ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

দীপ্তি ইসলাম

সৃজনশীল তরুণ প্রজন্ম

প্রকাশিত: ০৭:১০, ৪ অক্টোবর ২০১৬

সৃজনশীল তরুণ প্রজন্ম

চারদিকে চলছে যখন সৃজনশীলতার স্নায়ুবিক ও মানসিক অস্থিরতা, জীবন প্রবাহ নিয়ে নানা ধরনের উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা এবং নিজের অস্তিত্ব সম্পর্কে আপনার থেকে বুদ্ধিবৃত্তিক চেতনা যখন, কিছু করার জন্য উদগ্রীব, ঠিক তখন থেকে নিবিড়ভাবে লক্ষ্য করে আসছি সামাজিক মানুষের উত্থান, তরুণ প্রজন্মের চাহিদা ও আকাক্সক্ষা। দেখছি যুক্তিচালিত আলোকিত শ্রেণীর কাগজে কলমের লড়াই। দেখে আসছি প্রথাগত শিক্ষায় শিক্ষিত না হয়েও মেহনতী মানুষের বাঁচার সংগ্রাম। সামাজিক মানুষের ব্যক্তিগত সম্পদের পাহাড়, অর্থনৈতিক শক্তির অসম প্রতিযোগিতা এবং বঞ্চিত মানুষের জীবন যন্ত্রণা দেখে অনেক তরুণ প্রজন্ম এবং ছাত্রসমাজ দিন বদলের কথা ভাবে কিন্তু পুঁজিবাদের সর্বগ্রাসী ক্ষুধা তাদের পিছু ছাড়ে না। তাদের উদারনৈতিক জায়গাগুলো দখল নিতে থাকে বুর্জোয়া সমাজ এবং শ্রেণী বিভাজিত সমাজে একে অন্যকে ঠকানো ও বঞ্চিত করার মধ্যদিয়ে গড়ে ওঠে তারুণ্যের জীবনবোধ। সমাজের সঙ্গে তৈরি হয়, এক প্রকার অর্থনৈতিক সম্পর্ক। যে সম্পর্ক তারুণ্যের নৈতিক মূল্যবোধকে নির্ভরশীল করে তোলে অর্থনৈতিক সম্পর্কের উপর। অর্থনৈতিক সফলতা মানেই চূড়ান্ত বিজয়, এই ধারণা বদ্ধমূল হতে থাকে। অর্থনৈতিক সফলতাই কোন কাজের সঠিক মাপকাঠি নয়। সফলতা কিংবা বিফলতা দিয়ে কোন কাজের ভাল-মন্দ যাচাই করা যায় না। একটি জাতি তথা প্রজন্মের দৃঢ়সঙ্কল্প, বীরত্ব এবং মানবিক পর্যায় কতটা উচ্চপর্যায়ের সেটার উপরই নির্ভর করে সফলতা ও ব্যর্থতা। আমাদের আজকের তরুণ প্রজন্ম শুধু পুঁজিবাদ কেন্দ্রিক বিকারগ্রস্ত আকাক্সক্ষা নিয়েই এগিয়ে যাচ্ছে না। তারা বিভাজিত আমাদের অসুস্থধারার রাষ্ট্রীয়, সামাজিক ও পারিবারিক মতাদর্শ দ্বারা। দূষিত হচ্ছে বংশ পরম্পরায় রাজনৈতিক দীক্ষা নিয়ে। জীবনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত প্রভাবিত হয়ে আসছে, প্রজ্ঞাহীন রাজনীতি এবং ধর্মীয় অন্ধত্ব দ্বারা। তৃতীয় বিশ্বের সব রকম বদাভ্যাসে অভ্যস্ত রেনেসাঁস প্রজন্মের আলোর পথ রুদ্ধ হয়েছে গতানুগতিক শিক্ষা ব্যবস্থা দ্বারা। যে শিক্ষা ব্যবস্থায় রুজি রোজগারের চাহিদা কিছুটা মিটলেও ব্যক্তিগত ও মানসিক গঠনে বিশেষ কোন পরিবর্তন