ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

আরহাম উল হকের ভাস্কর্য

কঠিনে কোমল প্রাণ, গতিশীল জীবন গভীরতর বোধ

প্রকাশিত: ০৬:০০, ২ অক্টোবর ২০১৬

কঠিনে কোমল প্রাণ, গতিশীল জীবন গভীরতর বোধ

মোরসালিন মিজান ॥ কঠিনেরে ভালোবাসিলাম...। কবিগুরুর এই বোধ যেন সঞ্চারিত হয়েছে আরহামের মধ্যে। আরহাম উল হক চৌধুরী কঠিনেরে আঁকড়ে ধরেছেন। পরিত্যক্ত লোহার পাইপ, পাইপের টুকরো কুড়িয়ে নিয়েছেন তরুণ ভাস্কর্য শিল্পী। এর স্বভাব আয়ত্ত করেছেন। নিজের মতো করে ভেঙ্গেছেন। গড়েছেন। তাতেই সুন্দর সুনিপুণ ভাস্কর্য! ধানম-ির আঁলিয়স ফ্রঁসেজের লা গ্যালারিজুড়ে বহুবিধ গঠন নির্মিতি। কঠিনের সহজ সরল উপস্থাপনা। নিষ্প্রাণ লোহায় মনে হয় ভরপুর প্রাণ। দেখে সত্যি চোখ জুড়িয়ে যায়! আরহামের কাজের মাধ্যমটি, আগেই বলা হয়েছে, লোহার পাইপ। আরও সুনির্দিষ্ট করে বললে, হুইল চেয়ারে ব্যবহৃত লোহার পাইপ। অনেকেরই জানা, পক্ষাঘাতগ্রস্তদের চিকিৎসা কেন্দ্র সিআরপির ওয়ার্কশপে নিয়মিত তৈরি হচ্ছে হুইল চেয়ার। আর এ চেয়ার তৈরির প্রধান উপকরণটি-ই লোহার পাইপ। মূল কাজ শেষে ওয়ার্কশপে পরিত্যক্ত অবস্থায় থাকা এইসব পাইপ কুড়িয়ে নিয়েছেন আরহাম। পাইপ যেহেতু, আকার আকৃতি সুনির্দিষ্ট। তাতে কী? ব্যবহারটা জানা আছে। সীমিত যোগান সত্ত্বেও অনিন্দ্য সুন্দর গঠন নির্মিতি দিয়েছেন ভাস্কর। কিছু লোহার পাত, চেইনের অংশও পাওয়া যায় হুইল চেয়ার থেকে। সেগুলোর খুঁটিনাটি ব্যবহার তিনি নিশ্চিত করেছেন। এভাবে স্বতন্ত্র সৌন্দর্যের আধার হয়ে ওঠেছে এক একটি ভাস্কর্য। দেখে মনে হয় ক্যানভাসে সূক্ষ্ম তুলির আঁচড়। অনবদ্য কোন চিত্রকর্ম। আদতে ভাস্কর্য। নিষ্প্রাণ লোহা লক্কড় আশ্রয় করেই নিজের ভাবনার বিপুল বিস্তার ঘটিয়েছেন আরহাম। মূর্ত বিমূর্ত উভয় ধারায় কাজ করেছেন। কিন্তু সরল উপস্থাপনা। প্রদর্শনীর অধিকাংশই ফিগারেটিভ কাজ। প্রথম উদাহরণ হতে পারে ‘চিন্তিত’ শিরোনামের ভাস্কর্যটি। এটি একইসঙ্গে রিয়ালিস্টিক কাজ। ভাস্করের আত্মপ্রতিকৃতি। চোখের মুখের রেখাগুলো যেন পড়া যায়। অভিব্যক্তি বুঝতে কোন কষ্ট হয় না। ভাস্করের মাথায় ভাবনার যে ঘুরপাক, তার একটি আভাস পাওয়া যায় এখান থেকে। আর ভাবনার বিস্তার ঘটানো হয় বাকি ভাস্কর্যগুলোর মাধ্যমে। আরহাম উল হক