ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ইতিহাসের পাতায় তামিম

প্রকাশিত: ০৬:৩০, ৫ অক্টোবর ২০১৬

ইতিহাসের পাতায় তামিম

ধারাবাহিকতা ক্রিকেটে সবচেয়ে বড় বিষয়। যে কোন ক্রিকেটারের মান ও পর্যায়টা এখান থেকেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ২০০৭ সালের শুরুতে অভিষেক হওয়ার পর চলতি বছরের মাঝামাঝি ক্যারিয়ারের দশম বছরের শেষ পর্যায়ে আছেন বাংলাদেশের বাঁ-হাতি ওপেনার তামিম ইকবাল। ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে এই ধারাবাহিকতা নিয়ে অনেক আলোচনা, সমালোচনা শুনতে হয়েছে তাকে। কারণ, দুয়েকটি ম্যাচে দুর্দান্ত ইনিংস খেলার পরও যদি বাজে রকমের ব্যাটিং প্রদর্শন করে কোন ব্যাটসম্যান সেক্ষেত্রে তীর্যক কথার মুখোমুখি হতে হয়। তবে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বছর তিনেক পেরোতেই তা কাটিয়ে একের পর এক ধারাবাহিক ইনিংস উপহার দিয়েছেন তামিম। ক্রীড়াক্ষেত্রে একটি কথা বলা হয়ে থাকে- ‘ফর্ম ইজ টেম্পোরারি, বাট ক্লাস ইজ পার্মান্টে।’ তামিম কোন পর্যায়ের ব্যাটসম্যান সেটার প্রমাণ তিনি দিয়েছেন তার চিরস্থায়ী ব্যাটিং ক্লাসের প্রদর্শনী দেখিয়ে। গত এক বছরে তার ব্যাট থেকে একের পর এক বড় বড় ইনিংস বেরিয়েছে ধারাবাহিকভাবে। আর হয়ে উঠেছেন বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে সর্বকালের সেরা ব্যাটসম্যান। কারণ তার তিন ফরমেট- টি-২০, ওয়ানডে ও টেস্টে দেশের পক্ষে সর্বাধিক রান। একইসঙ্গে তিন ফরমেটেই তিনি সর্বাধিক সেঞ্চুরিরও মালিক। যে তামিমকে নিয়ে ধারাবাহিকতার জন্য তীব্র সমালোচনা ২০১৪ সালেই হয়েছে তিনি গত বছর ছিলেন ধারাবাহিকতার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। আর সে কারণে ক্রমেই দেশের অন্য যে কোন ব্যাটসম্যানের চেয়ে ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যাচ্ছেন তিনি। এখন ধারাবাহিকতা যেন তামিমকে দেখেই শিক্ষণীয় হয়ে উঠেছে অন্য ব্যাটসম্যানদের জন্য। ধারাবাহিকতা কেমন হতে পারে সেটার বড় একটি উদাহরণ তামিমই প্রথম দেখিয়েছিলেন বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের মধ্যে। ২০১২ এশিয়া কাপে ফিটনেস সমস্যা এবং কিছুদিন অফফর্মে থাকায় দল থেকে বাদ দেয়া হয়েছিল তাকে। কিন্তু সে সময় প্রধান নির্বাচক আকরাম খানের প্রতিবাদ করে পদত্যাগ করেছিলেন। শেষ পর্যন্ত তামিম ফিরে টানা চারটি অর্ধশতক হাঁকিয়েছিলেন এবং তার এমন দুর্দান্ত নৈপুণ্যে বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো কোন আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টের ফাইনালে উঠেছিল। এছাড়া টেস্টে ২০১০ সালেই তিনি ইংল্যান্ড সফরে টানা দুই ম্যাচে সেঞ্চুরি হাঁকিয়ে বিশ্বব্যাপী