ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

জাহিদুল আলম জয়, সিলেট থেকে ফিরে

পুণ্যভূমিতে পথহারা ফুটবল!

প্রকাশিত: ০৬:৩২, ৫ অক্টোবর ২০১৬

পুণ্যভূমিতে পথহারা ফুটবল!

সব মুশকিলের আসান বলা হয় সিলেটকে। পবিত্র এ ভূমিতে খাসদিলে চাইলে নাকি সব চাওয়া পূর্ণ হয়। তাইতো সুরমা নদীর তীরবর্তী শহরটির আরেক নাম ‘পুণ্যভূমি’। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যম-িত এ শহরের পাহাড়ের অপরূপ দৃশ্য, জাফলংয়ের মনোমুগ্ধকর সৌন্দর্য, ভোলাগঞ্জের সারি সারি পাথরের স্তূপ টেনে আনে পর্যটকদের। পুণ্যভূমি সিলেটের ক্রীড়াঙ্গনও একসময় পরিপূর্ণ ছিল। বিশেষ করে ফুটবল। কিন্তু সময়ের বিবর্তণে ‘দুটি পাতা একটি কুঁড়ি’র দেশের ফুটবল এখন অনেকটাই মৃতপ্রায়! সুদিন হারিয়ে রীতিমতো ধুঁকছে সিলেটের ফুটবল। সেই উৎসব, সেই উন্মাদনা, গ্যালারি ভর্তি দর্শক এখন আর নেই। সদ্য শেষ হওয়া বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ ফুটবলের (বিপিএল) সিলেট পর্বের প্রথম লেগের ম্যাচগুলোতে এ প্রমাণ মিলেছে। অথচ একটা সময় সিলেটের ফুটবল ছিল গর্বের। ইতিহাস ও ঐতিহ্য সে স্বাক্ষরই দেয়। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সিলেট অবকাঠামোগত দিকে যতটা এগিয়েছে ঠিক ততটাই পিছিয়েছে ক্রীড়াঙ্গনে। খেলাধুলা ফেলে কর্মকর্তারা জড়িয়ে পড়েছেন রাজনীতিতে। একসময় জাতীয় পর্যায়ে ফুটবল ও ক্রিকেটে সিলেটের সুনাম থাকলেও এখন আর তা নেই। জাতীয় ফুটবলে সর্বশেষ ১৯৮৩ সালে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল সিলেট। সেই রমরমা অবস্থা আর নেই। মাঠের খেলায় মনোযোগী না থেকে কর্তাদের প্রতিযোগিতা হয় চেয়ার দখলে। যার পরিণতি পুণ্যভূমিতে পথহারা ফুটবল। এই যুগে ঢাকার মাঠে ফুটবল দেখতে দর্শকরা গ্যালারিতে যান না বললেই চলে। এ কারণে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন (বাফুফে) জেলা শহরগুলোতে বেশি বেশি ম্যাচ আয়োজনের সিদ্ধান্ত নেয়। ফলও আসতে শুরু করে। এক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে সিলেট। ফুটবলের হাহাকার সময়ে এই শহরটি যেন স্বর্ণযুগ ফিরিয়ে আনার পণ করে। যে কোন আসরেই সিলেটের স্টেডিয়ামে দর্শক জোয়ার দেখা যায়। গত দুই বছর এ প্রমাণ মিলেছে। ২০১৫ সালে বঙ্গবন্ধু কাপ ও সাফ অনুর্ধ-১৬ চ্যাম্পিয়নশিপে গ্যালারি ছিল উন্মাতাল। দর্শক জোয়ারে নতুন প্রাণ আসে। ২০১৪ সালের আগস্টে নেপাল অনুর্ধ-২৩ দলের সঙ্গে বাংলাদেশের ম্যাচেও ছিল দর্শক ঢেউ। সিলেট জেলা স্টেডিয়ামে এমন জনসমুদ্র দেখে ফুটবল কর্তারা নতুন করে স্বপ্ন বুনতে থাকেন। এখানে ফুটবলের দ্বিতীয় হোম গ্রাউন্ড বানাতে চায় বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন। দেশের একমাত্র ফুটবল একাডেমিও এখানে করা হয়েছে। লক্ষ্য একটাই, আধ্যাত্মিক আর পর্যটননগরী যেন ফুটবলের সোনালি সুদিন ফিরে পায়। কিন্তু এবার বিপিএলে দর্শকরা আর চরম অব্যবস্থাপনা আবারও ফুটবলের জন্য অশনিসংকেত হিসেবে দেখছেন অনেকে। গত বছরও সিলেট স্টেডিয়াম দর্শকে টইটুম্বর ছিল। হঠাৎ কি এমন হলো যে দর্শক হারিয়ে গেল? এমন প্রশ্ন ফুটবলপ্রেমী