ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

প্রায় ৬শ’ কোটি টাকার ক্ষতি ॥ চুরির প্রমাণ লুকোতেই এমন নাশকতা

বেনাপোল বন্দরে ৭ বার আগুন লাগে- তদন্ত কমিটির কাজ শুরু

প্রকাশিত: ০৫:৫৩, ৫ অক্টোবর ২০১৬

বেনাপোল বন্দরে ৭ বার আগুন লাগে- তদন্ত কমিটির কাজ শুরু

স্টাফ রিপোর্টার, বেনাপোল ॥ বেনাপোল স্থলবন্দরের ২৩ নং শেডে আগুন লাগার ঘটনায় তদন্ত কমিটি কাজ শুরু করেছে। মঙ্গলবার কমিটি শেড-ইনচার্জসহ ঘটনার সময় উপস্থিত ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলেছেন। শনিবার গভীর রাত পর্যন্ত ওই শেডে আমদানিকৃত কয়েকটি ভারতীয় পণ্যবাহী ট্রাক থেকে পণ্য আনলোড করা হয়। জ্বলন্ত সিগারেট থেকে আগুনের সূত্রপাত বলে অনেকে মনে করেন। অন্যদিকে আগুন লাগার ঘটনায় শোনা যাচ্ছে নানা কথা। শেড ইনচার্জ জানান, শেডের পাশে একটি পোস্ট লাইনে গত ১১ সেপ্টেম্বর আগুন লাগে। হ্যান্ডলিং শ্রমিকদের সহযোগিতায় সে যাত্রা রক্ষা হয়। ১৮ সেপ্টেম্বর লিখিতভাবে বৈদ্যুতিক লাইন মেরামতের জন্য আবেদন দেয়া হয় কর্তৃপক্ষের কাছে। কিন্তু তারপরও কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। আর এ কারণে শর্ট সার্কিট থেকেও আগুন লাগতে পারে। অনেকে ধারণা করছেন, বন্দরের অব্যবস্থাপনা ও চুরির প্রমাণ লুকাতে অগ্নিকা-ের মতো নাশকতামূলক কর্মকা- চালানো হয়ে থাকে এ বন্দরে। বন্দর প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ পর্যন্ত ৭ বার এ বন্দরে ভয়াবহ অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটে। এতে প্রায় ৬শ’ কোটি টাকার মালামাল পুড়ে যায়। যার কোন ক্ষতিপূরণ আজও পায়নি আমদানিকারকরা। বন্দর কর্তৃপক্ষ বন্দরে রক্ষিত মালামালের ভাড়াসহ অন্যান্য অর্থ আদায় করলেও কোন বীমা করেন না রহস্যজনক কারণে। বিভিন্ন সময়ে সংঘটিত অগ্নিকা-ে তদন্ত গঠিত হলেও রহস্যজনকভাবে তা ধামাচাপা পড়ে যায়। দেশের সব চেয়ে বড় বেনাপোল স্থলবন্দরে ৩৮টি ওয়্যার হাউস বা শেড আছে। আর ওপেন ইয়ার্ড রয়েছে ৫টি। এসব শেড ও ইয়ার্ডে আমদানিকৃত থেকে ৪৫ হাজার টন পণ্য থাকার কথা থাকলেও সেখানে রয়েছে প্রায় ১ লাখ মেট্রিক টন পণ্য। প্রতিটি শেডে ঠাসাঠাসি করে রাখা হয় এসব পণ্য। পণ্যবাহী ট্রাকগুলো রাখার জায়গায় মাসের পর মাস রাখা হয় বিভিন্ন কোম্পানির ট্রাক চেচিসসহ পরিবহন। যার ফলে এসব পণ্যবাহী ট্রাক রাখা হয় বন্দরের সড়কে। দাহ্য পদার্থের জন্য আলাদা জায়গা থাকার পরও প্রায় শেডে রাখা হয় দাহ্য পদার্থ। বন্দরের অভ্যন্তরে বৈদ্যুতিক লাইনগুলো ঠিকমতো মেরামত না করায় শটসার্কিটেও আগুন লেগেছে কয়েকবার। এতবড় বন্দরে মাত্র ২ জন বাইরের বৈদ্যুতিক মিস্ত্রিকে মাস্টার রোলে নিয়ে কাজ করানো হচ্ছে। এখানে নেই দক্ষ কোন বৈদ্যুতিক ইঞ্জিনিয়ার। বন্দরের বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম ব্যবহার না করে বাইরে। পাচারের অভিযোগও রয়েছে। ২০১৩ সালের ২৩ মার্চ বন্দরের ৩ লাখ টাকার বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম বাইরে পাচারের সময় আটক করা হয়। এ ঘটনায় তৎকালীন কর্মকর্তাকে চাকরিচ্যুতও করা হয়। বন্দরের নিজস্ব হাইড্রেন পানি সাপ্লাই ব্যবস্থা থাকলেও অগ্নিকা-ের সময় কাজ করে না। পানি সরবরাহ ব্যবস্থা নিয়মিত পরীক্ষা করা হয় না। বন্দরের ফায়ারম্যানদের তেমন কোন প্রশিক্ষণ দেয়া হয় না। দায়িত্ব পালনেও তাদের বিরুদ্ধে গাফিলতির অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া বন্দরের নিজস্ব পানি সরবরাহ ব্যবস্থা ছাড়াও নিকটবর্তী বেনাপোল ফায়ার সার্ভিস স্টেশনের একটি ইউনিট রয়েছে। নিজস্ব ব্যবস্থাপনার বাইরে ওই একটি ইউনিটই ভরসা। এ পর্যন্ত যতবার এ বন্দরে অগ্নিকা- ঘটেছে বন্দরের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় আগুন নিভাতে পারেনি। নির্ভর করতে হয় বাইরের ফায়ার সার্ভিসের উপরে। বন্দরের একজন সহকারী ফায়ার পরিদর্শকের নেতৃত্বে ৩ জন ফায়ারম্যান কাম হাইড্রেন অপারেটর থাকলেও অগ্নিকা-ের সময় তাদের খুঁজে পাওয়া যায় না। রবিবারের