ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

জাফর ওয়াজেদ

নির্জীব নির্জোট আন্দোলন

প্রকাশিত: ০৫:৫১, ৩ অক্টোবর ২০১৬

নির্জীব নির্জোট আন্দোলন

জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন বা নির্জোট আন্দোলন কিংবা নন এ্যালাইনড মুভমেন্ট, যে নামেই ডাকা হোক বাঙালীদের কাছে তা ‘ন্যাম’ নামেই পরিচিত। ১৯৭৩ সালে আলজিয়ার্সে অনুষ্ঠিত ন্যাম শীর্ষ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধুর যোগদান এবং ভাষণ আজও স্মরণীয় হয়ে আছে। সেই সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণে বলেছিলেন, ‘বিশ্ব আজ দুই ভাগে বিভক্ত। একদিকে শোষক আর অন্যদিকে শোষিত। আমি শোষিতের পক্ষে।’ এই বক্তব্য আজও উচ্চারিত হয় বাঙালীর কণ্ঠে। সেই সম্মেলনে শোষকের অন্তহীন ঐশ্বর্যের নগ্ন অহমিকার পদতলে পিষ্ট, ক্ষুধা ও দারিদ্র্যের নিদারুণ কষাঘাতে জর্জরিত শোষিত বিশ্বের আত্মার আর্তনাদকেই বঙ্গবন্ধু প্রতিধ্বনিত করেছিলেন তাঁর দিকনির্দেশনামূলক ঐতিহাসিক ভাষণে। শোষিত বিশ্বকে বাঁচাতেই হবে বলে বঙ্গবন্ধুর জলদগম্ভীর উচ্চারণ উপস্থিত বিশ্ব নেতৃবৃন্দকে আলোড়িত করেছিল। বঙ্গবন্ধুর ভাষণ অকুণ্ঠ প্রশংসা অর্জন করেছিল। ভাষণ শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গেই সর্বপ্রথম তাকে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন কিউবার প্রেসিডেন্ট ফিদেল ক্যাস্ট্রো। বঙ্গবন্ধুকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন, ‘মুজিব, শোষকের বিশ্বের বিরুদ্ধে শোষিত বিশ্বের এই বাঁচার সংগ্রাম আমারও সংগ্রাম।’ সেই সম্মেলন বিশ্বজুড়ে আলোড়িত হয়েছিল। বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো ন্যাম সম্মেলনের আয়োজন করেছিল সদস্য রাষ্ট্র হিসেবে ২০০১ সালে। ১৯৯৯ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায় অনুষ্ঠিত সম্মেলনে পরবর্তী সম্মেলনের স্থান বাংলাদেশে নির্ধারণ করা হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্মেলনের সার্বিক প্রস্তুতিও নেন। সম্মেলনকে কেন্দ্র করে ঢাকার বেশ কয়েকটি ন্যাম ফ্ল্যাট নির্মাণ করা হয়। বিদেশী অতিথিদের অবস্থানের জন্য নির্মিত হয় এসব। ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় এসে প্রথমেই সম্মেলন বাতিল করে দেয়। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম জিয়া ও তার অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান সংসদেই বলে ফেলেন, ন্যাম সংস্থাটির আর কোন কার্যকর ভূমিকা নেই। এই সম্মেলন আয়োজন অর্থহীন। তাদের নেতিবাচক মনোভাবের কারণে ঢাকায় আর সম্মেলন হতে পারেনি। বাংলাদেশও সেক্রেটারি জেনারেলের পদটি পায়নি, যা বাংলাদেশের জন্য হতো গৌরবের। জাতিসংঘের পর সবচেয়ে বড় যে আন্তর্জাতিক সংস্থা, সেই জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন প্রতিষ্ঠার পর ৫৫টি বছর পেরিয়েছে। প্রাচ্য কিংবা পাশ্চাত্যের তথা দুই পরাশক্তির