সবার মধ্যে। সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, বিপিএল ফুটবল হচ্ছে অথচ বেশিরভাগ মানুষ জানেই না! এর মধ্যেও যারা মাঠে আসছেন তাদের নিখাদ খেলাপ্রেমী বলতেই হবে। এমনই একজন মধ্যবয়সী শামসুর রহমান। ব্রাদার্স ইউনিয়ন ও শেখ জামাল ধানম-ির মধ্যকার ৯ গোলের ম্যাচ দেখে তিনি মহাখুশি। ব্যবসা নিয়ে ব্যস্ত থাকেন, তবু মাঠে আসার চেষ্টা করেন। গ্যালারিতে দর্শক নেই কেন? শামসুরকে এই প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, দর্শক কিভাবে আসবে ভাই। খেলা হচ্ছে এই খবরই জানে না মানুষ। তাহলে আপনি আসলেন যে? দেখেন, আমি ফুটবলের ভক্ত। নব্বইয়ের দশক থেকে খেলা দেখছি নিয়মিত। ভালবাসার টানেই আসি। কিন্তু সবাই তো এমন না। আকৃষ্ট করার জন্য, মাঠে দর্শক আনার জন্য অনেক কিছুই করা যায়। ফুটবল ভালবাসার এমন মানুষের অভাব নেই সিলেটে। ২৬ সেপ্টেম্বর স্টেডিয়ামে যাওয়ার উদ্দেশ্যে রিক্সায় উঠলাম। গন্তব্য বলতেই চালক ফারুক বললেন, খেলা দেখবার আইছেন স্যার। খুব ভাল খেলা হইতাছে। আমিও খেলা দেখুম। নিজ থেকেই এই খেলাপ্রেমী বলেন, ‘ফুটবল আমার খুব ভাললাগে। ছোটবেলায় মেলা খেলছি।’ ক্রিকেট দেখেন না? না, ‘ভাললাগে না, ফুটবল বেশি ভাললাগে।’ এখনকার যুবক, তরুণদের ক্রিকেটটাই বেশি টানে। তবে ১৮ বছরের যুবক আকাশ রাজ অকপটে বলেন, ‘ফুটবল এক নম্বর খেলা, এরপর অন্যকিছু। ফুটবলের প্রতি এমন ভালবাসা মিশ্রিত মুগ্ধতার কথা শোনান হোসেন আহমেদ, বাহার উদ্দিন, কবির আহমেদরা। ফুটবল নিয়ে সাধারণ মানুষের এত ভালবাসা, আবেগ থাকার পরও আচমকা কেন প্রাণহীন, ফ্যাকাশে হয়ে গেল সিলেটের ফুটবল। কেন চোখ ফিরিয়ে নিলেন দর্শকরা? কারণটা জানা গেল সিলেট জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক মাহিউদ্দিন আহমদ সেলিমের কাছে। তিনি বিপিএলে দর্শক না হওয়ার জন্য স্পন্সর প্রতিষ্ঠান ‘সাইফ গ্লোবাল স্পোর্টস’কে দায়ী করেন। তারা নাকি তেমন প্রচারণাই করেনি! মাহিউদ্দিন সেলিম জানান, স্পন্সর প্রতিষ্ঠান উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের কনসার্ট নিয়েই ব্যস্ত ছিল। মাঠের খেলা নিয়ে তাদের তোড়জোড় ছিল না। বিপিএল ঘিরে শুধু সিলেট জেলা স্টেডিয়ামের চারদিকেই প্রচারণা সীমাবদ্ধ থেকেছে। তাও সীমিত পরিসরে। সমালোচনার ঢেউ যখন সীমা অতিক্রম করেছে তখন লোক দেখানো প্রচারণা বাড়ানো হয়। এরপরও কাজের কাজ কিছুই হয়নি। স্টেডিয়ামের আশপাশেই বসবাস, কিন্তু অনেকে জানেন না খেলা হচ্ছে। অথচ এই স্টেডিয়ামেই গত দুবছর উপচেপড়া দর্শক মাঠে এসেছিল। স্টেডিয়াম ছিল পরিপূর্ণ, বাইরে হাজার হাজার দর্শক অপেক্ষায় ছিলেন। এ কারণেই বিপিএলে দর্শক হবে এমন আশা করছিলেন সবাই। কিন্তু ভাবলে তো আর হবে না! এজন্য কাজও করতে হবে। সিলেটবাসী ঠিকমতো জানেই না খেলা হচ্ছে। অভ্যন্তরণীর দ্বন্দ্বের কারণেই এমন হয়েছে। সিলেট জেলা ক্রীড়া সংস্থা আর সাইফ গ্লোবাল মুখোমখি অবস্থানে থাকে। কে কাজে নাজেহাল করতে পারে আর কি! টাকা দিয়ে স্বত্ব কিনে নেয়ায় স্পন্সর প্রতিষ্ঠানই হর্তাকর্তা। জেলা ক্রীড়া সংস্থা হয়ে পড়েছে অসহায়। কতটা নিরুপায় তা বোঝা যায় মাহিউদ্দিন সেলিমের কথাতে। একদিন প্রেসবক্সে এসে তিনি বলেন, ‘আমার আসলে কিছু করার নেই’। এক কথায় ফুটবল ফেডারেশন, জেলা ক্রীড়া সংস্থা ও স্পন্সর প্রতিষ্ঠানের মধ্যে কোন সমন্বয় নেই। যে কারণে সম্ভাবনার সিলেট ফুটবলে এখন হ-য-ব-র-ল অবস্থা। এরপরও জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদককে প্রশ্ন ছোড়া হয়, ‘সাধরণ মানুষ তো আর বুঝবে না, দায় আপনাদেরও হবে?’ বাস্তবতা স্বীকার করে মাহিউদ্দিন সেলিম বলেন, এটা ঠিক। কিন্তু আমাদের করার কিছু ছিল না। সব কর্তৃত্ব ছিল স্পন্সর প্রতিষ্ঠানের হাতে। গত ফেব্রুয়ারিতে সিলেট জেলা ক্রীড়া সংস্থার দায়িত্ব পেয়েছেন সেলিম। বর্তমানে দর্শকভাটা থাকলেও তার স্বপ্ন আবারও স্টেডিয়াম ভরপুর হবে। এ প্রসঙ্গে তিনি ক্রিকেটকে সামনে নিয়ে আসেন। বলেন, ক্রিকেটের আজকের এই সাফল্যের পেছনে ইন্টার স্কুল ও বয়সভিত্তিক টুর্নামেন্টের অবদান সবচেয়ে বেশি। ইন্টার স্কুল, কলেজ ও বিভিন্ন বয়সভিত্তিক দল নিয়মিত ক্রিকেট খেলে। এর ফলও পাচ্ছে ক্রিকেট। কিন্তু ফুটবলে এসব নেই। ফুটবলে ইন্টার স্কুল টুর্নামেন্ট শুরু করব আমরা। বয়সভিত্তিক অনুর্ধ-১৪, ১৬ ও ১৮ টুর্নামেন্ট করতে যাচ্ছি। আশা করছি এগুলো শুরু হলে ফুটবলের জনপ্রিয়তা ফিরে আসবে। এখন জনপ্রিয়তা হারিয়ে ধুকলেও একসময় সিলেটের ফুটবল ছিল চাঙ্গা। এই শহর থেকে অনেক নামজাদা ফুটবলার উঠে এসেছেন। স্বনামে খেলেছেন বাংলাদেশ জাতীয় দলে। যুগে যুগে আলোকিত করা সেসব তারকাদের মধ্যে অন্যতম বি রায় চৌধুরী, রণজিত দাস, কামরুজ্জামান, প্রবীর রঞ্জন দাস ভানু, রামা লুসাই, দিলীপ দাস, কার্জন, কায়সার হামিদ, জুয়েল রানা, আলফাজ, ওয়াহেদ, তকলিছ। এদের বেশিরভাগই দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বিদেশে তুলে ধরেছেন সিলেটকে। রমরমা সিলেটের সেই ফুটবল এখন রুগ্ন। মনটা তাই কাঁদে এ জেলার সাবেক তারকা ও খেলাসংশ্লিষ্টদের। সাবেক জাতীয় ফুটবলার আলফাজ আহমেদ ব্যথিত কণ্ঠে জনকণ্ঠকে বলেন, সিলেটে বাংলাদেশ অনুর্ধ-১৬ দল চ্যাম্পিয়ন হলে গোটা দেশ আনন্দের জোয়ারে ভেসে যায়। বাফুফের উচিত ছিল ওই দলকে নিজেদের আয়ত্তে রাখা। তাদের প্রশিক্ষণ দেয়া। অথচ তাদের ছেড়ে দেয়া হলো। একটা ছেলে নষ্ট হওয়ার জন্য এক মাস ডিসিপ্লিনের বাইরে থাকাই যথেষ্ট। স্থানীয় ক্রীড়াসাংবাদিক মান্না চৌধুরী দীর্ঘদিন ধরে পর্যবেক্ষণ করছেন সিলেটের ফুটবল। তিনি বর্তমানের বেহাল অবস্থার জন্য অব্যবস্থাপনাকে দায়ী করেন। মান্না চৌধুরী বলেন, সিলেটে ফুটবল মানেই দর্শক। কিন্তু এবার বিপিএলে দর্শক নেই। এজন্য দায়ী আয়োজকরাই। স্পন্সর প্রতিষ্ঠান, জেলা ক্রীড়া সংস্থা ও ফুটবল ফেডারেশনের মধ্যে কোন সমন্বয় নেই। ফুটবলের বেশিরভাগ দর্শক আসে গ্রাম থেকে। কিন্তু তারা জানতেই পারছে না খেলা হচ্ছে। সিলেট ফুটবলের সমৃদ্ধ ইতিহাস স্মৃতিচারণ করে মান্না চৌধুরী বলেন, ১৯৩০ থেকে ৯০ পর্যন্ত সমৃদ্ধ ছিল এ অঞ্চলের ফুটবল। নব্বইয়ের দশকের শেষভাগ আর ২০০০ সালের শুরুর দিকে এলোমেলো হয়ে যায় সবকিছু। আগে বয়সভিত্তিক ফুটবল, প্রথম ও দ্বিতীয় বিভাগ নিয়মিত হতো, এখন এসবের খোঁজ নেই। সিলেটে এখন ফুটবল আছে বলেই কেউ জানে না!
×