ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য বীরত্বের সেই রাজা আজ ব্রেনস্ট্রোকে অচল

প্রকাশিত: ০৬:০১, ২ অক্টোবর ২০১৬

মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য বীরত্বের সেই রাজা আজ ব্রেনস্ট্রোকে অচল

রশিদ মামুন ॥ সুলতান উদ্দিন আহমেদ (রাজা) বীর মুক্তিযোদ্ধা। যুদ্ধ করেছেন দুই নম্বর সেক্টরে। যুদ্ধদিনে তিনি ঢাকার চার থানা কেরানীগঞ্জ, সূত্রাপুর, লালবাগ, কোতোয়ালির সাব-ডিভিশনাল কমান্ডার ছিলেন। ১৯৭১-এ ঢাকায় গেরিলাযুদ্ধে তিনি অসামান্য বীরত্বের স্বাক্ষর রাখেন। নিবেদিতপ্রাণ এই মুক্তিযোদ্ধা দেশের মুক্তিযোদ্ধাদের কল্যাণে সুদীর্ঘ সময় কাজ করেছেন। প্রতিষ্ঠাকাল থেকেই বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সঙ্গে তিনি যুক্ত ছিলেন। আকস্মিক ব্রেনস্ট্রোকে তিনি এখন অসুস্থ জীবন কাটাচ্ছেন। একেবারেই স্বাভাবিক জীবনযাপনে ফিরতে পারছেন না। অথচ অসুস্থতার আগ পর্যন্ত নিজস্ব ব্যবসা আর মুক্তিযোদ্ধা সংসদ নিয়ে কাটত তাঁর ব্যস্ত সময়। দিন-রাত কাজ করে গেছেন মুক্তিযোদ্ধাদের কল্যাণে। সম্প্রতি দৈনিক জনকণ্ঠের সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ থেকে শুরু করে সমকালীন নানা বিষয়ে কথা বলেন। বাবা মরহুম গিয়াস উদ্দিন আহমেদ যুক্তফ্রন্টের সময়ে শেরে বাংলা একে ফজলুল হক সরকারের খাদ্যমন্ত্রী ছিলেন। তাঁর নানা শামসুদ্দিন আহমেদও যুক্তফ্রন্টের রাজনীতি করতেন। বাবা এবং নানার রাজনীতির প্রতিফলন ঘটে মুক্তিযোদ্ধা রাজার জীবনে। ছাত্রজীবন থেকেই রাজনীতিসচেতন রাজা ’৭১-এ ঘরে বসে থাকতে পারেননি। দেশমাতৃকাকে বাঁচাতে জীবনবাজি রেখে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন মুক্তির সংগ্রামে। আমাদের এনে দিয়েছেন স্বাধীনতার লাল সূর্য আর লাল-সবুজের নতুন এক পতাকা। তিনি জানালেন, ছাত্রজীবনেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে দেখেছি আমাদের স্কুলে আসতেন। সঙ্গে আসতেন মোহাম্মদ হানিফ। তিনি বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর ছিলেন। পরবর্তী সময়ে তিনি ঢাকার মেয়র নির্বাচিত হয়েছিলেন। মূলত মুক্তিযুদ্ধের ভিত তৈরি হয় ওই সময়ে। পাকিস্তানীদের শোষণ আর বঞ্চনা আমাদের যখন কুরে কুরে খাচ্ছিল, তখন দেখেছি মানুষ কিভাবে সংগঠিত হয়েছে। দেখেছি মানুষ কেমন পাগল ছিল, অন্ধ ভক্ত ছিল বঙ্গবন্ধুর। স্বাধীনতার পরও বঙ্গবন্ধুকে কাছ থেকে দেখেছেন এই মুক্তিযোদ্ধা। তবে অসুস্থতার কারণে আজ অনেক স্মৃতিই ঠিকঠাক মনে করতে পারেন না। বললেন, বঙ্গবন্ধুর মতো এমন সাহসী মানুষ আর আসবেন না। এমন ভাল মানুষও আর কেউ হবেন না। যুদ্ধে যোগ দেয়ার স্মৃতি মনে করতে গিয়ে বললেন, ‘এসব তো আর ভোলার নয়। প্রত্যেকটা সেকেন্ড, প্রত্যেকটা মিনিট মনে আছে।’ জানান, পুরান ঢাকার ওয়ারীতে কেটেছে বাল্যকাল। তাঁর বাসার ঠিক পেছনেই ছিল বর্তমান দুর্যোগ ব্যবস্থাপনামন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়ার বাসা, তার পাশেই ছিল ঢাকার সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকার বাসা, কাছাকাছি তখন রথখোলায় থাকতেন দৈনিক জনকণ্ঠ সম্পাদক মোহাম্মদ আতিকউল্লাহ খান মাসুদ। জানালেন, সব সময় সকালে আড্ডাটা বসত তাদের বাসাতেই। বললেন, আমরা তখন থেকেই এলাকার সালিশ-বিচার করতাম। এখন ভারতে এই প্রথা চালু থাকলেও আমাদের এখানে তা নেই। মানুষের সঙ্গে মানুষের যে সম্পর্ক সেখানে দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে। বন্ধনগুলো হাল্কা হয়েছে। এতে করে যে কোন সঙ্কটে সামাজিকভাবে আর মানুষ ঐক্যবদ্ধ হতে পারে না। কিন্তু আগে পুরান ঢাকায় এই রীতি প্রচলিত ছিল। মানুষের বিপদে মানুষ এগিয়ে যেত। সেই রকম একটি সময়ে ২৫ মার্চ ১৯৭১-এ যে কালরাত্রি নেমে আসবে আমরা তা ভাবতেও পারিনি। এর ব্যাপকতা দেখে মানুষ বিস্মিত-হতবাক হয়েছে। আমরা আর বসে থাকতে পারিনি। স্মৃতি হাতড়ে বলেন, তখন ১৯৬৪-তে আমি ঢাকার গ্র্যাজুয়েট স্কুল এ্যান্ড কলেজ থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করি। এরপর জগন্নাথ কলেজ ভর্তি হলাম। সেখান থেকেই পরবর্তীতে ১৯৭২ সালে বিকম পাস করি। জগন্নাথ কলেজে তখন রাজনীতির চর্চটা সাংঘাতিকভাবে ছিল। জগন্নাথ কলেজ যা বলত সেভাবেই সারাদেশের ছাত্ররা চলত। আমাদের সময়ে ফিরোজ রশীদ ছিল ভিপি। ও পড়ত আর্টসে (মানবিক বিভাগে) আমরা পড়তাম কমার্সে (বাণিজ্য বিভাগে)। তখন থেকেই আমরা বাংলাদেশের বঞ্চনা আর শোষণটা দেখেছি। আমরা মনে করতাম এভাবে আর এদের সঙ্গে থাকা যাবে না। থাকতে হলে আমাদের ক্রমাগত মার খেয়ে যেতে হবে। আমরা ভেবেছিলাম দেশটা বাঁচলে আমরাও বাঁচব। তাই দেশটাকে সবার আগে বাঁচাতে হবে। ফিরে আসেন মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিতে, ‘যখন ২৫ মার্চের ঘটনা ঘটল আমরা মনে করলাম এবার দেশটাকে বাঁচানোর সময় আমাদের সামনে চলে এসেছে। এর আগেই অবশ্য বঙ্গবন্ধু পরিষ্কার করেছিলেন, এই ডাক এই আহ্বান মুক্তিযুদ্ধের। তিনি বলেছিলেন, এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। কঠিন সময় ’৭১-এ আমরা বঙ্গবন্ধুর ডাকে আর ঘরে বসে থাকতে পারিনি। আপামর বাঙালী মাত্রই যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম। স্মৃতি হাতড়ালেন কিন্তু বাদসাধল অসুস্থতা, দিনটি ঠিক মনে করতে পারলেন না। তবে সহযোদ্ধাদের নামগুলো মনে করে বললেন, আমি, ঝিলু (কুতুব উদ্দিন খান ঝিলু) আর মাসুদ (মোহাম্মদ আতিকউল্লাহ খান মাসুদ) আমরা তিনজন রওনা দিলাম। গন্তব্য আমাদের আগরতলা। কিন্তু কিভাবে যাব তার কিছুই ঠিক ছিল না। এরপরও যুদ্ধে আমাদের যেতেই হবে। কোন অনিশ্চয়তা, কোন বাধাই আমাদের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। পরিবারের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে যাত্রা শুরু করলাম। তখন অটোরিক্সায় করে (এখনকার সিএনজির মতো ত্রিচক্রযান) আমরা যাত্রাবাড়ী পৌঁছলাম। সেখান থেকে আমরা নরসিংদী থেকে লঞ্চে করে নবীনগর পৌঁছলাম। তখন রাতে সিএ্যান্ডবি ব্রিজ পার হয়ে আমাদের নবীনগর পৌঁছাতে হয়েছিল। সিএ্যান্ডবি ব্রিজ পাহারা দিত পাক আর্মি। নবীনগরে আমাদের আওয়ামী লীগের এক চেয়ারম্যান স্বাগত জানান। রাতে তাঁর বাড়িতেই আমাদের থাকার ব্যবস্থা হলো। পরের দিন সকাল ১০টায় তাঁর বাসা থেকে আমরা আবার রওনা দিলাম। আমরা সেখান থেকে বাসে, লঞ্চে, নৌকায় এবং হেঁটে রাত আটটায় কুমিল্লার বিবিরবাজারে আরেকজন চেয়ারম্যানের কাছে পৌঁছাই। নবীনগর থেকে বিবিরবাজার পর্যন্ত যাত্রাপথের বিভিন্ন পয়েন্টে আরও মুক্তিপাগল মানুষ আমাদের সঙ্গী হলেন। বিবিরবাজারে পৌঁছে সংখ্যাটি ৫০-৬০ জনে দাঁড়াল, যারা প্রত্যেকে স্বদেশের প্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়ার জন্য ট্রেনিং নেয়ার জন্য যাচ্ছিলেন। বিবিরবাজারের চেয়ারম্যান ভদ্রলোক মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ছিলেন। তার কাজই ছিল প্রত্যেক দিন ট্রেনিং নিতে যাওয়া মানুষদের আগরতলা পৌঁছে দেয়া। তিনি আমাদের রাতে খাওয়ার ব্যবস্থা করলেন। আমরা রাতে তার বাসায় মুরগির মাংস আর ডাল দিয়ে গরম ভাত খেলাম। খাওয়ার পর রাত ১০টায় আমরা আগরতলার উদ্দেশে রওনা দেই। আমাদের সঙ্গে তখন পথ দেখানোর জন্য একজন গাইডকে দেয়া হলো। সারারাত গ্রামের পর গ্রাম হেঁটে ধানক্ষেত, খাল-বিল পাড়ি দিয়ে পরের দিন বেলা ১১টায় আগরতলা পৌঁছাই। তখন কি ক্ষুধার যন্ত্রণা! মনে আছে আমরা তিনজন চম্পাকলা আর মুড়ি কিনে খেয়েছিলাম। তখন আগরতলার কলেজটিলায় মুক্তিযোদ্ধাদের স্বাগত জানানোর জন্য একটি ক্যাম্প ছিল। সেখানে হাজার হাজার মুক্তিপাগল মানুষ প্রতিদিন যুদ্ধের ট্রেনিং নেয়ার জন্য জড়ো হতেন। তখন সেখানে তৎকালীন দু’জন ছাত্রনেতা ক্যাম্পে সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করতেন। সেখান থেকে আমাদের কলকাতা পাঠানো হলো রিক্রুটমেন্টের জন্য। কলকাতায়ও একজন ছাত্রনেতা ছিলেন। তিনি সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করতেন। আমাদের সিএনসি স্পেশাল ব্যাচের সদস্য হিসেবে রিক্রুট করা হয়। কলকাতা থেকে আমরা চলে গেলাম বিহারের চাকুরিয়াতে। সেখানে একটা পরিত্যক্ত বিমানবন্দর ছিল। সেখানে আমাদের সাত সপ্তাহ ট্রেনিং হলো। আবার আমরা চলে এলাম আগরতলায়। এবার আমাদের যুদ্ধে যাওয়ার পালা। আগরতলা ক্যাম্পের দায়িত্বে ছিলেন ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশারফ। সেকেন্ড ইন কমান্ড ছিলেন মেজর হায়দার। তারা আমাদের যুদ্ধের ব্রিফ দিলেন। তিনি বললেন, খালেদ মোশারফ অবশ্য আমাকে চিনতেন। তার ছোট ভাই রাশেদ মোশারফ আমার বন্ধু ছিল। আর খালেদ মোশারফ আমাদের জামালপুরের মানুষ হওয়ায় তাঁর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা ছিল আগে থেকেই। ট্রেনিং নিয়ে আসার পর আগরতলা থেকেই নাইট অবজারভেশনে (রাত্রিকালীন) বাংলাদেশের মধ্যে আমাদের নতুন মুক্তিযোদ্ধাদের পাঠানো হতো। আমরা সীমান্ত এলাকা দিয়ে রাতে দেশের মধ্যে প্রবেশ করতাম। তখন কেবলমাত্র আমরা নতুন ট্রেনিং শেষ করেছি, আমাদের উদ্যমটা অন্যরকম ছিল। একটু অস্থিরতাও কাজ করত। যুদ্ধের ভাষা বুঝতে হতো গুলির আওয়াজে। মনে রাখতে হতো গুলির আওয়াজ কথা কয়। গুলির আওয়াজ শুনে বুঝতে হতো পাকবাহিনীর হাতে কী অস্ত্র আছে। রাতে যখন আমরা বাংলাদেশের ভেতর প্রবেশ করি তখন গ্রামের পর গ্রাম, মাইলের পর মাইল কোন জনমানব ছিল না। মানুষজন পাকবাহিনীর ভয়ে বাড়িঘর সব ফেলে চলে গিয়েছিল। রাতে যখন আমরা ফায়ার ওপেন করি (যুদ্ধের জন্য গুলি করা) তখন পাকবাহিনীও মুহুর্মুহু গুলি শুরু করে। এভাবে কয়েকদিন রাতের যুদ্ধ দেখার পর আমরা মূল যুদ্ধে অংশ নেই। আগরতলার মনিয়ন ক্যাম্প থেকে আমরা দেশে চলে আসি। সেখান থেকে ফরিদপুর-ভাঙ্গা হয়ে আমরা ঢাকায় আসি। এখান থেকে আমার বন্ধু মাসুদ এবং ঝিলু আলাদা হয়ে যায়। তাদের মুন্সীগঞ্জের শ্রীপুরে পাকবাহিনীর প্রতিরোধে পাঠানো হয়। সেখানেই তারা মুক্তিযুদ্ধ করে। আর ঢাকা থেকে আমাকে কেরানীগঞ্জে পাঠানো হয়। আমরা বেলাবো হয়ে নারায়ণগঞ্জের নেভাল সিরাজের কাছে পৌঁছাই। সিরাজ সাহেবের কাজ ছিল ছোট ছোট মুক্তিযোদ্ধা গ্রুপকে অস্ত্র সরবরাহ করা। আমি তখন খালেদ মোশারফের একটি চিঠি দেখাই তাকে। যেহেতু আমি সিএনসি স্পেশাল ব্যাচের সদস্য, সে কারণে বাড়তি গুরুত্ব ছিল। পাকবাহিনীর নির্মমতা তুলে ধরতে গিয়ে সুলতান উদ্দিন আহমেদ বলেন, বেলাবোতে এক হিন্দু ভদ্রলোকের সঙ্গে আমাদের দেখা হয়েছিল। তিনি বড় দাড়ি রেখে টুপি পরে আমাদের সালাম দিয়েছিলেন। আমরা মনে করেছিলাম তিনি মুসলমান। পরে জানলাম বাঁচার জন্য তিনি এই বেশ ধরেছেন, যা অত্যন্ত দুঃখজনক বলে মনে হলো। লোকটা হাউমাউ করে কাঁদলেন, আমরা তাকে অভয় দিলাম। বললাম, সব একদিন ঠিক হয়ে যাবে। তখন দেখেছি হিন্দুপ্রধান এলাকার গ্রামের পর গ্রামের মানুষ এলাকা ছেড়ে গেছেন। তখন আমাদের কেরানীগঞ্জে থেকে ঢাকায় অপারেশন চালানোর দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল। তখন কেরানীগঞ্জের দায়িত্বে ছিলেন আওয়ামী লীগের তৎকালীন নেতা শমসের উল্লাহ। খালেদ মোশারফের একটা কথা খুব মনে পড়ে। তিনি বলেছিলেন, এই যুদ্ধ অনেক দীর্ঘস্থায়ী হবে, নয়ত খুব তাড়াতাড়ি শেষ হবে। এজন্য সারাদেশের এমন ১৭৪ জনকে বাছাই করা হয়েছিল, যাদের কাজ ছিল সাধারণ মানুষকে উদ্বুদ্ধ করা- যেন মানুষ দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ হলে ধৈর্যহারা না হয়। এই দলেই আমার নাম ছিল। ফিরে আসেন কেরানীগঞ্জের তৎকালীন আওয়ামী লীগ নেতা শমসের উল্লাহর কথায়। জানান, বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর ছিলেন এই শমসের উল্লাহ। তিনি ছিলেন আওয়ামী লীগের পাগল কর্মী। তাঁর মতো মানুষ ছিলেন বলেই বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। তিনি ওই সময়ে আমাদের বাঘোর এলাকাতে পরিত্যক্ত বাড়িতে থাকার ব্যবস্থা করে দিলেন। বাঘোর হিন্দুপ্রধান এলাকা ছিল। সেখানেও মানুষজন একেবারে কেউ ছিলেন না। সবাই ভয়ে পালিয়েছিলেন। আমাদের যুদ্ধের বিষয় ছিল হিট এ্যান্ড