সমর্থন বা বিরোধিতা না করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ১৯৬১ সালে গঠিত হয়েছিল জোট নিরপেক্ষ অন্দোলন নামক সংস্থাটি। ১৯৫৩ সালের গোড়ায় কলম্বোতে সুকর্ণো, নেহরু ও বন্দরনায়েকের মধ্যে বৈঠকে প্রথম জোট নিরপেক্ষ অবস্থানের বিষয়টি উঠে আসে। একই বছরের সেপ্টেম্বরে ভারতীয় কূটনীতিক ভি কে কৃষ্ণ মেনন জাতিসংঘে প্রদত্ত ভাষণে জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের রূপরেখা তুলে ধরেছিলেন। এরই ধারাবাহিকতায় ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু, ইন্দোনেশিয়ার প্রথম প্রেসিডেন্ট সুকর্ণো, মিসরের দ্বিতীয় প্রেসিডেন্ট জামাল আবদেল নাসের, ঘানার প্রথম প্রেসিডেন্ট নক্রুমা এবং যুগোশ্লোভাকিয়ার প্রেসিডেন্ট জোসেফ ব্রজ টিটো সম্মিলিতভাবে সংস্থাটি গড়ে তোলায় উদ্যোগী হন। ১৯৬১ সালে বেলগ্রেডে প্রথম সম্মেলনে সংস্থাটির আত্মপ্রকাশ ঘটে। নেহরু ও টিটোর নেতৃত্বে জন্মকাল থেকেই জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের নেতা হয়ে উঠেছিল ভারত ও যুগোশ্লোভাকিয়া। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ তথা ফ্যাসিবাদের পরাজয়ের পর বিশ্বজুড়ে যখন মুক্তি সংগ্রাম জোরদার হয়ে ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণ ছিন্ন করে একের পর এক দেশ স্বাধীন হতে থাকে; সেই প্রেক্ষাপটেই জন্ম জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের। মূলত মার্কিন ‘সাম্রাজ্যবাদ’ এবং সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের মধ্যকার শীতলযুদ্ধের মধ্যে সদ্য স্বাধীন দেশগুলোর ভিন্ন মঞ্চ গড়ে তোলাই ছিল মূল উদ্দেশ্য। এশিয়া, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকার এসব দেশই হয় এ আন্দোলনের শরিক। এ দেশগুলো নিয়েই ছিল তখন আসল তৃতীয় বিশ্ব। জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন সবচেয়ে গুরুত্ব দিয়েছিল যেসব বিষয়ে, তার মধ্যে রয়েছেÑ জাতীয় স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা, যে কোন ধরনের সাম্রাজ্যবাদী জোটের বাইরে থাকা, বিদেশের মাটিতে সামরিক ঘাঁটি নির্মাণ নিষিদ্ধ, মানুষের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা এবং বিশ্বশান্তির লক্ষ্যে নিরস্ত্রীকরণ। এই লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনে ভারতের নেতৃত্ব সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছিল নেহরুর তৎপরতায়। প্রথম সম্মেলনে সংস্থার মহাসচিব বা সেক্রেটারি জেনারেল ছিলেন যুগোশ্লোভাকিয়ার প্রেসিডেন্ট টিটো, এরপর মিসরের জামাল আবদুল নাসের, জাম্বিয়ার কেনেথ কাউন্ডা, আলজিরিয়ার ইয়ারি বুমেদিন, শ্রীলঙ্কার উইলিয়াম গোপালা, রিচার্ড জয়াবর্ধনে, কিউবার ফিদেল ক্যাস্ট্রো, ভারতের রাষ্ট্রপতি নীলম সঞ্জীব রেড্ডি, জৈল সিং, জিম্বাবুইয়ের রবার্ট মুগাবে, ইন্দোনেশিয়ার সুহার্তো, দক্ষিণ আফ্রিকার নেলসন ম্যান্ডেলা ও আবেও