ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

শহীদ মিনারে স্মরণসভায় বক্তারা

সৈয়দ হক চিরজীবিত, তিনি বেঁচে থাকবেন আমাদের প্রেরণা হয়ে

প্রকাশিত: ০৫:৫১, ২ অক্টোবর ২০১৬

সৈয়দ হক চিরজীবিত, তিনি বেঁচে থাকবেন আমাদের প্রেরণা হয়ে

স্টাফ রিপোর্টার ॥ কালের সকল ধারাকে অতিক্রম করেছেন সৈয়দ শামসুল হক। সৃজনের বহুমাত্রিকতায় নিজেকে পরিণত করেছেন একটি প্রতিষ্ঠানে। স্রোতস্বিনী লেখনীর আশ্রয়ে ধারণ করেছেন বাংলাদেশকে। নাটক, গল্প, কবিতায় মেলে ধরেছেন দেশের ইতিহাসকে। সৃষ্টির নির্যাসে বলে গেছেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় গড়া অসাম্প্রদায়িক স্বদেশের কথা। সাহিত্য-শিল্পের প্রতিটি শাখায় আবির্ভূত হয়েছেন সমকালীনতায়। প্রকৃত অর্থে তিনি প্রয়াত হননি বরং চিন্তার জগতকে প্রসারিত করে এমন অবস্থানে পৌঁছেছেন, যেখানে আমরা প্রতিটি মুহূর্তে স্মরণ করব তাকে। বেঁচে থাকবেন সাহিত্য-শিল্পের নানান শাখা-প্রশাখায়। দেশের যে কোন সঙ্কটে তার লেখা ছিল প্রেরণামন্ত্রের মতো। শুধু লেখা দিয়েই নয়, সশরীরে অংশ নিয়েছেন বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামে। এভাবেই মানবমুক্তির আন্দোলনে হয়ে আছেন প্রেরণা উৎসব। সব্যসাচী সৈয়দ শামসুল হককে এভাবেই মূল্যায়ন করলেন কবি, অভিনয়শিল্পী, আবৃত্তিশিল্পী, সংস্কৃতিকর্মীসহ বিভিন্ন অঙ্গনের মানুষ। শনিবার বিকেলে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে অনুষ্ঠিত হলো সৈয়দ শামসুল হককে নিবেদিত নাগরিক শোকসভা। কবিকে স্মরণের এ আয়োজন করে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট। শোকসভায় স্মরণ করা হলো চর্যাপদের অক্ষর নেমে আসা বাংলার আলপথ ধরে হেঁটে চলা কবি সৈয়দ শামসুল হককে। তার বর্ণাঢ্য শিল্প-সাহিত্য জীবন নিয়ে কথা বললেন বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বরা। পাঠ করা হয় তার রচিত কবিতা এবং তাকে নিবেদিত কবির সদ্য লেখা কবিতা। গাওয়া হলো তার লেখা গান। পাঠ করা হলো তার কাব্যনাট্যের অংশবিশেষ। কণ্ঠশিল্পী বুলবুল ইসলামের কণ্ঠে ‘আছে দুঃখ আছে মৃত্যু’ রবীন্দ্রসঙ্গীত পরিবেশনার মাধ্যমে শুরু হয় স্মরণ অনুষ্ঠান। আলোচনা ও স্মৃতিচারণে অংশ নেন- ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক, সৈয়দ শামসুল হকের স্ত্রী আনোয়ারা সৈয়দ হক ও ছেলে দ্বিতীয়-সৈয়দ হক, সংসদ সদস্য র. আ. মুক্তাদির চৌধুরী, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব নাসিরউদ্দিন ইউসুফ, নাট্যজন আতাউর রহমান, নাট্যজন মামুনুর রশীদ, চলচ্চিত্রাভিনেতা এটিএম শামসুজ্জামান, সাংবাদিক আবেদ খান, কবি মুহম্মদ নুরুল হুদা, জাতীয় কবিতা পরিষদের সভাপতি কবি মুহাম্মদ সামাদ, কবি নাসির আহমেদ, গণসঙ্গীতশিল্পী ফকির আলমগীর, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল কলেজের উপাচার্য কামরুল হাসান খান, জাতীয় প্রেসক্লাবের সভাপতি মুহাম্মদ শফিকুর রহমান, নাট্যজন ম. হামিদ, চলচ্চিত্রকার মোরশেদুল ইসলাম, পথনাটক পরিষদের সভাপতি মান্নান হীরা, ছড়াকার আলম তালুকদার, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সাধারণ সম্পাদক হাসান আরিফ, সরকারী কর্ম-কমিশনের চেয়ারম্যান কবি মোহাম্মদ সাদিক, কবি