ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

খাদিজা সঙ্কটাপন্ন

প্রকাশিত: ০৫:৪১, ৫ অক্টোবর ২০১৬

খাদিজা সঙ্কটাপন্ন

গাফফার খান চৌধুরী/সালাম মশরুর ॥ সিলেটে ছুরিকাঘাতে গুরুতর জখম কলেজছাত্রী খাদিজা বেগম নার্গিসের অবস্থা আশঙ্কাজনক। রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন খাদিজার অবস্থার উন্নতি হয়নি। চিকিৎসকরা বলছেন, খাদিজার অবস্থার উন্নতি হচ্ছে না। তবে চেষ্টা অব্যাহত আছে। অস্ত্রোপচার শেষে খাদিজাকে ৭২ ঘণ্টার পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে। খাদিজাকে ছুরিকাঘাতে হত্যাচেষ্টাকারী বদরুল আলমের অবস্থাও গুরুতর। সে আগে থেকেই শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগ থেকে বহিষ্কৃত। বদরুলের ফাঁসিসহ তিন দফা দাবিতে উত্তাল পুরো সিলেট। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা রাস্তা অবরোধ করে বিক্ষোভ দেখান। প্রেম প্রত্যাখ্যান করায় খাদিজাকে প্রকাশ্যে ছুরিকাঘাতে হত্যার চেষ্টা করে বদরুল। এদিকে, হত্যাকারী যে দলেরই হোক তাকে বিচারের মুখোমুখি করার ঘোষণা দিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। বদরুলকে গ্রেফতার করা হয়েছে। খাদিজা হত্যাচেষ্টার ঘটনায় বদরুলকে আসামি করে মামলা দায়ের হয়েছে। সোমবার বিকেলে দ্বিতীয় বর্ষের পরীক্ষা দিয়ে সিলেট সরকারী মহিলা কলেজের ছাত্রী খাদিজা বেগম নার্গিস বাড়ি ফিরছিলেন। ফেরার পথে এমসি কলেজের পুকুরপাড়ে খাদিজা আক্রমণের মুখে পড়েন। আচমকা বদরুল আলম (২৭) ধাক্কা দিয়ে খাদিজাকে মাটিতে ফেলে দেয়। এরপর কোমরে থাকা ধারালো অস্ত্র দিয়ে এলোপাতাড়ি কোপাতে থাকে। খাদিজার চিৎকারে স্থানীয়রা এগিয়ে এলে হত্যাচেষ্টাকারী বদরুল পালানোর চেষ্টা করে। এ সময় জনতা বদরুলকে ধরে গণধোলাই দেয়। পরে পুলিশে সোপর্দ করে আর খাদিজাকে উদ্ধার করে দ্রুত এমএজি ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে অবস্থার অবনতি হলে সোমবার মধ্যরাতেই তাকে রাজধানীর পান্থপথের স্কয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। হাসপাতালটির আইসিইউতে রাখা হয় তাকে। মঙ্গলবার খাদিজার শরীরে কয়েক দফা অস্ত্রোপচার করা হয়। হাসপাতালের নিউরোসার্জারি বিভাগের চিকিৎসক এএম রেজাউস সাত্তারের অধীনে খাদিজার চিকিৎসা চলছে। অস্ত্রোপচার শেষে হাসপাতালের দায়িত্বশীল চিকিৎসকরা সাংবাদিকদের জানান, খাদিজার মাথায় গুরুতর আঘাত লেগেছে। মাথার খুলি ভেদ করে ব্রেনে ইনজুরি হয়েছে। সেটার অপারেশন হয়েছে। হামলার সময় খাদিজা হাত দিয়ে ঠেকাতে চেষ্টা করায় তার হাতেও গভীর ক্ষত রয়েছে। খাদিজার অবস্থার তেমন কোন উন্নতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। তারপরও চেষ্টা অব্যাহত আছে। তার অবস্থা সঙ্কটাপন্ন। অস্ত্রোপচার শেষে খাদিজাকে ৭২ ঘণ্টার জন্য অবজারভেশনে রাখা হয়েছে। তার অবস্থা খুবই সঙ্কটাপন্ন। হাসপাতালটির চিকিৎসক ডাঃ নিজাম জানান, খাদিজার অবস্থা খুবই খারাপ। বাঁচার আশা খুবই ক্ষীণ। তারপরও খাদিজাকে বাঁচানোর চেষ্টা চলছে। আমাদের সিলেট সংবাদদাতা জানান, খাদিজা বিশ্বনাথ উপজেলার আউশা এলাকার সৌদি আরব প্রবাসী মাসুক মিয়ার মেয়ে। পরিবারের সঙ্গে সিলেট নগরীর আখালিয়া এলাকায় বসবাস করেন তিনি। হত্যাচেষ্টাকারী বদরুল আলম শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাবেক সহ-সম্পাদক। একই বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০০৮-০৯ সেশনে অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষার্থী ছিল বদরুল। তার গ্রামের বাড়ি সুনামগঞ্জ জেলার ছাতক উপজেলার সুনাইঘাতি গ্রামে। পিতার নাম সাইদুর রহমান। ঘটনার পর মোবাইল ফোনে ধারণ করা ছুরিকাঘাত করার মুহূর্তটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। হত্যাকারীর ফাঁসিসহ তিন দফা দাবিতে উত্তাল হয়ে ওঠে পুরো সিলেট নগরী। মঙ্গলবার সকাল থেকে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ শুরু করেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। এছাড়া বদরুলের ফাঁসিসহ তিন দফা দাবিতে তিন দিনের কর্মসূচীও ঘোষণা করেছেন খাদিজার সহপাঠীরা। সকাল সাড়ে দশটা থেকে নগরীর চৌহাট্টার সরকারী মহিলা কলেজের সামনে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ শুরু করেন কলেজের শিক্ষার্থীরা। ‘ফাঁসি চাই, ফাঁসি চাই’ সেøাগানে মুখর হয়ে ওঠে পুরো চৌহাট্টা এলাকা। ওই সড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। শিক্ষার্থীরা জানিয়েছেন, দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত তাদের আন্দোলন চলবে। তিন দফা দাবিতে তিন দিনের কর্মসূচী ঘোষণা করেছেন তারা। বিক্ষোভকারীদের প্রধান দাবি বদরুলের ফাঁসি। এছাড়াও তিন দিনের কর্মসূচীর মধ্যে রয়েছেÑ মঙ্গলবার থেকে কলেজের সকল ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন, কালোব্যাজ ধারণ করে জেলা প্রশাসক বরাবর স্মারকলিপি ও বুধবার প্রতিবাদ সমাবেশ এবং পরবর্তী কর্মসূচী ঘোষণা। আর তিন দফা দাবির মধ্যে রয়েছেÑ মামলা দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে স্থানান্তর, আসামি বদরুলের ফাঁসি নিশ্চিত করা এবং পরীক্ষার হল ও যাতায়াতের সময় ছাত্রীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। বেলা সোয়া এগারোটার দিকে এমসি কলেজের শিক্ষার্থীরা বদরুলের ফাঁসির দাবিতে ক্লাস ছেড়ে ক্যাম্পাসে মিছিল নিয়ে বের হন। পরে বিক্ষুব্ধ ছাত্রছাত্রীরা নগরীর টিলাগড় পয়েন্টে অবস্থান নিয়ে সিলেট-তামাবিল মহাসড়ক অবরোধ করেন। শেষ পর্যন্ত প্রশাসনের আশ্বাসে বিকেলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়। এদিকে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক জাকির দাবি করেছেন, বদরুল ছাত্রলীগের কেউ নয়। ঘটনার আগেই সে নানা অভিযোগের কারণে ছাত্রলীগের পদ হারায়। তাই বদরুলের কৃতকর্মের দায়ভার ছাত্রলীগ নেবে না। এমন ঘৃণ্য অপকর্মের জন্য ছাত্রলীগ বদরুলের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করছে। অন্যদিকে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (শাবিপ্রবি) ছাত্রলীগ এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, বদরুলের সঙ্গে শাবিপ্রবি ছাত্রলীগের কোন ধরনের সম্পর্ক নেই। শাবিপ্রবি ছাত্রলীগ সভাপতি সঞ্জীবন চক্রবর্তী পার্থ ও সাধারণ সম্পাদক ইমরান খান স্বাক্ষরিত ওই সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এমনটাই দাবি করা হয়েছে। গণমাধ্যমে প্রেরিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এমন সন্ত্রাসী হামলার নিন্দা জানানোর পাশাপাশি তারা খাদিজা আক্তার ও তার পরিবারের পাশে সার্বক্ষণিক থাকবে বলেও জানানো হয়েছে। একই সঙ্গে সন্ত্রাসী বদরুলের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে। বদরুল আলম সুনামগঞ্জের একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক হিসেবে কর্মরত উল্লেখ করে ওই বিবৃতিতে বলা হয়েছে, গঠনতন্ত্র অনুযায়ী নিয়মিত ছাত্ররাই সংগঠনের সদস্য থাকবেন। এমনকি নিয়মিত ছাত্ররাই সংগঠনের সক্রিয় সদস্য হিসেবে অংশগ্রহণ করতে পারেন, কোন চাকরিজীবী নয়। সাংগঠনিক নিয়মেই কর্মক্ষেত্রে যোগদানের সঙ্গে সঙ্গেই বদরুলের সদস্যপদ বাতিল হয়ে গেছে। শাবিপ্রবি ছাত্রলীগ আরও জানায়, খাদিজার ওপর সংঘটিত সন্ত্রাসী কর্মকা- বদরুলের একান্তই ব্যক্তিগত নৃশংসতা। কারও ব্যক্তিগত কর্মকা-ের দায়ভার কোন অবস্থাতেই সংগঠনের ওপর বর্তায় না। বদরুলের সঙ্গে যেহেতু ছাত্রলীগের বর্তমানে কোন সর্ম্পক নেই, তাই বদরুলের কোন কর্মকা-ের দায়ভার ছাত্রলীগ নেবে না। বদরুল কিছুদিন ধরে সুনামগঞ্জ জেলার ছাতক উপজেলার জাউয়াবাজারের আলহাজ আয়াজুর রহমান উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে কর্মরত। কর্মরত কেউ ছাত্রলীগের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী সদস্য থাকতে পারে না। আপনাআপনিই সদস্যপদ বাতিল হয়ে যায়। তাই বদরুল বর্তমানে ছাত্রলীগের কেউ নয়। তার দায়ভারও ছাত্রলীগ নেবে না। অন্যদিকে মঙ্গলবার দুপুরে খাদিজা হত্যাচেষ্টার ঘটনায় মামলা দায়ের হয়। শাহপরাণ থানায় মামলা দায়ের করেন খাদিজার চাচা আব্দুল কুদ্দুস। মামলার একমাত্র আসামি বদরুল পুলিশ হেফাজতে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। পুলিশ জানায়, জনতা বদরুলকে হস্তান্তর করার পরই তাকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। বদরুলের দাবি, খাদিজার সঙ্গে তার ছয় বছর ধরে প্রেম চলছিল। সম্প্রতি সে সম্পর্ক আর রাখতে চাচ্ছিল না খাদিজা। আর তাতেই ক্ষুব্ধ হয়ে সে ঘটনাটি ঘটায়। তবে পুলিশের এক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, বদরুল খাদিজাদের বাড়িতে প্রায় ছয় বছর জায়গির ছিল। জায়গির থাকাবস্থায় খাদিজাকে সে পড়াত। পড়াতে পড়াতেই খাদিজার সঙ্গে বদরুলের প্রেমের সম্পর্ক হয়। সম্প্রতি খাদিজা সম্পর্ক আর রাখতে চাচ্ছিল না। খাদিজা বদরুলের বিয়ের প্রস্তাব সরাসরি নাকচ করে। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে খাদিজাকে ধারালো ছুরি দিয়ে হত্যার চেষ্টা করে বদরুল। এ ব্যাপারে সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার কামরুল আহসানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, বদরুল চিকিৎসাধীন। সে সুস্থ হলে আরও জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। প্রেমে ব্যর্থ হওয়ার সূত্র ধরেই বদরুল ঘটনাটি ঘটায় বলে প্রাথমিকভাবে জানা গেছে। তবে হত্যাচেষ্টার পেছনে আরও কোন কারণ আছে কি-না তা গুরুত্বের সঙ্গে খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এদিকে মঙ্গলবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল সচিবালয়ে সাংবাদিকদের বলেছেন, খাদিজা বেগমের হত্যাচেষ্টাকারী যে দলেরই হোক না কেন, সে আইনের হাত থেকে পার পাবে না। তাকে অবশ্যই আইনের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়া হবে।
×