হয়নি। রেনেসাঁস থেকে ডিজিটাল যে প্রজন্মেরই হোক, আক্ষেপের বিষয় হলো- একজন তরুণ জানে না তারুণ্য মানে কি? এমনকি কখনও তলিয়েও দেখেনি শব্দটির গভীরতা। যেমন, একজন যুবক বোঝে না তার যৌবনের যথার্থ মানে বা এর যথার্থ ব্যবহার। এমন কি কখনও কখনও সমাজ ও পরিবার দ্বারা জীবন ও যৌবন বিষয়ক ভুল ধারণা নিয়ে হচ্ছে বিভ্রান্ত। ফলে নিজের সম্পর্কে স্বাধীন সিদ্ধান্ত নেয়ার প্রশ্নে জটিল মনস্তাত্ত্বিক সমস্যা দেখা দিচ্ছে এবং যা চলার পথে মারাত্মক ভুলেরও শিকার হচ্ছে। এভাবে তরুণ থেকে পরিণত হচ্ছে যুবকে বিবর্ণ ধূসর সময়ের হাত ধরে। যার মাসুল গুনতে হচ্ছে আমাদের জাতীয় জীবনে। আধুনিক বিত্তবান প্রজন্মের তরুণরা আজ ভয়ানকভাবে বিপথগামী। তারা প্রভাবিত মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক চিন্তাচেতনা দ্বারা। মধ্যযুগীয় বর্বর সমাজ প্রতিষ্ঠায় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। আল্লাহু আকবার বলে খুনের নেশায় বিভোর। রক্তপাত ও মানবিক বিপর্যয়ের মধ্যদিয়ে গড়ে তুলতে চায় একটি মুমূর্ষু পৃথিবী। আর সে সভ্যতায় নারীরা হবে তাদের ব্যবহারের সামগ্রী। বিশ্বজুড়ে শরিয়া আইনের বাস্তবায়নের লক্ষ্য নিয়ে স্বতঃস্ফূর্তভাবে বেছে নিয়েছে আত্মঘাতীর পথ। মরলেই শহীদ। আর শহীদী জীবনে পেয়ে যাবে অসংখ্যক হুর-পরীর অবিনশ্বর স্বর্গ। সুষমা সরলতার পৃথিবী ছেড়ে, বিনা বাক্য বয়ানে এমন আত্মসমর্পণ মানে, তারুণ্যের পরাজয়। ফলশ্রুতিতে জীবন তাদের প্রত্যাখ্যান করছে, পৃথিবী তাদের অস্বীকার করছে। একদিকে সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন অন্যদিকে প্রগতিহীন ধর্মীয় পীড়ন, কোন পথে যাবে বাঙালী মুসলিম সম্প্রদায়? হিপক্রিসির মিশিলে পুঁজিবাদী আরাম-আয়েশ আর হেজাবী আঁড়াল, এসব দেখে প্রতীয়মান হয়, বাঙালীদের সামনে সুনির্দিষ্ট কোন আদর্শ নেই, যে আদর্শের পথ ধরে মানবিক লক্ষ্যে পৌঁছা যায়। দুকূল রক্ষা করে চলার ভ-ামির ফসল, আজকের তারুণ্যের মানবিক বিপর্যয় ও বিকৃত আচরণ। নিজস্ব সাংস্কৃতিক কর্মকা-ের ধারা অব্যাহত রাখতে পারলে কিছুটা হলেও তারুণ্যের পতন রোধ করা যাবে বলে বিজ্ঞজনের ধারণা। তবে বিশ্বায়নের এই যুগে আমদানিকৃত বাণিজ্যিকভিত্তিক সাংস্কৃতিক বিনোদনে তারুণ্যের রুচিবোধ কতটা শুদ্ধ হচ্ছে, প্রগতির নামে শালীনতাহানি কতটা বিস্তার ঘটছে, এ বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে দেখতে