ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

চট্টগ্রাম বন্দরে কন্টেনার জট স্বাভাবিক হতে তিন সপ্তাহ লাগবে

প্রাইম মুভার ধর্মঘটে নজিরবিহীন ক্ষতি আমদানি-রফতানিতে

প্রকাশিত: ০৫:৫০, ২ অক্টোবর ২০১৬

প্রাইম মুভার ধর্মঘটে নজিরবিহীন ক্ষতি আমদানি-রফতানিতে

মোয়াজ্জেমুল হক, চট্টগ্রাম অফিস ॥ হরতাল অবরোধ ধর্মঘট হলেই দেশের সব সেক্টর ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির কবলে পড়ে দেশের অর্থনীতির হৃৎপি- হিসেবে চিহ্নিত চট্টগ্রাম বন্দর। সর্বশেষ সাড়ে চারদিনের টানা ধর্মঘটের জিম্মিদশায় পড়ে এ বন্দরে কন্টেনার জট, আমদানি রফতানি কার্যক্রমে ক্ষতি হয়েছে নজিরবিহীন। ধর্মঘট শুরু হওয়ার পর থেকে প্রতিদিন রফতানির পণ্য বোঝাই কন্টেনার না পেয়ে খালি গেছে জাহাজ। শুক্রবার অর্ধদিনে প্রায় আড়াই হাজার রফতানির পণ্য বোঝাই কন্টেনার ছাড়া বন্দর ত্যাগ করেছে তিনটি বিদেশী জাহাজ। ছোট বড় বিভিন্ন আন্দোলনে এমনকি পান থেকে চুন খসলেই চট্টগ্রাম বন্দর অচল করে দেয়ার অতীতের রেওয়াজে বহুলাংশে পরিবর্তন এসেছে। কিন্তু গত সপ্তাহে চট্টগ্রাম প্রাইম মুভার ট্রেইলর মালিক-শ্রমিক ঐক্য পরিষদ শুক্রবার পর্যন্ত টানা সাড়ে চারদিন ধর্মঘট করায় এ বন্দরে ভয়াবহ অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়। আমদানি ও রফতানির পণ্য বোঝাই কন্টেনার পরিবহন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় প্রায় তিন হাজার কোটি টাকার রফতানি অর্ডার বাতিল হয়েছে বলে দাবি করেছেন বিজিএমইএ কর্তৃপক্ষ। বন্দর কর্তৃপক্ষ দাবি করেছে, বন্দরের কন্টেনার হ্যান্ডলিং কার্যক্রমের স্বাভাবিক ধারাবাহিকতা পিছিয়ে গেছে ন্যূনতম তিনসপ্তাহ। শিপিং এজেন্ট সূত্রগুলো বলেছে, জাহাজ অলস বসে থাকার কারণে তাদের ডেমারেজ গুনতে হবে বিপুল পরিমাণ বিদেশী মুদ্রা। অপরদিকে, আমদানিকারকরা বলেছে, সময়মত পণ্যের খালাস না পাওয়ায় তারাও ক্ষতির মুখে পড়েছে। এছাড়া পরিবহন খাত, শ্রমিক শ্রেণীসহ সংশ্লিষ্ট সবক’টি সেক্টরে আর্থিক ক্ষতি ব্যাপক। গত শুক্রবার দুপুর একটা থেকে এ ধর্মঘট স্থগিত হয়েছে। দুপুর একটা থেকে চট্টগ্রাম বন্দরে পুনরায় কর্মচাঞ্চল্য ফিরে এসেছে। কিন্তু ধর্মঘট স্থগিত হয়েছে আগামী ৪ অক্টোবর পর্যন্ত। ওইদিন ঢাকায় আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠকে ধর্মঘটীদের দাবি দাওয়া নিয়ে আলোচনা হবে এবং উদ্ভূত পরিস্থিতি অবসান হবে বলে আশা করা হচ্ছে। গত সোমবার থেকে এ ধর্মঘট শুরু হয়। শুক্রবার দুপুরে সিএমপি কমিশনারের উদ্যোগে আয়োজিত সংশ্লিষ্ট সকল কর্তৃপক্ষের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে অনুষ্ঠিত বৈঠকে সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের পক্ষ থেকে আশ্বাস পাওয়ার পর চলমান ধর্মঘট স্থগিত ঘোষণা করা হয় আগামী ৪ অক্টোবর পর্যন্ত। কিন্তু ইতোমধ্যে কন্টেনার জট হয়েছে স্মরণকালের রেকর্ড। এর পাশাপাশি এ বন্দরের প্রতি আন্তর্জাতিক রুটে চলাচলরত জাহাজ মালিকদের যে নেতিবাচক মনোভাব সৃষ্টি হয়েছে তার অবসান হতেও সময় নেবে। যে কারণে ধর্মঘট ॥ চট্টগ্রাম-ঢাকা মহাসড়কে দাউদকান্দি ও মেঘনা সেতুর সামনে স্থাপিত ওজন স্কেল (ওয়িং স্কেল) নিয়ে অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। এ অভিযোগ নিয়েই চট্টগ্রাম প্রাইম মুভার ট্রেইলার মালিক-শ্রমিক ঐক্য পরিষদ গত সোমবার থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য ধর্মঘট আহ্বান করে। ধর্মঘট শুরু হওয়ার পর গত ২৯ সেপ্টেম্বর সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষকে নিয়ে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে সার্কিট হাউসে বৈঠক হয়। বৈঠকে উদ্ভূত সমস্যা নিয়ে নবনিযুক্ত জেলা প্রশাসক অবহিত হন এবং তা সরকারের উর্ধতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে দেন। ধর্মঘট প্রত্যাহারে তাঁর অনুরোধ ব্যর্থ হয়। এরপরদিন অর্থাৎ ৩০ সেপ্টেম্বর সিএমপি কমিশনার ইকবাল বাহার উদ্যোগ নিয়ে আবার বৈঠক আহ্বান করেন। দীর্ঘ আড়াইঘণ্টা আলোচনা হয়। আলোচনার মাঝপথে সেতুমন্ত্রী দাবি পূরণের আশ্বাস প্রদান করলে ধর্মঘটীরা আগামী ৪ অক্টোবর পর্যন্ত ধর্মঘট স্থগিত ঘোষণা করে। ফলে শুক্রবার দুপুর একটা থেকে প্রাইম মুভারযোগে আমদানি ও রফতানি পণ্য বোঝাই কন্টেনার বহন শুরু হয়ে বন্দরের কর্মচঞ্চলতার স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরে আসে। অপরদিকে, টানা সাড়ে চারদিনের ধর্মঘটে এ বন্দরের সকল ইয়ার্ড ও বন্দরের বাইরে ১৬টি বেসরকারী কন্টেনার টার্মিনালের (আইসিডি) সর্বত্র কন্টেনার জট সৃষ্টি হয়। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছে যায় যে, আর দুয়েকদিন এ ধর্মঘট চললে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ কন্টেনার বোঝাই জাহাজ বার্থিং না দেয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। বন্দর সূত্র জানায়, বিগত ঈদ-উল-আযহার টানা ছুটির কারণে এমনিতেই এ বন্দরে কন্টেনার জট ছিল, যার অবসান এখনও হয়নি। এর পাশাপাশি কন্টেনার বোঝাই জাহাজের অবস্থানকালও বেড়ে যায়। বন্দর কর্তৃপক্ষ রাত দিন অপারেশনাল কর্মকা- চালিয়ে ধীরে ধীরে কন্টেনার জট সহনীয় পর্যায়ে আনার প্রক্রিয়া চালিয়ে আসছে। ঠিক এমন সময়ে প্রাইম মুভার মালিক-শ্রমিক ঐক্য পরিষদের ডাকা সাড়ে চার দিনের ধর্মঘট বন্দর কার্যক্রমে স্বাভাবিক পরিস্থিতি আনার প্রক্রিয়াকে নস্যাৎ করে দেয়। শুক্রবার থেকে প্রাইম মুভারযোগে কন্টেনার হ্যান্ডলিং শুরু হলেও পরিস্থিতি স্বাভাবিক পর্যায়ে আনতে কমপক্ষে তিনসপ্তাহ সময় নেবে বলে