অগ্নিকা-ের সময় তাদের মোবাইল বন্ধ ছিল। সর্বক্ষণিক বন্দরের অভ্যন্তরে তাদের থাকার কথা থাকলেও ওইদিন তারা কেউ ছিল না বলে জানান বন্দর ব্যবহারকারীরা। প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম না থাকায় আগুন নেভাতে ব্যর্থ হচ্ছে বন্দর কর্তৃপক্ষ। আর এ কারণে বার বার আগুনে পুড়ে যাচ্ছে আমদানিকারকদের কোটি কোটি টাকার মালামাল। তাছাড়া বন্দরের শেড ও ইয়ার্ড থেকে প্রায়ই পণ্য চুরির ঘটনা ঘটছে। চুরির প্রমাণ লুকাতে বন্দরের এক শ্রেণীর কর্মচারীরা অনেক সময় অগ্নিকা-ের মতো নাশকতামূলক কর্মকা- চালায় বলে অভিযোগ রয়েছে। সব কিছু মিলিয়ে নিরাপত্তা হুমকির মুখে রয়েছে এই স্থলবন্দর। এ ব্যাপারে বন্দর ব্যবহারকারী বেনাপোল সিএ্যান্ডএফ এজেন্টস এ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মফিজুর রহমান জানান, বেনাপোল বন্দরে অগ্নিকা-ের ঘটনায় আমদানিকারকরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যার ফলে ব্যবসায়ী মহলে চরম উৎকণ্ঠা বিরাজ করছে। আমরা জরুরীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত আমদানিকারকদের প্রতিনিধিদের কাছে চিঠি পাঠিয়েছি। ক্ষয়ক্ষতির তালিকা হাতে পাওয়ার পর পরই বিষয়টি নিয়ে বন্দর ও কাস্টমস কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে পরবর্তী ব্যবস্থা নেয়া হবে। এ ব্যাপারে বেনাপোল স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের উপ পরিচালক (ট্রাফিক) আব্দুল জলিল জানান, অগ্নিকা-ের কারণ এখনও জানা যায়নি। আর ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ এখনই বলা সম্ভব নয়। এ পর্যন্ত ওই শেডে ১১৫টি পণ্য চালানের কাগজপত্র পাওয়া গেছে। ২৬ সেপ্টেম্বর থেকে ১ অক্টোবর পর্যন্ত এই শেডে আর কি পণ্য আনলোড করা হয়েছে সেটা কাস্টমস কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করা হচ্ছে। এছাড়া আর কোন পণ্য ছিল কিনা তাও পরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে। সব কিছু হাতে পেলে তবেই ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ জানা যাবে। তদন্ত কমিটির রিপোর্টের আগে কোন পোড়া পণ্য ওই শেড থেকে সরানো যাবে না বলে জানান তিনি। রবিবার ভোরে বেনাপোল স্থলবন্দরের ২৩নং শেডে এক ভয়াবহ অগ্নিকা-ে কয়েক কোটি টাকার আমদানিকৃত মালামাল পুড়ে ছাই হয়ে যায়। এই শেডে বিভিন্ন গার্মেন্টস ইন্ডাস্ট্রিজ ও শিল্প প্রতিষ্ঠানের নামে আমদানিকৃত কাপড়, ডাইস, বিভিন্ন কেমিক্যাল, মেশিনারি পার্টস, মোটর পার্টস, ফাইবার, মশা তাড়ানো স্প্রে নিউ হিট, তুলা এ্যাসোসিয়েডস গুডস ও কাগজ, রক্ষিত ছিল। তদন্ত কমিটি প্রধানের বন্দর পরিদর্শন ॥ বাংলা নিউজ জানায়, বেনাপোল বন্দরে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় গঠিত ৪টি তদন্ত কমিটির প্রধান নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব সাফায়েত হোসেন ক্ষতিগ্রস্ত পণ্যাগার পরিদর্শন করেছেন। মঙ্গলবার বেলা সাড়ে ১১টায় ক্ষতিগ্রস্ত ২৩ নম্বর পণ্যাগার, ওপেন ইয়ার্ড ও পোর্ট থানা ভবন পরিদর্শন করেন তিনি। পরে তিনি বন্দর অডিটরিয়ামে তদন্ত কমিটির সঙ্গে বৈঠকে মিলিত হন। এ সময় যুগ্ম সচিবের সঙ্গে ছিলেন, ল্যান্ড পোর্ট সচিব হাবিবুর রহমান, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আব্দুস ছালাম, বেনাপোল বন্দরের উপ-পরিচালক (ট্রাফিক) আব্দুল জলিল, পোর্ট থানা তদন্ত (ওসি) খন্দকার শামিম উদ্দিন, ফায়ার সার্ভিসের সহকারী পরিচালক পরিমল দত্ত ও বাংলাদেশ স্থলবন্দর এমপ্লয়েজ ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মনির হোসেন মজুমদার। পরিদর্শন শেষে যুগ্ম সচিব সাফায়েত হোসেন সাংবাদিকের বলেন, তদন্ত কমিটি দুই দিন ধরে বন্দরে অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত স্থানগুলো পরিদর্শন করবেন। এসময় তারা এ বন্দর দিয়ে আমদানি-রফতানি বাণিজ্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত সব সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে কথা বলবেন।
×