ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

বিশ্ব বসতি দিবস আজ

রাজধানীর এক কোটি বাসিন্দার নিজস্ব বাসস্থান নেই

প্রকাশিত: ০৫:২৭, ৩ অক্টোবর ২০১৬

রাজধানীর এক কোটি বাসিন্দার নিজস্ব বাসস্থান নেই

রহিম শেখ ॥ ১৯৭৪ সালে ঢাকায় যেখানে লোকসংখ্যা ছিল মাত্র ১৭ লাখ, তা এখন বেড়ে দাঁড়িয়েছে এক কোটি ৭০ লাখে। গত ৪০ বছরে ১০ গুণ মানুষ ঢাকাবাসী হয়েছেন। মহানগরীর পরিধি দ্রুত সম্প্রসারণের সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে রাজধানীতে বাসস্থানহীন মানুষের সংখ্যা। পরিসংখ্যান বলছে, রাজধানী ঢাকায় বসবাসকারী প্রায় এক কোটি মানুষের নিজস্ব বাসস্থান নেই। এ বিপুলসংখ্যক মানুষকে ভাড়াটে বাসায়, সরকারী বাসায় বা বস্তিতে বসবাস করতে হয়। এর মধ্যে বস্তিবাসীরা আশ্রয় নিয়েছেন সরকারী বা ব্যক্তিমালিকানাধীন জায়গার ওপর। এছাড়া নিম্ন মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্তদের প্রায় কারোরই রাজধানীতে নিজস্ব মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই। নগদ মূল্যে স্বপ্নের একটি ফ্ল্যাট তৈরি করতেই বয়সের অর্ধেক পার হয়ে যায় অনেকের। যদিও অনেক দেশে স্বল্পসুদে সরকার আবাসনের জন্য মধ্য ও নিম্ন আয়ের মানুষকে ঋণ দিয়ে থাকে, যাতে সে নিজস্ব মাথা গোঁজার ব্যবস্থা করে নিতে পারে। বাংলাদেশে কখনই তা করা হয়নি। এ অবস্থার মধ্য দিয়েই আজ সোমবার বাংলাদেশসহ বিশ্বে পালিত হচ্ছে ‘বিশ্ব বসতি দিবস’। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ৫-৬ শতাংশ সুদে সরকার আবাসন ঋণ দিলে অনেকেই রাজধানীতে থাকার ব্যবস্থা করে নিতে পারতেন। যদিও বাংলাদেশে বিভিন্ন ধরনের ঋণখেলাপী থাকলেও আবাসন খাতের ঋণগ্রহীতাদের ৯৯ শতাংশই খেলাপী নন। এ খাতে ঋণখেলাপী খুঁজে পাওয়াই মুশকিল। কাজেই এ খাতে ঋণদানে ঝুঁকি নেই বললেই চলে। এজন্য দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা প্রয়োজন বলে মনে করেন অনেকেই। জানা গেছে, মানুষের মৌলিক অধিকার বাসস্থানের বিষয়ে বিভিন্ন সময়ে আলোচনা হলেও এখনও রাজধানীসহ দেশের বিপুলসংখ্যক মানুষের নিজস্ব বাসস্থান নেই। স্থানীয় সরকার বিভাগের হিসাবেই রাজধানীতে এখনও বস্তির সংখ্যা চার হাজার ৭২০টি। এসব বস্তিতে রাজধানীর প্রায় ৪০ লাখ মানুষ বাস করেন। মূলত সরকারী বা ব্যক্তিমালিকানাধীন জায়গার ওপর ঘর তুলে তারা বাস করেন। এ রকম লোকের সংখ্যা রাজধানীর মোট জনসংখ্যার প্রায় ৩০ শতাংশ। এছাড়া নিম্ন মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্তদের প্রায় কারোরই রাজধানীতে নিজস্ব মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই। সব মিলিয়ে সর্বোচ্চ ৩০ শতাংশ মানুষের নিজস্ব বাসস্থান আছে। এর বেশি কোনক্রমেই হবে না। পরিসংখ্যান বলছে, রাজধানীতে ৬০-৭০ লাখ মানুষের নিজস্ব বাসস্থান আছে। অন্য এক কোটি পাঁচ লাখ মানুষের মাথা গোঁজার নিজস্ব ঠাঁই নেই। পাওয়ার এ্যান্ড পার্টিসিপেটরি রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) এবং বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) এক