আসাদ মান্নান, মহিলা পরিষদের পক্ষে নারীনেত্রী রেখা চৌধুরী প্রমুখ। শোকসভায় সভাপতিত্ব করেন জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন মাসকুর-এ সাত্তার কল্লোল। আনোয়ারা সৈয়দ হক বলেন, তার সম্পর্কে আমার খুব বেশি কিছু বলার নেই। আপনারা অনেকেই আমার চাইতেও ভাল জানেন। তার সঙ্গে আপনারা আন্দোলনে ছিলেন, রাজপথে ছিলেন। যেটা আমি ছিলাম না। আমি নিজের কাজ নিয়ে, নিজের লেখা নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম। অন্যদিকে সেও বিভোর ছিল আপন সৃজনের ভুবনে। তিনি স্বয়ংসম্পন্ন মানুষ ছিলেন। তিনি খুব একাকী মানুষ ছিলেন। তিনি সব সময় নিজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন। সেজন্য তাকে অনেক সময় দূরের মানুষ মনে হতো। কিন্তু তিনি ঠিকই পরিবার ও স্বজনের প্রতি খেয়াল রাখতেন। আমার ভেতরে অনেক অপরাধবোধের জন্ম দিয়ে চলে গেছেন। মানুষটিকে ভাল করে বুঝলাম না, ভাল করে সময় কাটালাম না। দেশের মানুষের মনেই তিনি বেঁচে থাকবেন। পিতার স্মৃতিচারণে দ্বিতীয়-সৈয়দ হক বলেন, বাবার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল দেশের মানুষ ও সংস্কৃতি। দেশের নাগরিকরাই তার কাছে প্রধান বিষয়। সারাজীবন মানুষের জন্য কাজ করেছেন। তার মৃত্যুর পর শহীদ মিনারে সেই মানুষদের ঢল দেখে আমরা কৃতজ্ঞ। আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদের সাধারণ সম্পাদক আহকামউল্লাহ পাঠ করেন ‘আমার পরিচয়’ কবিতাটি। ভাস্বা বন্দ্যোপাধ্যায় পাঠ করেন ‘নুরলদীনের সারাজীবন’ নাটকের অংশবিশেষ। মামুন জাহিদ খান ‘অনেক সাধের ময়না আমার’ সৈয়দ শামসুল হকের লেখা এ গানটি গেয়ে শোনান। ফকির আলমগীর ও তার দল ঋষিজের শিল্পীরা সৈয়দ হকের লেখা ‘ভয় নেই কোন ভয় জয় সাম্যের জয়’ গণসঙ্গীত পরিবেশন করেন। সৈয়দ হক স্মরণে জাতীয় কবিতা পরিষদের সভাপতি কবি মুহাম্মদ সামাদ ‘তোমার প্রেমের আলো’ স্বরচিত কবিতাটি পাঠ করেন। ‘আমাকে আপনারা ক্ষমা করবেন’ শীর্ষক সৈয়দ হককে উৎসর্গীকৃত স্বরচিত কবিতা পাঠ করেন কবিতা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক তারিক সুজাত। আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, কিছু মানুষ থাকে তারা যে বয়সেই প্রয়াত হন মনে হয় এটা বুঝি অকাল প্রয়াণ। সৈয়দ শামসুল হক তেমনই একজন। তিনি ছিলেন জাতির পথপ্রদর্শক। তার প্রয়োজনীয়তা কখনই ফুরাবার নয়। তিনি না থাকলেও সৃষ্টির সম্ভারে রয়েছেন আমাদের মাঝে। তার লেখা পাঠের মধ্য দিয়ে তার লেখার প্রেরণায় তরুণ প্রজন্মের সামনে এগিয়ে যাওয়াই হবে তাকে সম্মান জানানো। এটিএম শামসুজ্জামান বলেন, দীর্ঘদিন তার সঙ্গে আড্ডা দিয়েছি। তিনি চিরঞ্জীব ব্যক্তিত্ব। আমাদের অস্তিত্বে মিশে রয়েছেন। পরে তিনি সৈয়দ শামসুল হক স্মরণে স্বরচিত একটি কবিতা পাঠ করেন। প্রবীণের শোকগ্রস্ত কণ্ঠে উচ্চারিত হয়- নিষিদ্ধ লোবান এখন বাতাসে বাতাসে সুগন্ধি ছড়াবে ...। নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বলেন, সৈয়দ শামসুল হককে নিয়ে শোক নয়, তাকে নিয়ে উদযাপন করা উচিত। যখন দেশে জঙ্গীবাদের উত্থান ঘটছে তখন তিনি জাতিকে ইতিহাস-ঐতিহ্য ও শৌর্যের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। লিখেছেন ‘আমার পরিচয়’ এর মতো কবিতা। এক কারণেই শোকসভা নয় বরং উদ্যাপন করা উচিত এই কবির জীবনকে। আবেদ খান বলেন, সৈয়দ শামসুল হক তার জীবনকালে কালের সকল ধারাকে তার লেখায় স্থান দিয়েছেন। বাংলাদেশ, বাঙালী জাতির ইতিহাস, তার উৎসকে সমকালীন সাহিত্যে তুলে এনেছেন। মানুষের চিন্তার জগতকে প্রসারিত করে এমন স্থানে পৌঁছে গেছেন, যাকে প্রতিনিয়ত স্মরণ করতে হবে। তিনি প্রয়াত হননি। তার মৃত্যু জীবনের একটি পর্যায়ে এসে লীন হয়েছে মাত্র। কবি মুহম্মদ নুরুল হুদা বলেন, হক ভাই চির জীবিত। গত পঞ্চাশ বছরের বেশি সময় ধরে তার চেয়ে সৃষ্টিশীল কোন মানুষ দেখিনি। পরিপূর্ণ মানুষ ছিলেন, সৃষ্টিশীল ছিলেন, নান্দনিকতার পক্ষে ছিলেন। এমন মানুষকে বারবার চাই। তার মঙ্গল চেতনা সবার মাঝে ছড়িয়ে দিতে পারলে সঠিক শ্রদ্ধা জানানো হবে। আতাউর রহমান বলেন, রবীন্দ্রোত্তর সাহিত্যে যে হাতেগোনা কয়েকজন রয়েছেন তিনি তাদের অন্যতম। চার শ’ বছর হয়েছে শেক্সপিয়ার বেঁচে রয়েছেন। সৈয়দ হকের সৃজনের মৃত্যু হবে না। তিনি বেঁচে রইবেন আমাদের প্রেরণা হয়ে। মোরশেদুল ইসলাম বলেন, প্রথম জীবনে চলচ্চিত্রকার হওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন। তিনি অসামান্য কিছু চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য লিখেছেন। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের উন্মেষকালের তিনি প্রথমসারির একজন। কামরুল হাসান খান বলেন, সৈয়দ শামসুল হকের অবস্থান পূরণ হওয়ার নয়। বাংলাদেশের জাতিগত ঐক্য প্রতিষ্ঠায়, যে কোন আন্দোলনে তিনি সবসময় পথপ্রদর্শকের ভূমিকা পালন করেছেন। রেখা চৌধুরী বলেন, যতদিন বাংলাদেশ থাকবে ততদিন তার লেখা আলোর মতো করে জ্বলবে আমাদের আনন্দে-সঙ্কটে এবং সুখ-দুঃখে। গোলাম কুদ্দুছ বলেন, সৈয়দ শামসুল হক সাংস্কৃতিক কর্মীদের আত্মার আত্মীয় ছিলেন। তিনি আমাদের নিরন্তর প্রেরণার উৎস ছিলেন, সব সময় তাই থাকবেন। আজ সৈয়দ শামসুল হকের কুলখানি ॥ আজ রবিবার সৈয়দ হকের বাসভবনে কুলখানি অনুষ্ঠিত হবে। বাড়ি-৮, সড়ক-৬ এর বাসভবনে বিকেল সাড়ে পাঁচটায় কুলখানির আয়োজন করা হয়েছে। পরিবারের পক্ষ থেকে কবির শুভাকাক্সক্ষীদের কুলখানিতে অংশ নেয়ার অনুরোধ জানানো হয়েছে। সপ্তাহব্যাপী সৈয়দ হক স্মরণ অনুষ্ঠান ॥ আজ রবিবার থেকে সপ্তাহব্যাপী সৈয়দ হক স্মরণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদ। টিএসসির সবুজ চত্বরে বিকেল পাঁচটায় আয়োজনের উদ্বোধন করবেন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। এছাড়া ৬ অক্টোবর ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের লাইব্রেরী চত্বরে জাতীয় কবিতা পরিষদের আয়োজনে বিকেল পাঁচটায় স্মরণ সভার আয়োজন করা হয়েছে। ৭ অক্টোবর বাংলা একাডেমি ও জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশক সমিতি যৌথভাবে সৈয়দ শামসুল হককে নিবেদিত স্মরণ সভার আয়োজন করেছে। ওই দিন বিকেল ৪টায় বাংলা একাডেমির আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ মিলনায়তনে বিকেল চারটায় এ স্মরণসভা অনুষ্ঠিত হবে। ৯ অক্টোবর বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের আয়োজনে জাতীয় জাদুঘরে বিকেল সাড়ে পাঁচটায় সৈয়দ হক স্মরণ সভার আয়োজন করা হয়েছে।
×