ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

মহাখালীর একটি জঙ্গী আস্তানায় দীপন হত্যাকারীদের ট্রেনিং হয়

প্রকাশিত: ০৫:৫৫, ৪ অক্টোবর ২০১৬

মহাখালীর একটি জঙ্গী আস্তানায় দীপন হত্যাকারীদের ট্রেনিং হয়

গাফফার খান চৌধুরী ॥ প্রকাশক ফয়সাল আরেফিন দীপন হত্যায়ও স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছে পুরস্কার ঘোষিত জঙ্গী আব্দুস সবুর ওরফে আব্দুস সামাদ ওরফে সুজন ওরফে রাজু ওরফে সাদ। রবিবার ঢাকার সিএমএম আদালতে সবুর ওই জবানবন্দী দেয়। প্রকাশক ফয়সাল আরেফিন দীপন হত্যা ও শুদ্ধস্বর প্রকাশনায় হামলার প্রথম ট্রেনিং হয় টঙ্গীর একটি জঙ্গী আস্তানায়। এরপর দুটি সিøপার সেল ভাগ হয়ে যায়। মহাখালীর একটি জঙ্গী আস্তানায় দীপন হত্যাকারীরা চূড়ান্ত ট্রেনিং নেয়। সেই ট্রেনিং করানোর অনেক দায়িত্ব পালন করে সবুর। আর ঢাকার উত্তরার একটি জঙ্গী আস্তানায় ট্রেনিং নেয় শুদ্ধস্বর প্রকাশনায় হামলাকারীরা। দুটি ঘটনায়ই পাঁচজন করে অংশ নিয়েছিল। অপারেশন দুটি চালানোর পর পূর্বপরিকল্পনা মোতাবেক দুটি দল দুই আস্তানায় চলে যায়। এরপর সেখান থেকে আরেকটি আস্তানায় যায়। সেই আস্তানায় অস্ত্র জমা দিয়ে যে যার যার মতো অন্যত্র চলে যায়। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। গত বছরের ৩১ অক্টোবর ঢাকার মোহাম্মদপুরে শুদ্ধস্বর প্রকাশনীতে হামলা করে তিনজনকে হত্যার চেষ্টা করে এবং একই দিন রাজধানীর আজিজ সুপার মার্কেটে জাগৃতি প্রকাশনার প্রকাশক ফয়সাল আরেফিন দীপনকে গলা কেটে হত্যা করা হয়। মামলা দুটির তদন্ত করছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। তদন্তের ধারাবাহিকতায় গত ৩ সেপ্টেম্বর ডিবি পুলিশের হাতে টঙ্গী থেকে গ্রেফতার হয় আব্দুস সবুর। সবুর ঢাকা মহানগর পুলিশ কর্তৃক পুরস্কার ঘোষিত ছয় জঙ্গীর একজন। তাকে ধরিয়ে দিতে ২ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছিল। সবুরের দেয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দীর বরাত দিয়ে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, গত বছরের ২৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে জঙ্গীদের হাতে খুন হওয়া প্রকৌশলী ড. অভিজিত রায়ের লেখা বই প্রকাশ করায় মোহাম্মদপুরের শুদ্ধস্বর ও জাগৃতি প্রকাশনার মালিকদের হত্যার টার্গেট করে আনসারুল্লাহ বাংলা টিম। আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের কেন্দ্রীয় শূরা কমিটিতে প্রকাশনা দুটির মালিকদের হত্যার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়। সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেয়া হয় জঙ্গী সংগঠনটির সামরিক শাখার কমান্ডার সেনাবাহিনী থেকে বরখাস্তকৃত মেজর জিয়াউল হক জিয়াকে। এরপরই শুরু হয় সার্বিক কার্যক্রম। টার্গেট অনুযায়ী দুটি প্রকাশনার মালিকদের সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করে জঙ্গী সংগঠনটির তথ্য ও প্রযুক্তি শাখা। দীর্ঘদিন ধরেই এমন প্রক্রিয়া চলছিল। দুই প্রকাশনার মালিকদের হত্যার জন্য দুটি সিøপার সেল গঠন করা হয়। প্রতিটি সিøপার সেলে পাঁচজন করে রাখা হয়। দুটি সিøপার সেলকে অপারেশনের সার্বিক বিষয়াদি বুঝিয়ে দেয় পুরস্কার ঘোষিত আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সামরিক কমান্ডার পলাতক বরখাস্তকৃত মেজর জিয়াউল হক জিয়া। সিøপার সেল দুটির প্রাথমিক প্রশিক্ষণ হয় চট্টগ্রামে। পরে তাদের গাজীপুরের টঙ্গীতে পাঠানো হয়। টঙ্গীর বর্ণমালা সড়কের একটি বাড়িতে সিøপার সেলটির প্রশিক্ষণ চলতে থাকে। এরপর সেল দুটির একটিকে পাঠানো হয় ঢাকার উত্তরা এলাকার একটি জঙ্গী আস্তানায়। এ আস্তানায় থাকা সিøপার সেলের পাঁচ সদস্য মোহাম্মদপুরের শুদ্ধস্বর প্রকাশনায় হামলা চালায়। সিøপার সেলটির সদস্যরা আগে থেকেই প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ছিল। আর রাজধানীর মহাখালীর একটি জঙ্গী আস্তানায় পাঠানো হয় অপর সেলটিকে। ওই সেলটি অতটা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ছিল না। তাদের মহাখালীর আস্তানায় সবুর প্রশিক্ষণ দেয়। সেই প্রশিক্ষণে অন্য সামরিক কমান্ডাররাও ছিল। সেখানে দীর্ঘদিন প্রশিক্ষণ চলে। প্রশিক্ষণ শেষে একই সময়ে দুটি সেল দুই অপারেশনে যায়। মহাখালীর আস্তানায় থাকা সেলটি জাগৃতি প্রকাশনীতে হামলা চালায়। হামলায় অংশ নেয়া পাঁচজনের কাছেই পাঁচটি চাপাতি ছিল। শুধু একজনের কাছে আগ্নেয়াস্ত্র ছিল। দীপন হত্যার অপারেশনের মূল দায়িত্ব পালন করে গ্রেফতারকৃত জঙ্গী সিফাত। দুটি অপারেশন শেষে দুই সেলের সঙ্গে আবার মোবাইল ফোনে যোগাযোগ হয়। মোহাম্মদপুরের অপারেশন সফল না হওয়ায় সেলটিকে রীতিমতো তিরস্কৃত হতে হয়েছিল। অপারেশন শেষে পূর্বপরিকল্পনা মোতাবেক সেলের সদস্যরা যার যার আস্তানায় চলে যায়। মহাখালীর আস্তানায় গিয়ে দীপনের হত্যাকারীরা ব্যাগ গুছিয়ে নেয়। এরপর তারা অস্ত্রশস্ত্র নিয়েই রওনা হয়। সেখান থেকে তারা আরেকটি জঙ্গী আস্তানায় যায়। সেখানে অস্ত্রশস্ত্র জমা দিয়ে যে যার মতো অন্যত্র চলে যায়। সূত্রটি বলছে, হত্যাকারীদের আরেকটি জঙ্গী আস্তানা ছিল যাত্রাবাড়ীর একটি মাদ্রাসায়। সেই আস্তানায়ও প্রশিক্ষণ দেয়া হতো। সেখানে সাগর নামে একজন প্রশিক্ষণ দিত। যাত্রাবাড়ীর আস্তানায় টার্গেটকৃত আরও দুইজনকে হত্যার জন্য কয়েক জঙ্গীকে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছিল। যাত্রাবাড়ীর আস্তানায় দীপনকে সফলভাবে হত্যা করায় শুকরিয়া আদায় করে বিশেষ মোনাজাত, দোয়া, নামাজ আদায় ও মিষ্টি খাওয়া হয়। আর মোহাম্মদপুরের অপারেশন সফল না হওয়ায় রীতিমতো সমালোচনা করা হয় অংশ নেয়াদের সম্পর্কে। অস্ত্র-গোলাবারুদ যাত্রাবাড়ীর ওই আস্তানায়ই রাখা হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়। কিন্তু পরবর্তীতে অভিযানে ওই মাদ্রাসার এক শিক্ষক গ্রেফতার হলেও অস্ত্র-গোলাবারুদ উদ্ধার হয়নি। এমনকি অস্ত্র-গোলাবারুদ সম্পর্কে ওই শিক্ষকের কাছ থেকে কোন তথ্যও মেলেনি। এ ব্যাপারে মামলার তদন্তকারী সংস্থা ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের দক্ষিণ বিভাগের উপকমিশনার মাশরুকুর রহমান খালেদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, সবুর রবিবার ঢাকার সিএমএম আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দী দিয়েছে। তবে জবানবন্দীতে কী বলেছে, তা তার জানা নেই।
×