প্রকাশনায় বলা হয়েছে, ঢাকাকে পরিকল্পিতভাবে গড়তে ২০ বছর মেয়াদী পরিকল্পনা হাতে নিতে হবে। এজন্য ১০ হাজার কোটি ডলার প্রয়োজন পড়বে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি অর্থ প্রয়োজন পরিবহন খাতে। এ খাতের জন্য সাড়ে চার হাজার কোটি ডলার প্রয়োজন। এর বাইরে পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা উন্নত করতে বড় অঙ্কের অর্থ প্রয়োজন। রিহ্যাব সহ-সভাপতি লিয়াকত হোসেন জনকণ্ঠকে বলেন, অনেক দেশে স্বল্পসুদে সরকার আবাসনের জন্য মধ্য ও নিম্ন আয়ের মানুষকে ঋণ দিয়ে থাকে, যাতে সে নিজস্ব মাথা গোঁজার ব্যবস্থা করে নিতে পারে। বাংলাদেশে কখনই তা করা হয়নি। ৭-৮ শতাংশ সুদে সরকার আবাসন ঋণ দিলে অনেকেই রাজধানীতে থাকার ব্যবস্থা করে নিতে পারতেন। গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন বলেন, বাংলাদেশে বিভিন্ন ধরনের ঋণখেলাপী থাকলেও আবাসন খাতের ঋণগ্রহীতাদের ৯৯ শতাংশই খেলাপী নন। এ খাতে ঋণখেলাপী খুঁজে পাওয়াই মুশকিল। কাজেই এ খাতে ঋণদানে ঝুঁকি নেই বললেই চলে। বিষয়টি তিনি অর্থমন্ত্রীকেও জানিয়েছেন। স্বল্পসুদে আবাসন ঋণ দেয়ার জন্য অনুরোধও করেছেন। বিশ্ব বসতি দিবস উপলক্ষে রিহ্যাবের প্রেস এ্যান্ড মিডিয়া কমিটির কো-চেয়ারম্যান কামাল মাহমুদ বলেন, নগরায়ন ও শিল্প প্রসারের লক্ষ্যে নিত্যনতুন শিল্পাঞ্চল সৃষ্টি, জনসংখ্যার ক্রমবর্ধমান চাপে নানাবিধ কারণে সাধারণ মানুষের চলাচল ও প্রবেশ উপযোগী সার্বজনীন স্থানের সঙ্কুলান বাংলাদেশের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। জলবায়ু পরিবর্তনসহ নানাবিধ কারণে বসতি সমস্যা এখন বিশ্বব্যাপী অত্যন্ত প্রকট। অর্থনৈতিক অগ্রগতির ক্ষেত্রে নগরের ভূমিকা অনস্বীকার্য। বৈশ্বিক অর্থনীতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে দ্রুত নগরায়নের প্রয়োজনীয়তা থাকলেও সেটা যেন অপরিকল্পিতভাবে গড়ে না ওঠে সেদিকে লক্ষ্য রাখা একান্ত আবশ্যক। আমরা রিহ্যাবের পক্ষ থেকে একটি পরিকল্পিত নগর গঠনে সরকারের উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে অনেকদিন ধরে কাজ করে আসছি। আমাদের এ প্রক্রিয়া চলমান। আমরা প্রায় ৭০ থেকে ৮০ হাজার ফ্ল্যাট সরবরাহ করেছি। একই সঙ্গে সমপরিমাণ প্লট সরবরাহ করেছি। আবাসন খাত এখন রাজধানীর বাইরের বিভিন্ন জেলায় বিস্তৃত হয়েছে। তিনি বলেন, নানাবিধ সমস্যা থাকলেও আমরা পরিকল্পিত নগর গঠনে বদ্ধপরিকর। জানা গেছে, ১৯৮৫ সালের ১৭ ডিসেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৪০তম অধিবেশনে সিদ্ধান্ত গ্রহণের মধ্য দিয়ে প্রতি বছর অক্টোবর মাসের প্রথম সোমবারকে ‘বিশ্ব বসতি দিবস’ হিসেবে পালন করা হয়। এবার এ দিবসের মূল প্রতিপাদ্য হলো- ‘গৃহায়নই উন্নয়নের কেন্দ্র’। দিবসটি উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি এ্যাডভোকেট আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক বাণী দিয়েছেন। রাষ্ট্রপতি তার বাণীতে বলেন, জীবনের কেন্দ্রবিন্দুতে বসতির অবস্থান অত্যন্ত