এমবেকি, মালয়েশিয়ার মাহাথির মোহাম্মদ, মিসরের হোসনি মুবারক, মোহাম্মদ হোসেন তাঁতাউ, মোহাম্মদ মুরসি, ইরানের মোহাম্মদ আহমদীনেজাদ ও হাসান রুহানী। সর্বশেষ চলতি বছরের সম্মেলনে দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন ভেনিজুয়েলার প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরে। এর মধ্যে ফিদেল ক্যাস্ট্রো দু’দফা মহাসচিব ছিলেন। বর্তমানে ১২০টি দেশ এর সদস্য এবং ১৫টি দেশ পর্যবেক্ষক। শুরুতে সদস্য ছিল এমন কয়েকটি দেশ পরবর্তীকালে সংস্থা ছেড়ে যায়Ñ আর্জেন্টিনা, সাইপ্রাস, মাল্টা, যুগোশ্লোভাকিয়া ও ইউক্রেন। বাংলাদেশ ১৯৭৩ সালে সদস্যপদ লাভ করে। আর পাকিস্তান ১৯৭৯ সালে। প্রতিষ্ঠাকালে ১৯৬১ সালে সদস্য ছিল এশিয়ার আফগানিস্তান, কম্বোডিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ইরাক, লেবানন, মিয়ানমার বা বার্মা, নেপাল, সৌদি আরব, আফ্রিকার আলজিরিয়া, কঙ্গো, মিসর, ইথিওপিয়া, ঘানা, গায়েনা, মালি, মরক্কো, সোমালিয়া, সুদান, তিউনিসিয়া আর লাতিন আমেরিকার কিউবা। বর্তমানে ইউরোপের মধ্যে একমাত্র বেলারুশ সদস্য। প্রতি তিন বছর পর পর ন্যামের মহাসচিব পরিবর্তিত হয়ে আসছে। ২০১১ সালে সংস্থার পঞ্চাশ বছর পূর্ণ হয়েছে। এই দীর্ঘ পথ-পরিক্রমায় গত শতকের ষাট, সত্তর ও আশির দশকে ন্যাম গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে ছিল। যুক্তরাষ্ট্র বরাবরই এ সংস্থার বিরোধী অবস্থানে ছিল। বিশ্বের পাঁচ নেতার ন্যাম গড়ার উদ্যোগের পেছনে ছিল সদস্য দেশগুলোর আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ঘটানো এবং বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠা ও সহযোগিতা স্থাপন। ১৯৫৫ সালে ইন্দোনেশিয়ার বান্দুংয়ে অনুষ্ঠিত এশিয়া ও আফ্রিকার দেশগুলোর সম্মেলনে ন্যামের প্রস্তুতিপর্ব শুরু হয়েছিল। সভাপতি হিসেবে সুকর্ণ একটি গাইডলাইন পেশ করেছিলেন। ন্যামের নেহরু, উ নু, টিটো, নক্রুমার এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছিলেন হোচিমিন, নরোদম সিহানুক, উথান্ট, চৌ এন লাই প্রমুখ। ভেনিজুয়েলার মার্গারিতা দ্বীপে গত ১৩ সেপ্টেম্বর থেকে ১৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত অনুষ্ঠিত ১৭তম ন্যাম শীর্ষ সম্মেলনে ১২০টি সদস্য রাষ্ট্রের মধ্যে মাত্র ৩৫ দেশের নেতা ও প্রতিনিধি যোগ দেন। ন্যাম যে বিশ্বনেতাদের আর টানছে না, তাই প্রমাণ করে এই স্বল্পসংখ্যক সদস্য রাষ্ট্রের নেতৃবৃন্দের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে। এবারের সম্মেলনে উল্লেখযোগ্য সদস্য দেশগুলোর নেতাদের গরহাজির জোট নিরপেক্ষ বা নির্জোট আন্দোলনের কার্যকারিতাকে প্রশ্নের মুখে ঠেলে দিয়েছে। তাদের অনুপস্থিতি এ সম্মেলনের সাফল্যকে ম্লান করে দিয়েছে। অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সঙ্কটাপন্ন ভেনিজুয়েলায় আয়োজিত সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেনÑ ন্যামের বিদায়ী সেক্রেটারি জেনারেল ও ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানী, জিম্বাবুইয়ের প্রেসিডেন্ট রবার্ট মুগাবে, কিউবার রাউল ক্যাস্ট্রো, ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস, ভারতের উপ-রাষ্ট্রপতি হামিদ আনসারী। এছাড়া বলিভিয়ার ইভা মোরলেস ও ইকুয়েডরসহ ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জের দেশের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। সম্মেলনে নতুন মহাসচিব ভেনিজুয়েলার প্রেসিডেন্ট নিকোলা মাদুরো বলেছেন, তাকে ক্ষমতাচ্যুত করতে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্র যে অর্থনৈতিক যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে, তাতে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে তার দেশ। তার দাবির প্রতি ঐকমত্য পোষণ করেন রাউল ক্যাস্ট্রো। জ্বালানি তেল রফতানিকারক দেশগুলোর সংস্থা ওপেকের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ও বিশ্বে বৃহত্তম তেলসমৃদ্ধ দেশ ভেনিজুয়েলা চাইছে অশোধিত তেলের উৎপাদন কমিয়ে তেলের দাম বাড়াতে। তেলের দাম পড়ে যাওয়ায় দেশটির অর্থনীতি বিপর্যস্ত। তিন বছর ধরে চলছে মারাত্মক অর্থনৈতিক মন্দা। মুদ্রাস্ফীতি বেড়েছে, এসব নিয়ে দেশটিতে যখন বিক্ষোভ আন্দোলন চলছে, তখনই এ সম্মেলন চলছিল। মাদুরো অবশ্য বলেছেন, ভেনিজুয়েলা প্রচ- আক্রমণের শিকার হচ্ছে। এ যুদ্ধ অন্য লাতিন আমেরিকা ও ক্যারিবীয় দেশগুলোর বিরুদ্ধে চালানো হচ্ছে। আরোপিত এ যুদ্ধ দেশগুলোর রাজনীতি অর্থনীতি সংস্কৃতি ও জীবনকে পুনরায় ঔপনিবেশিকতায় আবদ্ধ করতে চায় বলে সম্মেলনে বলা হয়। সম্প্রতি কিউবার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের বরফ গলতে শুরু করেছে। তথাপি রাউল ক্যাস্ট্রো কিউবার ওপর যুুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা অবসান নিয়েও নিজের শঙ্কা ব্যক্ত করে বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের অন্তর্ঘাতমূলক তৎপরতা ও নাক গলানোর কারণে আঞ্চলিক জোটগুলো পথ হারাচ্ছে। সম্মেলনে ব্রাজিলের বামপন্থী প্রেসিডেন্ট দিলমা রুসেফের অভিশংসনের নিন্দা করা হয়েছে। মূলত সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী দেশগুলো যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী এবং সমাজতান্ত্রিক মনোভাবাপন্ন। বিশেষ করে লাতিন আমেরিকার দেশগুলো এ সংস্থাকে টিকিয়ে রাখার পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। তবে বিস্ময়কর যে সংস্থার অন্যতম প্রধান প্রতিষ্ঠাতা ভারত, সেই দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এ সম্মেলনে যোগ দেননি। তিনি এ সময় ব্যস্ত ছিলেন ভারতের গুজরাটে আড়ম্বরপূর্ণ নিজের জন্মদিন পালনে। বিশ্বের সর্বকালের সর্ববৃহৎ জন্মদিনের কেক কেটেছেন। সুযোগ পেলেই যিনি বিদেশে পাড়ি দেন, কোন দেশে দু’বার তিনবার যেতেও যার ক্লান্তি নেই, বিদেশ সফরে সব ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীকে