ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

একুশ শতক ॥ শেখ হাসিনা ডিজিটাল স্বর্ণকন্যা

প্রকাশিত: ০৩:৫০, ২ অক্টোবর ২০১৬

একুশ শতক ॥ শেখ হাসিনা ডিজিটাল স্বর্ণকন্যা

॥ দুই ॥ সত্তর সালের প্রেক্ষিতটি সবারই জানা এবং আমরা যারা তখন ছাত্রলীগের রাজনীতিতে যুক্ত ছিলাম এবং যাদের শিকড় গ্রামে ছিল তারা সবাই সত্তরের নির্বাচনের জন্য গ্রামে চলে যাই। আমার নিজের গ্রামে যাওয়াটা একেবারেই লড়াই করা ছিল। কারণ, আমার থানায় তখন আওয়ামী লীগ বলতে তেমন বড় কোন সংগঠন ছিল না। খালিয়াজুরী সদরে সিদ্দিকুর রহমান তালুকদার নামক একজন যুবক ছিলেন যিনি আওয়ামী লীগ করতেন। পুরো অঞ্চলটা হিন্দুপ্রধান এবং তাদের সঙ্গে সিপিবি ও ন্যাপের সম্পর্ক ছিল বেশি। আমাদের আসনে ৭০-এর নির্বাচনে ন্যাপের একজন প্রার্থীও ছিলেন। তিনি তাঁর কুঁড়েঘর প্রতীক নিয়ে বেশ দাপটের সঙ্গে আমাদের নৌকার বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন। তবে গণজোয়ারের টানে নির্বাচনে আমরা এমপি ও এমএনএ দুটিতেই জিতে যাই। খুব সঙ্গত কারণেই নির্বাচনের পরে গ্রামে আমার আর কোন কাজ ছিল না। আমি বাবাকে আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুক্ত করে ঢাকা চলে আসি। এরপর ’৭১ সালের মার্চ পর্যন্ত দেশের রাজনীতির কেন্দ্রে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা মুক্তিযুদ্ধের সকল প্রস্তুতি গ্রহণ করি। কিন্তু একাত্তরের ৭ মার্চের ভাষণের পর রাতের ট্রেনে আমি গ্রামের বাড়ি চলে যাই। আমার ওপর নির্দেশ ছিল সেদিনই বাড়ি যেতে হবে এবং সেখানে গিয়ে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে হবে। আমি সেখানে সংগ্রাম কমিটি গঠন করি এবং সেখানেই যুদ্ধ সংগঠিত করি। ’৭২ সালে ফিরে এসে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়াই বন্ধ করে দিই। ফলে তখন শেখ হাসিনার সঙ্গে যোগাযোগের আর কোন পথ খোলা থাকেনি। যা হোক, খুব সঙ্গত কারণেই ’৭০-৭১ সালে তো বটেই শেখ হাসিনা ’৮১ সালে বাংলাদেশে ফিরে এসে রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত আমার সঙ্গে আর কোন যোগাযোগ ছিল না। ’৭৫-এর পর কঠিনতম সময় পার করতে করতে এক সময় রাজনীতিতে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ায় শেখ হাসিনা যখন নতুন করে আওয়ামী লীগ গড়ে তুলেন তখনও তার সঙ্গে আর কোন যোগাযোগ হয়নি। আমি স্মরণ করতে পারি যে, শেখ হাসিনার সঙ্গে পরের দেখাটি হয় ১৯৮৩ সালে। সেই বছরের মার্চ মাসে আমি মাসিক নিপুণ পত্রিকা প্রকাশ করা শুরু করি। একটি সিনেমা পত্রিকাকে পারিবারিক সাময়িক পত্রিকায় রূপান্তর করার জন্য আমি তখন আপ্রাণ চেষ্টা করি। পত্রিকাটির প্রথম সংখ্যার প্রচ্ছদ গড়ে ওঠে বেগম খালেদা জিয়াকে ঘিরে। নিহত জিয়াউর রহমানের বিধবা পতœীকে নিয়ে তখনও কোন পত্রিকায় কোন ফিচার বা সাক্ষাতকার ছাপা হয়নি। নাসির