ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

সৈয়দ হককে নিবেদিত কবিতা

নুরলদীনের কথা মনে পড়ে যায়, যখন স্বপ্ন লুট হয়ে যায়...

প্রকাশিত: ০৫:২৭, ৩ অক্টোবর ২০১৬

নুরলদীনের কথা মনে পড়ে যায়, যখন  স্বপ্ন লুট হয়ে যায়...

মোরসালিন মিজান ॥ কবি নেই আর। নেই বটে। তাঁর কবিতারা আছে। কালোত্তীর্ণ অসংখ্য কবিতার পঙক্তিতে মিশে আছেন সৈয়দ শামসুল হক। বিপুল সেই ভা-ার থেকে রবিবার খোঁজা হলো সব্যসাচীকে। আবৃত্তির নন্দীত কণ্ঠগুলো দারুণ বেজে ওঠল। স্বরচিত কবিতা পাঠ করলেন সমকালীন কবিরা। কাব্যনাট্যের উর্বর ভূমি থেকে কিছু তুলে ধরল আসাদুজ্জামান নূরের মতো ধ্রুপদী কণ্ঠ। এভাবে চমৎকার আয়োজন। টিএসসিতে আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদ আয়োজিত অনুষ্ঠান উৎসর্গ করা হলো সৈয়দ শামসুল হককে। একইসঙ্গে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে উপভোগ করলেন শ্রোতা। আবৃত্তি শিল্পীদের আয়োজন। শুরুটাও হয় আবৃত্তি দিয়ে। প্রথমেই সৈয়দ শামসুল হকের বিখ্যাত রচনা। জনপ্রিয় বাচিক শিল্পী ও পরিষদের সাধারণ সম্পাদক আহকাম উল্লাহর কণ্ঠটি বেজে ওঠে। ভরাট কণ্ঠে একটু একটু করে ফুটে ওঠেন সৈয়দ শামসুল হক। বাঙালীর আত্মপরিচয় তুলে ধরে আহকাম উল্লাহ শুনিয়ে যান- আমি তো এসেছি চর্যাপদের অক্ষরগুলো থেকে।/আমি তো এসেছি সওদাগরের ডিঙার বহর থেকে।/আমি তো এসেছি কৈবর্তের বিদ্রোহী গ্রাস থেকে।/আমি তো এসেছি পালযুগ নামে চিত্রকলার থেকে...। মাইকে যখন কবিতা, মঞ্চে তখন পুষ্পাঞ্জলি। সৈয়দ হকের প্রতিকৃতির সামনে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন সংস্কৃতি মন্ত্রী বিশিষ্ট আবৃত্তি শিল্পী আসাদুজ্জামান নূর, সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ, সাধারণ সম্পাদক হাসান আরিফসহ নবীন আবৃত্তি শিল্পীরা। ‘নূরলদীনের সারাজীবন’ কাব্য নাট্যে অভিনয় করে ঢাকার দর্শকদের বিমোহিত করেছিলেন আসাদুজ্জামান নূর। মূলত আবৃত্তি করেন তিনি। বলেন, দেশের এমন কোন জেলা নেই যেখানে আমি ‘নূরলদীনের সারাজীবন’ কাব্যনাট্য থেকে আবৃত্তি করিনি। তার পর মঞ্চের উর্বর ভূমি থেকে ওঠে আসা নন্দিত আবৃত্তি শিল্পী কণ্ঠ ছাড়েনÑ নীলক্ষা আকাশ নীল, হাজার হাজার তার ঐ নীলে অগণিত আর/ নিচে গ্রাম, গঞ্জ, হাট, জনপদ, লোকালয় আছে ঊনসত্তর হাজার।/ধবল দুধের মতো, জ্যোৎস্না তার ঢালিতেছে চাঁদ-পূর্ণিমার...। কবিতার টান কণ্ঠের মাধুর্য দূর থেকে কান পেতে থাকা মানুষটিকেও অধিকার করে নেয় শতভাগ। এই তাহলে নূরলদীন? এত আবেগ আবেদন প্রতিবাদসমেত বেঁচে আছে আসাদুজ্জামান নূরের কণ্ঠে? শ্রোতার বিস্ময় যেন কাটে না। তারা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনে যানÑ নূরলদীনের কথা মনে পড়ে যায়,/যখন শকুন নেমে আসে এই সোনার বাংলায়।