ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

দিনাজপুরে স্তর দ্রুত নেমে যাচ্ছে

১১ গ্রামে সুপেয় পানি সঙ্কট

প্রকাশিত: ০৪:২৮, ২ অক্টোবর ২০১৬

১১ গ্রামে সুপেয় পানি সঙ্কট

স্টাফ রিপোর্টার, দিনাজপুর ॥ প্রায় ২ মাস ধরে হাতে চর্মরোগে আক্রান্ত ৮ বছরের শিশু রিভা। তার বাবা ইদ্রিস আলী মেয়ের হাতে এই রোগ সারাতে ইতিমধ্যেই ৬-৭শ’ টাকা খরচ করেছেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত সে সুস্থ হতে পারেনি। তার বাবা জানিয়েছেন, বাড়িতে পানির সরবরাহ না থাকায় রিভা তার কয়েক সঙ্গীর সঙ্গে বাড়ির পার্শ্ববর্তী ডোবায় হাত ধুতে গিয়েছিল। আর সেখান থেকেই এই রোগের আক্রমণ হয়েছে। রিভা ফুলবাড়ী উপজেলার শিবনগর ইউনিয়নের ইউসুফপুর গ্রামের ইদ্রিস আলীর মেয়ে। সে ওই এলাকার রজনীগন্ধা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দ্বিতীয় শ্রেণীর ছাত্রী। শুধু রিভাই নয়, ওই এলাকার কয়েকজন এই চর্মরোগে আক্রান্ত। বিশেষ করে ওই এলাকার যারা কৃষক, মাঠের ক্ষেতে কাজ করার ফলেই তাদের এই রোগের আক্রমণ হয়েছে। তবে চর্মরোগ নয়, ওই এলাকার মূল সমস্যা পানি সঙ্কট। যে পানি বাড়িতে না থাকার ফলে রিভাকে যেতে হয়েছিল পার্শ্ববর্তী ডোবায়। রিভা যে গ্রামে বাস করে সেই ইউসুফপুর গ্রামটি বড়পুকুরিয়া তাপ বিদ্যুত কেন্দ্রের মাত্র ৩শ’ থেকে ৪শ’ মিটারের মধ্যে। স্থানীয়দের তথ্য মতে, বড়পুকুরিয়া তাপ বিদ্যুত কেন্দ্র সচল রাখতে কেন্দ্রে ১৪টি গভীর পাম্প স্থাপন করা হয়েছে। যেগুলো দিয়ে অনবরত পানি উত্তোলনের ফলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে গেছে। যাতে করে ওই এলাকার নলকূপ দিয়ে পানি উঠছে না। ফলে বিশুদ্ধ পানির জন্য হাহাকার পড়েছে ওই এলাকায়। এই তীব্র পানির সঙ্কট শুধু ইউসুফপুর গ্রামেই নয়, কেন্দ্রের পার্শ্ববর্তী ফুলবাড়ী ও পার্বতীপুর উপজেলার মোট ১১টি গ্রামে দেখা দিয়েছে এই পানি সঙ্কট। গ্রামগুলো হচ্ছে- ফুলবাড়ী উপজেলার শিবনগর ইউনিয়নের রামভদ্রপুর, মধ্যরামভদ্রপুর, মধ্যদুর্গাপুর ইউসুফপুরের ২টি ও দুধিপুুকুরের ৩টি গ্রাম এবং পার্বতীপুর উপজেলার হামিদপুর ইউনিয়নের শেরপুর, উত্তর শেরপুর ও মধ্যমপাড়া গ্রাম। স্থানীয়দের তথ্যমতে, ১১টি গ্রামে প্রায় ১০ হাজার মানুষের বসবাস। পাশাপাশি তাপ বিদ্যুত কেন্দ্রে যে পানি ব্যবহার করা হয় সেসব পানিই ময়লা ও দূষণযুক্ত হয়ে ড্রেনের মাধ্যমে চলে আসে পার্শ্ববর্তী কৃষি জমি ও নদীতে। আর এসব পানি শরীরের সংস্পর্শে চলে আসার সঙ্গে সঙ্গে দেখা দেয় চুলকানিসহ বিভিন্ন ধরনের চর্মরোগের। বড়পুকুরিয়া তাপ বিদ্যুত কেন্দ্রের একটি সূত্র জানায়, ২০০৬ সালে দিনাজপুরের পার্বতীপুরে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুত কেন্দ্র চালু হয়। এই কেন্দ্রের উৎপাদন সচল রাখতে মোট ১৪টি অতি গভীর নলকূপের (ডিপ) মাধ্যমে পানি সরবরাহ করা হয়। এই পানি বিদ্যুত কেন্দ্রে সরবরাহ করে সেখানে পানিকে বাষ্পে পরিণত করে বিদ্যুত উৎপাদন করা হয়। অনবরত ভূগর্ভস্থ থেকে পানি উত্তোলনের ফলে কেন্দ্রের পার্শ্ববর্তী এসব এলাকায় পানির সঙ্কট দেখা দেয়। ২০০৯ সাল থেকে পানির সঙ্কট তীব্র আকার ধারণ করলে সেই সময়ে এলাকাবাসী আন্দোলনে নামে। ফলে পল্লী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (আরডিএ) তদন্ত