লার্ন। আমাদের গেরিলারা ঢাকায় ঢুকত, অপারেশন করে আবার ফিরে যেত। তখন কেরানীগঞ্জের একজন হোমিওপ্যাথিক ডাক্তার ছিলেন, যার নাম ডাঃ নূর আহমেদ (বর্তমান উপজেলা চেয়ারম্যান শাহিন আহমেদের বাবা)। তিনি ওই এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করতেন। তিনি সকল মুক্তিযোদ্ধার থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করতেন। যুদ্ধের স্মৃতি তুলে ধরে বলেন, ঢাকায় ছোট ছোট গেরিলাযুদ্ধে অংশ নিতাম আমরা। ঢাকায় খ্রীস্টানদের গির্জার ঘড়ি উড়িয়ে দিয়ে আতঙ্ক সৃষ্টি আবার পিডিবির ট্রান্সফর্মার উড়িয়ে দিয়ে শহরকে অন্ধকার করে দেয়ার মতো অসংখ্য গেরিলা আক্রমণ চালিয়েছি আমরা। যখন আমাদের কাছে যে নির্দেশ আসত আমরা সে অনুযায়ী কাজ করতাম। যত জায়গায় অপারেশেন হতো আমিই তার স্ট্র্যাটেজি ঠিক করতাম। যখন বড় কোন অপারেশন হতো তখন আমাদের ইনফর্মেশন দেয়া হতো। আমাদের গ্রুপ এসে রেকি করে যেত। এরপর আমাদের যোদ্ধারা হামলা চালাত হানাদারদের ঘাঁটিতে। তবে সেই ইতিহাসের কোনকিছুই সেভাবে সংরক্ষণ করা হয়নি। এই ইতিহাসের খুব একটা মূল্যায়ন কি হয়? কিছুটা অভিমানেই বললেন সে কথা। ভারতের স্বাধীনতার ইতিহাসের অনেক জায়গায় বাবা মরহুম গিয়াস উদ্দিন আহমেদের নাম ছিল। কিন্তু তাতে কারোর কি খুব কিছু একটা এসে যায়? আগে ইতিহাস থেকে মানুষ শিক্ষা নিয়ে কাজ করত, এখন আর সে রকম খুব একটা দেখা যায় না বলে আফসোস করলেন তিনি। কেরানীগঞ্জে তখন এমসিএ ছিলেন হামিদুর রহমান। তখনকার আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ (প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপুর বাবা)। তিনি আমার সঙ্গে দেখা করতে এলেন। প্রথম দিন তার সঙ্গে আমার দেখা হয়নি। পরে দ্বিতীয় দিন আমার সঙ্গে দেখা হয়েছিল। তিনি আমাকে ধন্যবাদ জানান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়ার জন্য। তার সঙ্গে একটা সম্পর্ক তৈরি হয়। এই যে আমি মুক্তিযুদ্ধ করেছি বলে তিনি আমার সঙ্গে নিজে দেখা করতে এসেছিলেন, এখন কি এমন খুব একটা হয়- এমন প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন। সুলতান উদ্দিন আহমদ নতুন প্রজন্মকে নেশামুক্ত সমাজ গড়তে কাজ করার আহ্বান জানান। নতুন প্রজন্মই ভবিষ্যতের নেতৃত্ব দেবে। বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে ধারণ করার অনুরোধ জানান তিনি। ১৯৪৯ সালের ৩ জানুয়ারি জামালপুরের চরনান্দিনা গ্রামে এক ঐতিহ্যবাহী মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। সেখান থেকে ১৯৫২ সালে সপরিবারে ঢাকায় বসবাস শুরু করেন। তিন সন্তানের মধ্যে ছেলে শিহাব উদ্দিন আহমেদ অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী। দুই মেয়ের মধ্যে রাফিফা আহমেদ রিন্টু ফার্মাসিস্ট আর ছোট মেয়ে তাসফিয়া আহমেদ রিজা ফ্যাশন ডিজাইনার। মুক্তিযোদ্ধা রাজার অসুস্থ দিনগুলো কাটছে ধানম-িতে। বলা চলে সার্বক্ষণিক সঙ্গী স্ত্রী মাহবুবা আহমেদ (রানী)।
×