/নূরলদীনের কথা মনে পড়ে যায়/যখন আমার দেশ ছেয়ে যায় দালালের আলখেল্লায়-/নূরলদীনের কথা মনে পড়ে যায়/যখন আমার স্বপ্ন লুট হয়ে যায়;/নূরলদীনের কথা মনে পড়ে যায়/যখন আমার কন্ঠ বাজেয়াপ্ত ক’রে নিয়ে যায়;/নূরলদীনের কথা মনে পড়ে যায়,/যখন আমারই দেশে এ আমারই দেহ থেকে রক্ত ঝড়ে যায়...। ভরাট কণ্ঠ। ভারসাম্যপূর্ণ ওঠা নামা। যেমন শীতল শুরু। তেমনি অগ্নিবাণে শেষ। আসাদুজ্জামান নূর যখন ‘জাগো বাহে কোণ্ঠে সবাই’ বলে শেষ করেন, শ্রোতার রোমকূপ তখন অদ্ভুত জেগে ওঠে। এমন অগ্নি, এমন দহন, কতো দিন পর! ভাস্বর বন্দ্যোপাধ্যায়ের কণ্ঠেও ছিল নূরলদীন। ভীষণ উপভোগ করেন শ্রোতা। ‘পরানের গহিন ভিতর’ থেকে আবৃত্তি করেন হাসান আরিফ। বার বার শোনা। কত কত কণ্ঠে! তবে এই আবৃত্তি শিল্পী পঙক্তিগুলো নিয়ে নিজের মতো খেলেন। এই খেলা তার নিজস্ব। নিজের মতো করে। বেশ লাগে। এদিনও পরিবেশটা বদলে দেয় তার কণ্ঠ। প্রয়াত কবি থেকে নিয়ে তিনি উচ্চারণ করেনÑ জামার ভিতর থিকা যাদুমন্ত্রে বারায় ডাহুক,/চুলের ভিতর থিকা আকবর বাদশার মোহর,/মানুষ বেবাক চুপ, হাটবারে সকলে দেখুক/ কেমন মোচর দিয়া টাকা নিয়া যায় বাজিকর।/চক্ষের ভিতর থিকা সোহাগের পাখিরে উড়াও,/বুকের ভিতর থিকা পিরীতের পুন্নিমার চান,/নিজেই তাজ্জব তুমি একদিকে যাইবার চাও/অথচ আরেক দিকে খুব জোরে দেয় কেউ টান...। পরের অংশটুকুও নিজের মতো করে যেন নির্বাচন করে রেখেছেন আরিফ। অন্য সময়ও শুনিয়েছেন। তবে সৈয়দ হকের চলে যাওয়ার পর পঙক্তিগুলো যেন আরও সত্য হয়ে ওঠে। বাস্তব এবং বেদনার হয়ে বুকে বাজে। কবির হয়েই যেন হাসান আরিফ বলে যানÑ আবার তোমার কোলে ফিরা যায় তোমার সন্তান,/ আবার তোমার কোল, খালি কোল, উথলায়া পড়ে/ দুধের ঘেরানে ভরা, জননী গো, পুন্নিমার চান...। আবৃত্তি শুনতে শুনতেই মনে হলো, কেন হাসান আরিফ বক্তৃতা করে পৌনে ছয় মিনিট সময় নষ্ট করলেন? পুরোটাই তো কবিতার হতে পারত। অনুষ্ঠানে যথারীতি ছিল ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’ কাব্যনাট্যের উপস্থাপনা। অংশ বিশেষ পরিবেশন করে কথা আবৃত্তি চর্চা কেন্দ্র। ছিল ইকবাল খুরশেদ জাফর, এনামুল হক বাবু, ফখরুল ইসলাম তারা, শামসুদ্দোহা, সুপ্রভা সেবতি, নাসিমা খান বকুলসহ ২০ জন আবৃত্তি শিল্পীর একক আবৃত্তি। অনুষ্ঠানে কবিরা স্বরচিত কবিতায় স্মরণ করেন সব্যসাচীকে। অতি সম্প্রতি লেখা কবিতা সঙ্গে করে এসেছিলেন কবি মুহাম্মদ সামাদ। সেখান থেকে তিনি উচ্চারণ করেন। সৈয়দ হককে নিবেদন করে বলে যানÑ তুমি মাটির প্রেমিক/তুমি জলের প্রেমিক/তুমি নদীর প্রেমিক/তুমি নারীর প্রেমিক....। কবিতার পাশাপাশি ছিল স্মৃতিচারণ। সৈয়দ হকের মূল্যায়ন করেছেন বক্তারা। আলোচনায় অংশ নিয়ে গোলাম কুদ্দুছ বলেন, সৈয়দ হক শুধু লিখেননি। সকল আন্দোলন সংগ্রামে আমাদের পাশে ছিলেন। সকল বিদ্রোহ বিপ্লবে অনুপ্রেরণার অনন্ত উৎস হয়ে থাকবেন তিনি। এভাবে নানা আয়োজনে স্মরণ করা হয় সৈয়দ হককে। পরানের গহিন ভিতর থেকে নিবেদন করা হয় শ্রদ্ধা ভালবাসা। সৈয়দ হকের মৃত্যুতে শোক ॥ সৈয়দ শামসুল হকের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ অব্যাহত রয়েছে। রবিবার শোক করেছে বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন। কমিশনের বৈজ্ঞানিক তথ্য বিভাগের পরিচালক স্বাক্ষরিত এক শোকবার্তায় প্রয়াত কবির বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানানো হয়।
×