আলী মামুন বেগম জিয়ার ছবি তুলেন এবং কবি অসীম সাহা তাকে কেন্দ্র করে প্রচ্ছদ কাহিনী তৈরি করেন। অসীম সাহা বেগম জিয়ার সাক্ষাতকারও নিয়েছিলেন। বিষয়টি কোনভাবেই রাজনৈতিক ছিল না। অসীমদা একেবারেই পারিবারিকভাবে বেগম জিয়াকে উপস্থাপন করেন। তার দুই পুত্রসহ ছবি ছাপি আমরা। নিপুণ-এর প্রথম সংখ্যাটি সুপারহিট হয়। হাজার হাজার কপি বিক্রি হওয়ার প্রেক্ষিতে আমরা সিদ্ধান্ত নিই যে, এর পরের সংখ্যাটি তথা এপ্রিল ৮৩ সংখ্যার প্রচ্ছদ কাহিনী করা হবে শেখ হাসিনাকে কেন্দ্র করে। শেখ হাসিনার জীবনের যাবতীয় তথ্য সংগ্রহ করা হলো। কিন্তু তার সাক্ষাতকার ছাড়া তো প্রচ্ছদ কাহিনী হবে না। জানা গেল, তিনি মহাখালীতে স্বামীর সঙ্গে বসবাস করেন। আমার ওপরই দায়িত্ব পড়ল সাক্ষাতকার নেয়ার। আমি তার মহাখালীর বাসায় গেলাম। তিনি খুব সহজেই চিনলেন আমাকে। বসে আলাপ করা শুরু করতেই আমি আমার পত্রিকার একটি কপি দিলাম এবং সেটিকে নিয়মিত প্রকাশ করব সেটি জানালাম। প্রসঙ্গত আমি তার একটি সাক্ষাতকারের কথা জানালাম। তিনি নিপুণ-এর নাম শুনেই রেগে গেলেন। ‘আপনি খুনী জিয়াউর রহমানের বৌটাকে কভার ছবি করেছেন, আর সেই পত্রিকাকে আমি সাক্ষাতকার দেব? আমি আত্মপক্ষ সমর্থন করে জানাতে চাইলাম যে পত্রিকাটি রাজনৈতিক নয় এবং খালেদার সাক্ষাতকারও রাজনৈতিক নয়। বস্তুত এটিও বলতে চাইলাম যে আমি আপনার রাজনৈতিক বক্তব্য নয়, আপনার ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও অন্যান্য বিষয় নিয়ে কথা বলতে চাই। আপনারা যারা রাজনীতি করেন তাদের ব্যক্তিগত জীবন মানুষ জানে না। আমরা সেই বিষয়গুলো উপস্থাপন করতে চাই। তিনি বললেন, আমি এই পত্রিকার জন্য কথা বলতে পারি না- আপনি উঠতে পারেন। বুঝতে পারলাম, তিনি ভীষণ রেগে গেছেন। আমি ওঠার ভঙ্গি করে বললাম, কথা না বলেন ভাল কথা, চা খাওয়াবেন না? আমার কথা শুনে স্বভাবজাতভাবে তিনি হেসে ফেললেন। বললেন বসেন। আমি চা বানিয়ে আনি। আমিও বসে গেলাম। তিনি নিজের হাতে চা বানালেন এবং দু’জনের হাতে কাপ নিয়ে আমরা ছোটখাটো কথা বলতে শুরু করলাম। অতীতের স্মৃতি, বাংলা বিভাগের কথা ছাড়াও আমাদের সহপাঠিনী রোকসানা, রোকেয়া, মমতাজ আপার কথা হলো। বিস্তারিত কথা হলো সহপাঠিনী রোকসানাকে নিয়ে। তিনি জানলেন ক্লাসের প্রথম হওয়া রোকসানা আর আমি সংসার পেতেছি। দু’জনের সন্তানদের নিয়েই কথা হলো। সঙ্গে সঙ্গে একটু রাজনীতি নিয়ে আলোচনা হলো। আমার আলাপের ধরন দেখেই তিনি বুঝলেন আমি সাক্ষাতকারটা নেবই। অনেকক্ষণ তার ব্যক্তিগত জীবন ও রাজনীতি নিয়ে আলাপ করে ছবি তুলে নিপুণ-এর ৮৩ সালের এপ্রিল সংখ্যার প্রচ্ছদ কাহিনী করলাম। সেই সংখ্যাটিও সুপার হিট হলো। বাংলা বিভাগের পর শেখ হাসিনার সঙ্গে সেটাই প্রথম সরাসরি সাক্ষাত। তারপর মাঝে মাঝে দেখা সাক্ষাত হতো। যদি আজ সেই সাক্ষাতকারটি তুলে ধরতে পারতাম তবে ছাইচাপা আগুনকে আমরা ৮৩ সালেই যে আবিষ্কার করেছি সেটি জানাতে পারতাম। তিনি যে বঙ্গবন্ধুর কন্যা, তিনি যে আমাদের প্রজন্মের অহঙ্কার সেটি তার প্রতিটি বাক্য থেকে উৎসারিত হয়েছে। এরপর আমি আওয়ামী লীগের রাজনীতিকে পর্যবেক্ষণ করেছি। সময়মতো তার রাজনীতির সহায়ক ভূমিকা পালন করেছি। তবে তখনও তার রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত হইনি। আমার জীবনটাও নানা খাতে প্রবাহিত হতে হতে ৮৭ সালে তথ্যপ্রযুক্তিতে এসে পৌঁছায়। সেই সময়েই শেখ হাসিনা একটি যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নেন। তিনি স্থির করেন যে, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে কম্পিউটারের যুগে প্রবেশ করাবেন। সেই মোতাবেক তিনি আমার প্রতিষ্ঠান থেকে একটি মেকিন্টোস কম্পিউটার ও একটি লেজার প্রিন্টার কেনার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। আমার দায়িত্ব পড়ে শেখ হাসিনাকে বাংলা টাইপিং শেখানোর। তিনি তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়ের কাছ থেকে কম্পিউটারের নানা বিষয় শিখতেন এবং আমি তাকে ইংরেজী কোন বোতামে কোন বাংলা অক্ষর বা কোন যুক্তাক্ষর কেমন করে বানাতে হবে সেটি শেখাতাম। তখন কোন কোন সময় তিনি নিজে টাইপ করে দলের প্রেস রিলিজ মিডিয়ায় পাঠাতেন। তখন তো দূরের কথা এরপরও বহু বছর বাংলাদেশের কোন রাজনীতিবিদ এমন করে কম্পিউটার ব্যবহার করা শুরু করেননি বা কম্পিউটারের সঙ্গে মিতালীও করেননি। তার একটি বাড়তি সুবিধা ছিল যে তার ঘরেই তথ্যপ্রযুক্তিবিদ আছে। তারা তাকে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ডিজিটাল রাজনীতিবিদ হিসেবে গড়ে উঠতে সহায়তা করেন। আমি অত্যন্ত নিশ্চিতভাবে এটি বলতে পারি যে তিনি একজন প্রযুক্তিমুখী মানুষ বলেই আজ বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুত গতিতে রূপান্তরের পথের দেশ বাংলাদেশের ডিজিটাল রূপান্তরে নেতৃত্ব¡ দিচ্ছেন। দিনে দিনে আমি নিজেও তথ্যপ্রযুক্তিতেই অনেক বেশি জড়িয়ে ফেলি। সেই যে ছাত্রজীবনে ছাত্রলীগ করে মুক্তিযুদ্ধে গেলাম- তারপর সাংবাদিকতা, মুদ্রণ ব্যবসা, ট্রাভেল এজেন্সি এসব নিয়ে কাটিয়ে কম্পিউটারে বাংলা প্রয়োগ করার ক্ষেত্রটাতেই আটকে গেলাম। বলা যেতে পারে যে, জীবনের পুরো ছকটাই পাল্টে গেল। মুক্তিযুদ্ধের পর রাজনীতির চাইতে সাংবাদিকতা অনেক বেশি প্রিয় হওয়ার পরও রাজনীতি আমার পিছু ছাড়েনি। পারিবারিকভাবেও আমি আমার রাজনৈতিক বৃত্তে আবদ্ধ থেকে যাই। ’৭০ সালে বাবা আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে যুক্ত হন। ’৭২ সালে খালিয়াজুরী থানা আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করা শুরু করেন। ’৭৮ সালে বাবার মৃত্যুর পর সিদ্দিকুর রহমান তালুকদার ও হাসান চৌধুরী সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। ’৯৮ সালে ছোট ভাই কিবরিয়া থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি হয়। তার আগেই আব্দুল মমিন সাহেব আমাদের এলাকার সংসদ সদস্য পদে নির্বাচন করেন। ’৯১ সালের নির্বাচনে তিনি হেরে যান। এরপরই কিবরিয়ার মাধ্যমে উনার সঙ্গে আমার যোগাযোগ হতে থাকে। এক সময়ে নেত্রকোনা জেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলনে তিনি আমাকে জেলা কমিটিতে যুক্ত করেন। আওয়ামী লীগের সঙ্গে সাংগঠনিকভাবে যুক্ত হওয়াটা তখনই প্রথম। তবে আওয়ামী লীগের সঙ্গে গাটছড়াটা বাঁধে পেশার সূত্র ধরে। ’৮৭ সালে কম্পিউটারে বাংলা প্রয়োগের পর আমি ’৮৯ সালে আনন্দপত্র বাংলা সংবাদ-আবাস নামে দেশের প্রথম ডিজিটাল সংবাদ সংস্থা গড়ে তুলি। প্রথমে ফ্যাক্সের মাধ্যমে তথ্য পাঠাতাম। পরে ডিজিটাল যন্ত্র ব্যবহৃত হতে থাকে। যোগাযোগ করা হতো ইন্টারনেট ছাড়া। বাংলাদেশের প্রথম ডিজিটাল এই সংবাদমাধ্যমটি দিয়ে আমরা তখন দেশ-বিদেশে তথ্য প্রচার করি। একটি মেকিন্টোস কম্পিউটারের সঙ্গে একটি মডেম ও একটি টিএ্যান্ডটি ফোন লাইন ব্যবহার করে আমরা তথ্য আদান-প্রদান করতাম। সেই সময়েই জননেত্রী শেখ হাসিনা এক পরম দুঃসাহসী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। ’৯৬ সালের নির্বাচনকে সামনে রেখে আমি যুক্ত হই আওয়ামী লীগের মিডিয়া টিমের সঙ্গে। সেই টিমেই আমি প্রস্তাব করি আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রচারণাকে ডিজিটাল করা যেতে পারে। আমার প্রস্তাব জননেত্রী শেখ হাসিনা সানন্দে গ্রহণ করেন। আমার প্রতিষ্ঠান আবাস-এর মাধ্যমে আমরা প্রথম নির্বাচনে ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করি। কাজটি অত্যন্ত সময়োপযোগী ছিল। তখন আমাদের নির্বাচনী প্রচারণা যদি ঢাকার বাইরে কোথাও হতো তবে তার খবর পরের দিনের পত্রিকায় ছাপা হলেও ছবি ছাপা হতো আরও একদিন পরে। তখন হয়ত সেই ছবির গুরুত্বও থাকত না। মোনায়েম সরকার তখন আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রচারণার সমন্বয়কের দায়িত্বে ছিলেন। আলোচনাটি মোনায়েম সরকারের সঙ্গেই হয়। আমাদের প্রস্তাবে তিনি সানন্দে সম্মতি প্রদান করেন। আমি তার সহায়তার জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি। আমরা তখন আমার ভ্রাতুষ্পুত্র সিদ্দিকুর রহমানকে একটি স্ক্যানার, একটি মেকিন্টোস কম্পিউটার ও একটি মডেম দিয়ে নেত্রীর নির্বাচনী প্রচারণা টিমের সঙ্গে যুক্ত করে দিই। তখনও আমাদের কোন ল্যাপটপ ছিল না। বস্তুত দুনিয়াতেই ছিল না। ৯ ইঞ্চির ডেস্কটপ ম্যাক ব্যবহার করতে হতো। বিশাল আকারের মডেম বহন করতে হতো। ঢাকা, ১ অক্টোবর, ২০১৬ লেখক : তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, দেশের প্রথম ডিজিটাল নিউজ সার্ভিস আবাস-এর চেয়ারম্যান, বিজয় কীবোর্ড ও সফটওয়্যারের জনক ॥ [email protected] w.bijoyekushe.net, ww w.bijoydigital.com
×