হবে। কিন্তু কিভাবে রোধ করা যাবে বুর্জোয়াদের আকাশ সংস্কৃতির অবাধ বিচরণ? এই আকাশ সংস্কৃতির মধ্যে আমাদের তরুণরা খুঁজে পর্ণশয্যা। তাদের সংগ্রহে থাকে ডজন ডজন নেকেট ছবিসহ ভিডিও যা তাদের ব্যক্তিগত বিষয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে, অন্যকে আক্রমণের নির্লজ্জ হাতিয়ার হিসেবেও কখনও কখনও ব্যবহার করছে। আকাশ সাংস্কৃতির বুর্জোয়ারা আমাদের সামাজিক সকল সম্পর্ক কিনে ফেলেছে। আমাদের সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব লেখক, চিকিৎসক, আইনজীবীরা পরিণত হয়েছে শ্রমিকে। এদের অর্জন, অভিজ্ঞতা, সৃজনশীলতা বিনিময় হয় বাজারমূল্যে। সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বদেরও চলতে হয় বাজারের নিয়মে। তাই সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের ওপর যথাযথ নিয়ন্ত্রণ না থাকলে, বাঙালীদের নিজস্ব সংস্কৃতি বিলীন হয়ে যাবে কালের গর্বে। তারুণ্য তার রং বদলাবে উগ্রবাদে কিংবা নগ্নতায়। অসাম্প্রদায়িকতা এই একটি আদর্শের বিপরীত শব্দ মনুষ্যত্বশূন্যতার কবলে আমাদের তরুণ প্রজন্ম। যার দ্বারা সহজেই প্রভাবিত হচ্ছে- তারুণ্যের সহজাত ভাবনা। মনুষ্যত্বশূন্য সাম্প্রদায়িক বিভাজনের চূড়ান্ত ফলাফল আজকের বাংলাদেশ। সাম্প্রদায়িক বিভাজন প্রক্রিয়ায় বিভাজিত তরুণ প্রজন্ম মানুষে মানুষে ভাবতে পারে না সাম্যের কথা। ভাবতে পারে না বৈষম্যহীন সমাজের কথা। মানতে পারে না ধর্মনিরপেক্ষতা। এই মানসিকতার যুক্তিহীনরা ধর্ম চায় না, ধর্মের নামে মানুষের ওপর চাপিয়ে দেয় পীড়ন। তারা চায় বাক-স্বাধীনতা হরণ। প্রকৃত অর্থে ধর্মের অতিন্দ্রীয় মর্ম দ্বারা তারা নয় আলোড়িত। আজকের তরুণ আগামী দিনে হবে যৌবনের জৌলুস বার্ধক্যের নির্যাস। তাই তরুণ প্রজন্ম নিয়ে আমার বন্দনা, তারুণ্যের অলি-গলি ভরে উঠুক স্বপ্নের জোয়ারে, খোয়াবের খনি জেগে উঠুক প্রীতিতে। উপেক্ষিত হোক, না-হয় গৎবাঁধা নিয়মনীতি বৈরি হাওয়া লাগুক, না-হয় পালে। ভেঙে যাক বন্ধনহীন, ঐক্যহীন জীবন প্রণালীর বিক্ষুদ্ধ প্রাচীর। সকল বৃত্তের জন্য হোক একটি সরল পৃথিবী। নিম্ন-মধ্য-উচ্চ কোন বৃত্তে নেই পতনের হাতছানি। শাসন-অনুশাসনে অন্তর্মুখী আত্মকেন্দ্রিক রুদ্ধশ্বাস নীরবতা, উন্মোচিত হোক জীবনের জয়গানে। সম্ভাবনার সকল দ্বার মুক্তি পাক তারুণ্যের মিছিলে। সঙ্কটাপূর্ণ সন্ধিক্ষণ। রুখে দেবে শান্তিপূর্ণ বিপ্লবী স্লোগানে স্লোগানে।
×