ক্রিকেট অনুরাগীদের দৃষ্টি কেড়েছিলেন। সেবার টানা তৃতীয় শতক হাঁকাতে না পারলেও সেই অর্জনটাও করেছেন গত বছর। ২০১৪ সালের নবেম্বরে জিম্বাবুইয়ের বিরুদ্ধে টানা দুই টেস্টে সেঞ্চুরি হাঁকানোর পর গত বছর এপ্রিলে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে প্রথম ডাবল সেঞ্চুরি হাঁকিয়ে টানা তিন টেস্টে সেঞ্চুরির রেকর্ড গড়েন তিনি প্রথম বাংলাদেশী হিসেবে। আর এবার ভারতে অনুষ্ঠিত টি-২০ বিশ্বকাপের প্রথম রাউন্ডে ওমানের বিরুদ্ধে ১০৩ রানের অপরাজিত ইনিংস খেলে প্রথম বাংলাদেশী হিসেবে টি-২০ ফরমেটের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সেঞ্চুরির নিদর্শন দেখান। ব্যাট হাতে এমন অনেক প্রথম ঘটনার জন্ম দিয়ে গেছেন তামিম একের পর এক। সেটা তিন ফরমেটেই। তিনি তিন ফরমেটেই বাংলাদেশের পক্ষে সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত ইনিংসের মালিক। টেস্টে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ২০৬, ওয়ানডে ক্রিকেটে ২০০৯ সালে জিম্বাবুইয়ের বিরুদ্ধে ১৬ আগস্ট বুলাওয়েতে ১৫৪ এবং টি-২০ ক্রিকেটে ওমানের বিরুদ্ধে হার না মানা ১০৩ রানের ইনিংস তিনটি বাংলাদেশের পক্ষে সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত ইনিংস। এছাড়া ওয়ানডে ও টি-২০ ক্রিকেটে বাংলাদেশের পক্ষে সর্বাধিক চার-ছক্কার রেকর্ডও তার দখলে। ওয়ানডেতে এখন পর্যন্ত ৫৫৯টি চার ও ৬৪ ছক্কা এবং টি-২০ ক্রিকেটে ২৭ ছক্কা ও ১২৫ চার হাঁকিয়েছেন তিনি। ৫২ টি-২০ খেলে ২৪.৫৫ গড়ে ১১৫৪, ১৫৬ ওয়ানডে খেলে ৩২.৪৪ গড়ে ৪৯৩১ এবং ৪২ টেস্ট খেলে ৩৯.৪৬ গড়ে ৩১১৮ রান করে তিনি বাংলাদেশের পক্ষে সর্বাধিক রানের মালিক। একইসঙ্গে তিন ফরমেটেই সর্বাধিক রানের মালিক হওয়ার নজির বিশ্ব ক্রিকেটে আর কোন ব্যাটসম্যানেরই নেই। ওয়ানডেতে ৭, টেস্টে ৭ এবং টি-২০ ক্রিকেটে ১ সেঞ্চুরি করে তিনি দেশের পক্ষে সর্বাধিক সেঞ্চুরিরও মালিক। আর এসবই ব্যাটসম্যান হিসেবে দেশের ক্রিকেট ইতিহাসে সর্বকালের সেরা ব্যাটসম্যানে পরিণত করেছে তাকে। বয়স মানুষকে পরিণত ও থিতু করে পারফর্মেন্সে। তামিমের ক্যারিয়ারটা দুই ভাগে বিভক্ত করলে তিনি গত ৫ বছরে ছিলেন দারুণ ধারাবাহিক। প্রথম ৫ বছরে ওয়ানডেতে করেছিলেন মাত্র ২ সেঞ্চুরি আর গত ৫ বছরে করেছেন ৫টি যার মধ্যে তিনটিই গত এক বছরের মধ্যে! ২০১৫ সালে বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে সেরা সাফল্যের বছরে তিনিই ছিলেন সর্বাধিক সফল। ২১০৫ সালের এপ্রিলে পাকিস্তান দল সফরে আসার পর থেকে এ বছর আফগানিস্তানের বিরুদ্ধে সিরিজ পর্যন্ত টানা ১৫ ওয়ানডে খেলে তিনি ৬২.