সদৃঢ়। বসতিকে ঘিরেই আবর্তিত হয় মানুষের জীবন ও অন্যান্য কর্মকা-। বসতি মানুষের মৌলিক চাহিদা। তাই নগরায়নের যুগে সব মানুষের জন্য পরিকল্পিত, নিরাপদ, টেকসই আবাসনের ব্যবস্থা করা খুবই জরুরী। মোঃ আবদুল হামিদ বলেন, বর্তমান সরকার সকল নাগরিকের জন্য আবাসন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে। আশা করি নিম্ন আয়ের মানুষ এবং বস্তিবাসী থেকে শুরু করে স্বল্পবিত্ত, মধ্যবিত্ত ও সমাজের সকল শ্রেণী-পেশার বাসস্থান সংক্রান্ত মৌলিক অধিকার নিশ্চিতকল্পে আবাসন ক্ষেত্রে অগ্রগতির এ ধারা ভবিষ্যতেও অব্যাহত থাকবে। সবার জন্য বসতি নিশ্চিত করতে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারী খাতের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নগর, গ্রাম নির্বিশেষে প্রতিটি জায়গায়ই যাতে পরিকল্পিতভাবে বসতি স্থাপন করা হয় এবং জমির সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত হয় তা নিশ্চিত করতে হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার বাণীতে বলেন, বিগত প্রায় সাড়ে সাত বছরে আওয়ামী লীগ সরকার গৃহায়ন সঙ্কট নিরসনকল্পে অনুকূল ও সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টির লক্ষ্যে যথাযথ পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে সকল নাগরিকের জন্য গৃহায়ন ব্যবস্থা সহজলভ্য করতে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। তিনি বলেন, ভূমির পরিকল্পিত ও সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করতে বিভিন্নমুখী কর্মসূচী বাস্তবায়ন করেছে। হাতিরঝিল এলাকার সমন্বিত উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছি, যার ফলে ঢাকায় সৌন্দর্য বৃদ্ধির পাশাপাশি জলাবদ্ধতা নিরসনসহ সংশ্লিষ্ট এলাকার যোগাযোগের ক্ষেত্রেও আমূল পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। শেখ হাসিনা বলেন, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ও অঞ্চলভিত্তিক উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ পর্যাপ্ত উন্মুক্ত স্থান নিশ্চিত করে রাজধানী ঢাকাসহ বিভাগীয় শহরগুলোতে নাগরিক সুবিধাসংবলিত পরিকল্পিত আবাসন ও নগরায়নের লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে। তিনি বলেন, আমাদের সরকার ২০২১ সালের মধ্যে সবার জন্য সুপরিকল্পিত আবাসন নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে বদ্ধপরিকর। গৃহায়নের ক্ষেত্রেও সরকারী-বেসরকারী অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে প্রকল্প গ্রহণ করেছে। দিনটি উপলক্ষে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়, গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ হাউস বিল্ডিং রিসার্চ ইনস্টিটিউটসহ বিভিন্ন সরকারী-বেসরকারী প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন বিভিন্ন কর্মসূচীর আয়োজন করেছে। সকাল ৭টায় শহীদ মিনার থেকে বিশেষ শোভাযাত্রা শুরু হবে। ৯টায় ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছে।
×