যিনি ইতোমধ্যেই পেছনে ফেলে দিয়েছেন, সেই মোদির অনুপস্থিতিতে প্রশ্নের জন্ম দেয়া স্বাভাবিক। ন্যাম নিয়ে তিনি একটি বাক্যও উচ্চারণ করেননি। ১৯৬১ সালে প্রতিষ্ঠার পর মোট ১৬টি শীর্ষ সম্মেলনের মধ্যে একটি ছাড়া প্রতিটিতেই উপস্থিত ছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রীরা। এবার নিয়ে দ্বিতীয়বার। দেখা গেছে, সোভিয়েত বিপর্যয় এবং নয়া উদারনীতি চালু হওয়ার পর জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন নিয়ে বিভিন্ন দেশের উৎসাহে বেশ ভাটার টান লেগেছে। ভারতও হয়ত তাই। তবে ন্যামের মৌলিক অবস্থান বিশেষ পাল্টায়নি। মোদি সরকার সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী নয় বরং যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ মিত্রশক্তি হতেই বদ্ধপরিকর; বিদেশে মার্কিন সামরিক ঘাঁটিতেও তার আপত্তি নেই এবং নিরস্ত্রীকরণের বদলে অস্ত্র প্রতিযোগিতা ও বৃহৎ সামরিক শক্তিধর হয়ে উঠতে বদ্ধপরিকর। তাছাড়া গণতান্ত্রিক ও বামপন্থী ভেনিজুয়েলায় সরকার পতনের জন্য গভীর ষড়যন্ত্র চলছে যেখানে, সেখানে এর বিরুদ্ধে ভারত কোন অবস্থান নেয়নি। সম্ভবত যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধিতা না করতে মোদি সরকারের এই সিদ্ধান্তের কারণ। সম্মেলনে বাংলাদেশও যোগ দেয়নি। বিশেষ করে কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রে পূর্বনির্ধারিত সফরসূচী থাকায় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিতে পারেননি। তবে বাংলাদেশ ন্যামের সদস্য রাষ্ট্র হিসেবে নিজেদের অবস্থানকে সব সময় ধরে রেখেছে। জোট নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতির কারণে সকল দেশের সঙ্গেই সুসম্পর্ক রয়েছে। বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতিতেও ন্যামের কার্যকারিতা হারিয়ে যায়নি। বিশ্বজুড়ে জঙ্গীবাদের যে সমস্যা, তা নিরসনে ন্যাম ভূমিকা রাখতে পারে। তবে এবারের সম্মেলনে এ বিষয়ে পৃথকভাবে কোন আলোচনা হয়নি। একুশ শতকে নতুন প্রেক্ষাপটে নতুনভাবে ন্যাম মাথাচাড়া দিয়ে উঠবেÑ এমন আশা করা যায়। কিন্তু এমন একটি জোট ক্রমশ দুর্বল হয়ে যাবে, তা কারও কাম্য হতে পারে না। বাংলাদেশ ভবিষ্যতে ন্যামের মহাসচিবের পদ অলঙ্কৃত করার সুযোগ পাবে কিনা, তা স্পষ্ট নয়। বাঙালীর কাছে ন্যাম চিরস্মরণীয় হয়ে থাকার সম্ভাবনা বেশি তেহাত্তরে বঙ্গবন্ধুর অংশগ্রহণের জন্য। যেখানে তিনি বিশ্বনেতার স্বরূপে আবির্ভূত হতে পেরেছিলেন। নির্জোট আন্দোলন ক্রমশ নির্জীব হয়ে পড়েছে। বিশ্বের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক মঞ্চে সংস্থাটি তার আবেদন ধরে রাখতে পারছে, এমনটি নয়। বিশ্ব আলোড়িত ন্যাম উন্নয়নশীল ও অনুন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে সহযোগিতার সম্পর্ক বাড়াতে সচেষ্ট হবেÑ এটা ভাবা দুষ্কর। তারপরও ন্যাম থাকবে তার গ-িতে আবদ্ধ হয়ে পড়ে থাকলেও।
×