০০ গড়ে ৩ সেঞ্চুরি ও ৫ হাফসেঞ্চুরিসহ করেছেন ৮০৬ রান। যে সহে, সে রহে- দুই বছর আগে চরম সমালোচনার শিকার তামিম সব সয়ে এখন একের পর এক নতুন ও অনন্য অর্জনে নিজেকে নিয়ে যাচ্ছেন আরও উঁচুতে। তামিমের ধারাবাহিকতা এখন বাকি ক্রিকেটারদের জন্য অনুস্মরণীয় দৃষ্টান্ত হিসেবে বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের বার্তা দিচ্ছে- ‘ধারাবাহিকতা শিখতে চাইলে তামিমকে দেখে শেখ!’ ২০১৪ সালের সাময়িক বাজে ফর্মটা বারবারই আলোচনায় এসেছে। সে বছর ১১ ওয়ানডে খেলে মাত্র ২৬.৯০ গড়ে ২৬৯ রান করেছিলেন তিনি। ছিল মাত্র দুটি অর্ধশতক। অথচ দলের অন্যতম নির্ভরযোগ্য ওপেনার তিনি। তাই তীব্র সমালোচনা, বিভিন্ন সামজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপসহ নিজ পরিবার নিয়েও কটূক্তির শিকার হয়েছিলেন তামিম। তবে নীরবে হজম করেছেন সব। হয়ত অপেক্ষায় ছিলেন মোক্ষম জবাবটা দেবেন ব্যাট হাতেই। গত বছর ক্যারিয়ারের সফলতম বছর কাটিয়েছে বাংলাদেশ। প্রথমবারের মতো তিন ক্রিকেট পরাশক্তি পাকিস্তান, ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকাকে ওয়ানডে সিরিজে হারিয়েছে। আর দুর্দান্ত সাফল্যগুলো এসেছে কথিত অধারাবাহিক তামিমের নিয়মিত দুর্ধর্ষ সব ইনিংসের কল্যাণে। বিশেষ করে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে এপ্রিলে হওয়া সিরিজে টানা দুই ম্যাচে ১৩২ ও অপরাজিত ১১৬ রানের ইনিংস দুটো অনেকদিনই ক্রিকেটপ্রেমীরা মনে রাখবেন। সবমিলিয়ে আগের এক বছরে তিনি ১৮ ওয়ানডে খেলে ৪৬.৩৭ গড়ে ৭৪২ রান করেন তিনি ২ সেঞ্চুরি ও ৫ হাফসেঞ্চুরিসহ। এর চেয়ে ধারাবাহিকতার নিদর্শন আর কি হতে পারে? দলের অন্য ব্যাটসম্যানদের জন্য দারুণ দৃষ্টান্ত ও অনুকরণের বিষয়বস্তু এখন ২৭ বছর বয়সী এ বাঁ-হাতি। প্রথম বাংলাদেশী হিসেবে ওয়ানডে ক্রিকেটে ৪ হাজার রানের মালিক এখন ৫ হাজার রানের মাইলফলকেরও খুব কাছাকাছি। এখন তার ওয়ানডে রান ৪ হাজার ৯৩১। দারুণ সেই মাইলস্টোনে পৌঁছুতে প্রয়োজন আর মাত্র ৬৯ রান! তার যে ধারাবাহিকতা, তাতে করে খুব বেশি অপেক্ষা করতে হবে না দেশের ক্রিকেটপ্রেমীদের এবং বাংলাদেশ ক্রিকেটকে। আসন্ন ইংল্যান্ড সিরিজেই হয়ত সেটা করে নিজেকে আরও অনন্য, আরও উচ্চপর্যায়ের অবস্থানে নিয়ে যাবেন, যেখানে আর কোন বাংলাদেশী কখনও যায়নি- জয়তু তামিম! নিজেও এখন দারুণ আত্মবিশ্বাসী। কারণ আফগানিস্তানের বিরুদ্ধেও সিরিজ খেলা নিয়ে শঙ্কা ছিল। ইনজুরিতে ছিলেন তিনি। সেই সিরিজেই সিরিজসেরা হয়েছেন ৭২.৬৭ গড়ে ২১৮ রান করে। এবার ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে আরেকটি মাইলফলক ছোঁয়ার সামনে দাঁড়িয়ে তামিম বললেন, ‘সেঞ্চুরি তো সেঞ্চুরিই। এটা আমার কাছে বিশেষ কিছু। আমি কোন একশকেই ছোট করে দেখি না। আমি আরও বড় ইনিংস খেলতে চাই এবং এমন সুযোগ আমার অনেক আছে। যখন আমার কাছে সর্বোচ্চ সময় থাকে তখন সর্বোচ্চ সুযোগ নেয়া উচিত।’
×