জানিয়েছেন বন্দরের সদস্য জাফর আলম। গত ২৬ সেপ্টেম্বর সেতু মন্ত্রণালয় থেকে এক সার্কুলার জারি করা হয় এই বলে যে, মহাসড়কে ৩৩ টন ওজনের বেশি কোন ধরনের পণ্য বোঝাই যানবাহন, প্রাইম মুভার, লং ট্রেইল কিছুই চলাচল করতে পারবে না। ফলে চট্টগ্রাম-ঢাকা মহাসড়কের ওজন স্কেল পয়েন্টে শুরু হয় এক ধরনের বাড়তি হয়রানি। এমনিতেই মহাসড়কে পুলিশসহ চাঁদাবাজদের চাঁদাবাজির অভিযোগ ব্যাপক। তার উপর রয়েছে ডাকাতি, ছিনতাই, পণ্য লোপাটসহ ক্ষতির নানা ঘটনা। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্ত হয় যানবাহন মালিক ও আমদানি-রফতানি পণ্যের মালিকরা। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চট্টগ্রাম বন্দর থেকে প্রতিদিন অফডকমুখী কন্টেনার বোঝাই প্রাইম মুভার চলে গড়ে ৫ হাজার। ঢাকামুখী চলাচল করে প্রায় ২ হাজার। এক্ষেত্রে একটি প্রাইম মুভার (লং ট্রেইলর) এর ওজন ১৫ টন। পণ্যের ওজন থাকে সর্বোচ্চ ৫ টন এবং ৪০ ফুট এলসিএল একটি কন্টেনারের ওজন থাকে ৫ টন। এভাবে প্রাইম মুভারগুলো চলাচল করে আসছিল। কিন্তু হঠাৎ করে গত ২৬ সেপ্টেম্বর সেতু মন্ত্রণালয় নতুন এক প্রজ্ঞাপনে ওজনসীমা সর্বোচ্চ ৩৩ টন করে দিয়ে সার্কুলার জারি করে। এ নিয়ে শুরু হয় টানাপোড়েন। মুভার মালিকরা বন্দর, সেতু মন্ত্রণালয়সহ সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরের দৃষ্টি আকর্ষণ করে ব্যর্থ হয়। শেষ পর্যন্ত তারা বাধ্য হয় ধর্মঘটে যেতে। এ অবস্থায় সেতুমন্ত্রী ওজনসীমা আপাতত ৪২ টনে উন্নীত করার আশ্বাস প্রদান করেন এবং ওজনের বেশি হলে কন্টেনারের মালিকরাই জরিমানা দেবে-এমন ঘোষণা দিলে মুভার মালিক-শ্রমিক ঐক্য পরিষদ ৪ অক্টোবর পর্যন্ত ধর্মঘট স্থগিতের ঘোষণা দেয়। শুক্রবার দুপুরের পর থেকে প্রাইম মুভারযোগে কন্টেনার পরিবহন শুরু হয়। এতে কন্টেনার জাহাজীকরণ, পণ্য বোঝাই কন্টেনার বন্দর থেকে প্রাইভেট আইসিডিতে নেয়া এবং অফডকিং শুরু হলে অচলাবস্থার আপাত অবসান ঘটে। এদিকে, সাড়ে চারদিনের ধর্মঘটে দেশের আমদানি-রফতানি কার্যক্রমে মারাত্মক প্রভাব পড়েছে। বিজিএমইএ’র প্রথম সহ-সভাপতি মঈনউদ্দিন আহমেদ মিন্টু শনিবার জনকণ্ঠকে জানান, তাদের প্রায় তিন হাজার কোটি টাকার অর্ডার বাতিল হয়ে গেছে। শিপিং লাইন্স পক্ষগুলো থেকে বলা হয়েছে, তাদের জাহাজপ্রতি মোটা অঙ্কের ডেমারেজ দিতে হবে। প্রাইম মুভার ট্রেইলার মালিক-শ্রমিক ঐক্য পরিষদের সদস্য সচিব আবু বকর সিদ্দিক জনকণ্ঠকে জানান, ওয়িং স্কেল পয়েন্টে নানামুখী হয়রানি ছাড়াও চাঁদাবাজি, ডাকাতি, ছিনতাইসহ আরও নানা ঘটনা রয়েছে। এসব ব্যাপারে আন্তঃমন্ত্রণালয়ের বৈঠকে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত না আসলে তারা পুনরায় ধর্মঘটে যেতে বাধ্য হবে। বিকডার সচিব রুহুল আমিন সিকদার জানিয়েছেন, প্রতিদিন বন্দর থেকে প্রাইম মুভারযোগে কন্টেনার বের হওয়া ও প্রবেশের সংখ্যা বাড়ছে। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে প্রাইম মুভারের চলাচল দৃশ্য প্রমাণ করে দেশের আমদানি রফতানি নিয়মিতভাবে বেড়ে চলেছে। এ অবস্থায় কর্তৃপক্ষ এসব ক্ষেত্রে সহনীয় পন্থা অবলম্বন না করলে বন্দর ব্যবহারকারী সংস্থাগুলো বাধ্য হয়ে কাজ বন্ধ করে দেয়। যা ধর্মঘটের চেয়ে কোন অংশে কম নয়। এক্ষেত্রে আনুষ্ঠানিক ধর্মঘট মানতে গেলে তা সময়সাপেক্ষ হয়ে দাঁড়ায়। গত সাড়ে চারদিনের ধর্মঘটে শেষদিন অর্থাৎ শুক্রবার যেসব দেশের রফতানির পণ্য যেতে পারেনি নিঃসন্দেহে তারাও ক্ষতিগ্রস্ত হলো। এ ধর্মঘটে চট্টগ্রাম বন্দরে ৩৬ হাজার কন্টেনার ধারণ ক্ষমতা উপচে পড়ে তা ৪৪ হাজারে উন্নীত হয়। শুক্রবার দুপুর থেকে ধর্মঘট স্থগিত হওয়ায় শনিবারের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, এ সংখ্যা ৪০ হাজার ৭শ’-এ নেমে আসে। এছাড়া বন্দরের জেটিতে কন্টেনারবাহী জাহাজের সংখ্যা ছিল ৯টি। পাশাপাশি বহির্নোঙ্গরে রয়েছে আরও ১২টি আমদানির পণ্য বোঝাই বিদেশী জাহাজ। উল্লেখ্য, বন্দর থেকে প্রতিদিন ৫ থেকে সাড়ে ৫ হাজার কন্টেনার হ্যান্ডলিং হয়ে থাকে। অপরদিকে বন্দর সদস্য জাফর আলম জানিয়েছেন, বন্দরের নিজস্ব কোন শ্রমিক নেই। অথচ, শ্রমিক ধর্মঘটে বন্দর অচল হয়ে যায়। বন্দর কোন পণ্য আমদানি যেমন করে না, রফতানিও করে না। মূলত বন্দর একটি ট্রানজিট পয়েন্ট। সরকারের রাজস্ব বিভাগ রাজস্ব নিয়ে আমদানি-রফতানি কার্যক্রম পরিচালনা করে এ বন্দর দিয়ে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে দেশের ৮০ শতাংশেরও বেশি আমদানি-রফতানি কার্যক্রম সম্পন্ন হয়ে থাকে। জাতীয় রাজস্ব কোষাগারে রাজস্ব বোর্ড মোটা অঙ্কের যে রাজস্ব যোগান দেয় তার বড় অংশটি যায় চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস হয়ে। সঙ্গত কারণে বন্দর ছোট বড় যে কোন অচলাবস্থার কবলে পড়লে ক্ষতিগ্রস্ত হয় জাতীয় রাজস্ব কোষাগার, যা দেশের অর্থনীতিকে আঘাত করে। গত সাড়ে চারদিন বন্দরে কন্টেনার পরিবহন বন্ধ থাকার কারণে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস মোটা অঙ্কের রাজস্ব আয় থেকে বঞ্চিত হয়েছে। যদিও এ আয় পরবর্তীতে পাওয়া যাবে, কিন্তু তা বছরের নির্দিষ্ট দিনগুলো থেকে পিছিয়ে যাবে। এ ঘটনা রাজস্ব আয়ের টার্গেটকেও ক্ষতিগ্রস্ত করে। সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ সূত্রগুলো বলছে, বন্দর কার্যক্রম, রাজস্ব আদায়ের পয়েন্টগুলো কোন অবস্থাতেই ক্ষতিগ্রস্ত না হয় এমন সিদ্ধান্ত নিয়ে সকল সংস্থা সজাগ হলে অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিকর প্রভাব যেমন ফেলবে না, তেমনি জাতীয় কোষাগারে রাজস্ব যোগান প্রক্রিয়াও ব্যাহত হবে না।
×