করে গভীর নলকূপ বসিয়ে পাইপ লাইনের মাধ্যমে পানি সঙ্কটে থাকা এলাকাগুলোতে পানি সরবরাহ শুরু করে। শনিবার সকালে সরেজমিনে ইউসুফপুর গ্রামে গেলে সাংবাদিকদের দেখে সমস্যার কথা জানাতে গ্রামের অনেকেই এগিয়ে আসেন। সেখানে কথা হয় ফজলুর রহমানের সঙ্গে। তিনি নিজেও বড়পুকুরিয়া তাপ বিদ্যুত কেন্দ্রের একজন কর্মচারী। তিনি জানান, গত প্রায় ৫ বছর ধরে তাদের গ্রামে পানির সঙ্কট দেখা দিয়েছে। অনেকেই এসেছেন, তাদের সমস্যার কথা শুনেছেন। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। সর্বশেষ সমাধান হিসেবে যা হয়েছে তাতে সন্তুষ্ট নন তারা। কারণ এখন তাদের পানি কিনে খেতে হয়। তাপ বিদ্যুত কেন্দ্রের অর্থায়নে ও বগুড়া পল্লী উন্নয়ন একাডেমির মাধ্যমে ওই এলাকায় পানি সরবরাহ করা হচ্ছে। এতে করে জনপ্রতি মাসে ১২ টাকা দিতে হয় বগুড়া পল্লী উন্নয়ন একাডেমিকে। এলাকায় বিশুদ্ধ পানির এমন সঙ্কট হবে এমনটি কখনও কল্পনাও করতে পারেননি সত্তোরর্ধ বয়সী ইউসুফপুর এলাকার মৃত সফিউদ্দিনের স্ত্রী আসিয়া খাতুন। তিনি জানান, আগে কখনও এমনটি ছিল না। কিন্তু গত প্রায় ৫-৬ বছর ধরে তাদের এ সমস্যার মধ্যে পড়তে হচ্ছে। এখন জনপ্রতি ১২ টাকা মাস হারে পানি কিনে খেতে হচ্ছে তাদের। দাম দিয়ে পানি কিনলেও পর্যাপ্ত পানি পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ করেন তিনি। তিনি জানান, তাপ বিদ্যুত কেন্দ্র এলাকার লোক হলেও ওই এলাকায় রয়েছে তীব্র লোডশেডিং। আর এই লোডশেডিংয়ের সময়ে পানি পাওয়া যায় না। আবার পাম্প নষ্ট, পাইপ নষ্টসহ বিভিন্ন অজুহাতে কর্তৃপক্ষ তাদের দিনের অর্ধেক সময়ই পানি সরবরাহ করেন না। ফুলবাড়ী উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডাঃ নুরুল ইসলাম জানান, দূষিত পানির কারণে চর্মরোগের বিষয়টি তিনি অবগত, তবে এটি এখনও তেমন নয়। তবে মাঠ পর্যায়ে তাদের কর্মকর্তারা কাজ করছেন। দিনাজপুরের সিভিল সার্জন ডাঃ অমলেন্দু বিশ্বাস জানান, দূষিত পানির ফলে চর্মরোগের বিষয়টি তিনি জানেন না। সংশ্লিষ্ট উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তাও তাকে কিছুই অবগত করেননি। তবে যদি এটি হয়ে থাকে তাহলে অবশ্যই ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। তিনি নিজে বিষয়টি তদন্ত করে দেখবেন বলে জানান। ১৪টি গভীর পাম্পের মাধ্যমে পানি উত্তোলনের ফলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে গেছে বিষয়টি স্বীকার করেছেন বড়পুকুরিয়া তাপ বিদ্যুত কেন্দ্রের সিনিয়র সহকারী পরিচালক (নিরাপত্তা) হযরত আলী। তিনি জানান, পার্শ্ববর্তী যেসব গ্রামে পানির সঙ্কট দেখা দিয়েছে সেগুলোতে তাপ বিদ্যুত কেন্দ্রের অর্থায়নে বগুড়া পল্লী উন্নয়ন একাডেমির মাধ্যমে পানি সরবরাহ করা হচ্ছে। তিনি জানান, বিদ্যুত কেন্দ্র থেকে কয়লা ধোয়া যে পানি বের হয়, তার পরিবেশগত কোন সমস্যা নেই। বরং এই পানি যে জমিতে পড়ে তার ফসল উৎপাদন অনেকাংশে বৃদ্ধি পায়। তিনি জানান, এই এলাকায় বিদ্যুত কেন্দ্র স্থাপিত হওয়ার ফলে এসব এলাকার লোকজনের কর্মসংস্থান হয়েছে। এখানকার উৎপাদিত বিদ্যুত দেশের অনেকটাই চাহিদা পূরণ করছে। তবে এলাকার কতিপয় লোক বিদ্যুত কেন্দ্রের নামে মিথ্যা ষড়যন্ত্রমূলক কথা বলছেন বলে অভিযোগ করেন তিনি।
×