ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বাংলাদেশ ১৪১ রানে জয়ী

আফগানদের হারিয়ে সিরিজ বাংলাদেশের ॥ শততমে উপহার

প্রকাশিত: ০৫:৪৭, ২ অক্টোবর ২০১৬

আফগানদের হারিয়ে সিরিজ বাংলাদেশের ॥ শততমে উপহার

মিথুন আশরাফ ॥ বাংলাদেশ ক্রিকেটের জন্য মাশরাফি যে কতবড় সম্পদ, মানুষের আবেগ যে মাশরাফির প্রতি কতটা, ভালবাসা যে আকাশচুম্বি; তার এক ঝলক মিলল। শনিবার আফগানিস্তানের বিপক্ষে ১৪১ রানে জিতে বাংলাদেশ। তামিম ইকবালের শতকে জেতা ম্যাচটিতে যখন আফগানরা হারের দ্বারপ্রান্তে, এমন সময়ে এক দর্শক খেলা দেখতে ব্যস্ত থাকা নিরাপত্তা বলয় ভেদ করে মাঠে ঢুকে যান। দৌড়ে গিয়ে মাশরাফিকে জড়িয়ে ধরেন। ক্রিকেটের প্রতি আবেগ, মাশরাফির প্রতি ভালবাসার বহির্প্রকাশই ঘটে। তার নেতৃত্বেই যে আফগানিস্তানকে সিরিজে হারিয়ে দিল বাংলাদেশ। তবে আফগানদের বিপক্ষে নিশ্চিত জয় মিলতে যাচ্ছে- এমন বোঝা হয়ে যাওয়ার পর দর্শকের স্টেডিয়ামে ঢুকে যাওয়ার বিষয়টিই সবার ভেতর বেশি আলোচনার খোরাক যুগিয়েছে। সেই আলোচনার সঙ্গে বাংলাদেশ যে সিরিজ জিতে হাঁফছেড়েই বাঁচল, সেটিও আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল। অবশেষে স্বস্তি মিলল। সিরিজ হাতছাড়া হতে হতে বেঁচে গেল। সেই সঙ্গে আফগানদের তৃতীয় ওয়ানডেতে হারাতেই শততম ওয়ানডে জয়টিও হয়ে গেল। প্রথম ওয়ানডেতে ৭ রানে জিতে মাশরাফিবাহিনী। সিরিজে ১-০ ব্যবধানে এগিয়ে যায়। ওয়ানডেতে ৯৯তম জয়ও তুলে নেয়। এরপর যখন দ্বিতীয় ওয়ানডেতেই জিতে শততম জয় পাওয়ার অপেক্ষা, তখন ২ উইকেটে হেরে যায় বাংলাদেশ। প্রথমবারের মতো আফগানিস্তানের বিপক্ষে সিরিজে খেলে এক ম্যাচ হাতে রেখেই সিরিজ জিতে নেবে কীÑ উল্টো বিপাকে পড়ে যায়। সিরিজে ১-১ সমতা আসার সঙ্গে শততম জয় পাওয়ার অপেক্ষাও বাড়ে। সেই অপেক্ষা শনিবার সিরিজের শেষ ওয়ানডেতেই শেষ করে দেন মাশরাফি, সাকিব, তামিম, মাহমুদুল্লাহরা। ম্যাচে টস জিতে বাংলাদেশ। আগে ব্যাট করার সিদ্ধান্ত নেয়। এ সিদ্ধান্তে টানা তিনটি ম্যাচেই আগে ব্যাট করা হয়ে যায় বাংলাদেশের। তামিম ইকবাল দুর্দান্ত ব্যাটিং করেন। ১১৮ বলে ১১ চার ও ২ ছক্কায় ১১৮ রান করেন। তার এ ইনিংসের সঙ্গে সাব্বির রহমান রুম্মনের ৬৫ ও মাহমুদুল্লাহ রিয়াদের অপরাজিত ৩২ রানে ৮ উইকেট হারিয়ে ৫০ ওভারে ২৭৯ রান করে বাংলাদেশ। মোহাম্মদ নবী, মিরওয়াইস আশরাফ ও রশিদ খান ২টি করে উইকেট নেন। জবাবে ৩৩.৫ ওভারে ১৩৮ রান করতেই গুটিয়ে যায় আফগানিস্তান। দ্বিতীয় ওয়ানডে শেষে বাংলাদেশ অধিনায়ক মাশরাফি বলেছিলেন, ‘পরের ম্যাচে (তৃতীয় ওয়ানডেতে) আমরা আরও কঠিন রূপে ফিরব।’ সেই কঠিন রূপই দেখিয়ে দিল বাংলাদেশ। ১০ মাস পর ওয়ানডে সিরিজ খেলতে নেমে প্রথম দুই ওয়ানডেতে বাংলাদেশ ক্রিকেটারদের যেন খুঁজেই পাওয়া যায়নি। ব্যাটিংয়ে সেই ধার নেই। বোলিংয়ে আফগান ব্যাটসম্যানদের বিপাকে ফেলা গেলেও স্কোরবোর্ডে রান কম হওয়াতে প্রথম ওয়ানডেতে কোনভাবে জেতা গেছে। কিন্তু দ্বিতীয় ওয়ানডেতে হারই হয়েছে নিয়তি। লজ্জা মিলেছে। সেই লজ্জার পর তৃতীয় ওয়ানডে হারলে ‘মান-সম্মান’ই যেত। কিন্তু তা আর হয়নি। মান বাঁচিয়েছে বাংলাদেশ। সিরিজ জেতার স্বস্তিও মিলেছে। মোশাররফ হোসেন রুবেল এ মুহূর্তে বাংলাদেশ দলে খেলা সবচেয়ে বয়সী ক্রিকেটার। ৩৪ বছর ৩১৬ দিন হয়েছে। এ ‘বুড়ো’ যেন ‘ভেল্কি’ দেখিয়ে দিলেন। পেসার রুবেল হোসেনকে বাদ দিয়ে যে তাকে দলে নেয়া হয়েছে এবং তাইজুল ইসলামকে বাদ দিয়ে যে তাকে একাদশে খেলানো হয়েছে; তার প্রতিদানও দিলেন। সাড়ে আট বছর পর আবার ওয়ানডে খেলতে নেমেই ৩ উইকেট তুলে নেন। রহমত শাহ সবচেয়ে বেশি ৩৬ রান করতে পারেন। ৮৯ রানেই ৭ উইকেট হারান আফগানরা। এমন সময় বাংলাদেশের জয়ই নিশ্চিত ধরে নেয়া হয়। শুধু খেলা শেষ হওয়ার অপেক্ষা থাকে। তবে ৭ উইকেটে ১০২ রান যখন করে আফগানিস্তান, এক দর্শক স্টেডিয়ামে ঢুকে যান। সবাই অবাক হয়ে যান। ঢুকে মাশরাফিকে জড়িয়ে ধরেন। নিরাপত্তা কর্মীদের তখন হুঁশ হয় এবং দৌড়ে এসে দর্শককে মাঠের বাইরে নিয়ে যান। দর্শকের স্টেডিয়ামে ঢুকে যাওয়ার বিষয়টিকে অন্য সময় হলে ইতিবাচকভাবে দেখা হতো। কিন্তু সবার কাছে এ মুহূর্তে কাটা হয়েই বিঁধেছে ঘটনাটি। নিরাপত্তা শঙ্কার জন্য যখন ইংল্যান্ড ক্রিকেট দলের বাংলাদেশে আগমনই ঘটছিল না। সেই ইংল্যান্ড দল এখন ঢাকায়। টিভিতে নিশ্চয়ই তারা দর্শকের মাঠে ঢুকে যাওয়ার বিষয়টি লক্ষ্য করেছেন। সবার মধ্যে ভয় তৈরি হয়ে যায়, আবার না বিগড়ে যায় ইংল্যান্ড ক্রিকেট বোর্ড (ইসিবি)। তবে বিশ্বাসও থাকে। পুরো বিশ্বেই এমনটি ঘটে। খেলাধুলার প্রতি, খেলোয়াড়দের প্রতি ভালবাসা থেকে দর্শকরা প্রিয় খেলোয়াড়কে জড়িয়ে ধরতে মাঠে ঢুকে যান। কিন্তু বাংলাদেশে এমনটি ঘটে না। নিরাপত্তা রক্ষীরা এতটাই বেখেয়ালি ছিলেন যে স্টেডিয়ামে দর্শক প্রবেশ করে ফেলে! এ বিষয় নিয়ে এখন কিছু না ঘটলেই হয়। ম্যাচ শেষে অবশ্য সবাই তখন আনন্দ করতে ব্যস্ত। এ ঘটনা তখন আর কারও মাথাতেও থাকেনি। আফগান ইনিংস শুরুর আগে বাংলাদেশ ইনিংসে সৌম্য সরকার ২৩ রানে আউট হওয়ার পর যে তামিম-সাব্বির এগিয়ে চলতে শুরু করেন, ১৬৩ রানে গিয়ে এ জুটির অবসান ঘটে। দুইজন মিলে দ্বিতীয় উইকেট জুটিতে ১৪০ রান স্কোরবোর্ডে যোগ করেন। অবশ্য এ জুটি হতোই না। যদি দলের ১১ রানের সময় ১ রান করা তামিমের ক্যাচটি ধরতে পারতেন অধিনায়ক আসগার স্ট্যানিকজাই। সেই তামিমই কিনা শেষপর্যন্ত দলকে বড় সংগ্রহ এনে দেন। এদিন বাংলাদেশ দলের টিম ম্যানেজমেন্ট নতুন ‘ছকে’ এগিয়ে চলে। রিয়াদকে তিন নম্বরে ব্যাট করতে না পাঠিয়ে সাব্বিরকে পাঠায়। আর তাতেই আসলে বাজিমাত করে বাংলাদেশ। কোনভাবেই ওয়ানডেতে বেশি ওভার খেলার সুযোগ পাচ্ছিলেন না সাব্বির। ধুন্ধুমার ব্যাটিং করেন। মারমুখী ব্যাটিংয়ে টি২০তে তিন নম্বরে নিয়মিত ব্যাট করে সফল এই ব্যাটসম্যান। কিন্তু ওয়ানডেতে সেই সুযোগটি মিলছিল না। অবশেষে সেই সুযোগ পেলেন। আর তা পেয়েই ঝলক দেখালেন। ৬৫ রানের ইনিংস যে খেললেন, সেটি আবার ওয়ানডে ক্যারিয়ারে তার সর্বোচ্চ রান হয়ে থাকল। ১৬৩ রানে সাব্বির আউট হওয়ার পরও তামিম, সাকিব, মুশফিক, মাহমুদুল্লাহ, মোসাদ্দেক ব্যাটিংয়ে থাকেন। বাংলাদেশতো তিন শ’ রানেরও বেশি করে ফেলবে। সেই ধারণাই সবার মধ্যে জন্মে যায়। সাব্বির আউটের পর সাকিবকে নিয়ে সেরকমভাবে এগিয়েও যান তামিম। অর্ধশতকতো আগেই হয়। ক্যারিয়ারের সপ্তম শতক করে বাংলাদেশ ব্যাটসম্যানদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি শতক করার রেকর্ডও গড়ে ফেলেন। তবে আর কিছুদূর এগিয়ে যেতেই আউট হয়ে যান তামিম। ২১২ রানে ১১৮ রান করে মোহাম্মদ নবীর বলে আউট হন। যে নবীর বলেই ১ রানে ‘নতুন জীবন’ পান তামিম, সেই নবীর বলেই আউট হয়ে সাজঘরে ফেরেন। এরপরও তিন শ’ রান হওয়ার সুযোগ খুব ভালভাবেই থাকে। কিন্তু মুহূর্তেই যেন সেই আশা হতাশায় পরিণত হতে থাকে। আর ৩৩ রান যোগ হতেই সাকিব, মুশফিক, মোসাদ্দেক, মোশাররফ আউট হয়ে যান। স্কোরবোর্ডে বেশি রান যোগ করাও যেন ধোঁয়াশায় পড়ে যায়। শেষমুহূর্তে মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ অপরাজিত ৩২ রান না করলে ২৮০ রানের ধারেকাছেও যেতে পারত না বাংলাদেশ। শেষপর্যন্ত যে আফগানিস্তানের বিপক্ষে এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ ২৭৯ রান করে, তাতেই আসলে বাংলাদেশের জয় পাওয়া নিশ্চিত হয়ে যায়। শেষপর্যন্ত সেই জয় মিললও। প্রথম ওয়ানডেতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ে হারে আফগানিস্তান। দ্বিতীয় ওয়ানডেতে জিতেই যায়। তৃতীয় ওয়ানডেতে আসল রূপ মিলে আফগানিস্তানের। একেবারে নাকানিচুবানি খায়। এ ম্যাচটিতে আবার বাংলাদেশ পুরনো সাফল্যের রূপেই ফিরে। যে রূপে শুধু জয়ই লেখা। সেই জয়টি মিলেও যায়। তাতে করে শততম জয়ের সঙ্গে আফগানিস্তানের বিপক্ষে সিরিজ জয়ও হয়ে যায়। ২০১৪ সালের নবেম্বর থেকে টানা ষষ্ঠ সিরিজ জয়ও হয়ে যায়। ২০১৪ সালের নবেম্বরে জিম্বাবুইয়ে, এরপর ২০১৫ সালে পাকিস্তান, ভারত, দক্ষিণ আফ্রিকা, আবার জিম্বাবুইয়েকে সিরিজে হারায় বাংলাদেশ। টানা পাঁচটি সিরিজ জয়ের রেকর্ড আগেই গড়ে বাংলাদেশ। এবার আফগানদের সিরিজে হারিয়ে টানা ষষ্ঠ সিরিজ জয়ও হয়ে যায়। সেই সিরিজ জয়ের নায়ক বাংলাদেশ ওপেনার তামিম ইকবাল। প্রথম ওয়ানডেতে ৮০ রান করার পর দ্বিতীয় ওয়ানডেতে ২০ রান করলেও তৃতীয় ওয়ানডেতে শতকই করে ফেলেন। সিরিজের একমাত্র সেঞ্চুরিয়ান তামিমের ব্যাটে ভর দিয়ে বাংলাদেশও তৃতীয় ম্যাচটি অনায়াসে জিতে। সিরিজও ২-১ ব্যবধানে জিতে নেয়।
×