নিষ্প্রাণ লোহা নিয়ে কাজ করলেও, প্রাণের উৎসব থেকে বিচ্চুত হন না। কঠিনেরে কোমল প্রাণদান করেন তিনি। মানুষ ফুল পাখি মাছ সবই এখানে ভরপুর প্রাণ হয়ে আসে। গতি পায়। একটি ফ্রি স্টান্ডিং ভাস্কর্যে ঝড়ের রাত। সরু লৌহদ-ে কয়েকটি লোহার পাত শাড়ির মতো পেঁচিয়ে দেয়া হয়েছে। তবে আশ্চর্য দক্ষতায়। পরিমিতিবোধ বজায় রেখে। ফলে নিখুঁত ফিগারটি পাওয়া হয়। ফিগার নির্মাণ করেছেন ভাস্কর। অথচ সেই ফিগার ঘিরে যে ঝড়, সেটিও দিব্যি অনুভব করা যায়! প্রদর্শনীর মাছগুলো খুব নড়েচড়ে। যেন জলেই আছে! দল বেঁধে সাঁতার কাটতে দেখা যায় মৎস্যরাজকে। নিরীক্ষাপ্রবণ ভাস্কর দুটি মাছের গড়ন তৈরি করে পাশাপাশি উপস্থাপন করেন। শূন্যে ঝুলতে থাকা মাছগুলোর শরীর কয়েকটি খণ্ডে বিভক্ত। মৃদু বাতাসে দোলে। তখন এক ধরনের চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়। মনে হয়, সাঁতার কাটছে মাছগুলো! প্রদর্শনীতে জীবন যেমন আছে, তেমনি তুলে ধরা হয়েছে জীবনের গভীরতর বোধগুলো। মানুষের নিজের সঙ্গে নিজের যে টানাপোড়েন, যে অন্তর্যুদ্ধ ভাস্কর তা রূপকের আশ্রয়ে তুলে ধরেন। খাঁচায় বন্দী প্রাণের ছটফট নতুন করে অনুভূত হয়। একই রকম একাধিক খাঁচা নির্মাণ করে তিনি দেখান, মানুষ একটি খাঁচা ভেঙ্গে আরেকটি নতুন খাঁচায় প্রবেশ করে। স্বাধীনতার স্বাদ তবু পাওয়া হয় না। আজকের পৃথিবীতে যে অন্ধ প্রতিযোগিতা, জীবনের প্রকৃত অর্থ ভুলে মিথ্যে ছোটাছুটি, তিনি একে বলেন ‘ইঁদুর দৌড়’। এই ইঁদুর দৌড়ের পরিণতি যে ভাল নয়, সে কথাও মনে করিয়ে দেন ভাস্কর। আরহাম পাইপের সরল সমান্তরাল ব্যবহারে গৌতম বুদ্ধের শরীরী রূপায়ন দেন। একইভাবে ফুটিয়ে তুলেন ক্রুশবিদ্ধ যীশুকে। ধর্মের শান্তির বাণী গ্রহণ করেন বটে। নিন্দা জানান ধর্মান্ধতার। অস্থিতিশীল সময়, দ্বন্দ্ব সংঘাতের চিত্র তুলে ধরে তার ‘মতবাদ’ শিরোনামের একটি ভাস্কর্য। স্বপ্নের কথাও বলেন। সুন্দর যত স্বপ্ন, ছুঁয়ে দিতে চান। যত কঠিন হোক, তার ভেতরে ঢুকে বাজাতে চান। কঠিন থেকে এমন সরলে রূপান্তর দেখে মুগ্ধ না হয়ে পারা যায় না। দর্শনার্থীরা চাইলে ছুঁয়ে দেখতে পারেন প্রতিটি ভাস্কর্য। ছুঁয়ে দিলেই ওরা কথা বলে। কান পাতলে শোনা যায়! ২৩ সেপ্টেম্বর শুরু হওয়া ‘কঠিন অনুভব’ শীর্ষক প্রদর্শনী ৭ অক্টোবর পর্যন্ত চলবে।
×