল্যের পথে এগিয়ে যেতে ক্ষুধার্ত ওরা। আমরা বিশ্বের সেরা ওয়ানডে দল হতে চাই। সেটা করতে হলে, সব ধরনের কন্ডিশনেই মানিয়ে নিতে হবে।’
×