ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

কারসাজির অভিযোগ বিজেএমসির একটি স্বার্থান্বেষী মহলের বিরুদ্ধে

সুদানে সাড়ে তিন শ’ কোটি টাকার পাটপণ্য বাজার হাতছাড়া হওয়ার শঙ্কা

প্রকাশিত: ০৬:২৩, ১ অক্টোবর ২০১৬

সুদানে সাড়ে তিন শ’ কোটি টাকার পাটপণ্য বাজার হাতছাড়া হওয়ার শঙ্কা

জনকণ্ঠ রিপোর্ট ॥ সুদানে বাংলাদেশের সাড়ে তিন শ’ কোটি টাকার পাটপণ্যের বাজার হাতছাড়া হতে বসেছে। দেশের একটি কোম্পানি সুদানে এই পাটপণ্য রফতানির কার্যাদেশ পেলেও, বিজেএমসির একটি স্বার্থান্বেষী মহলের কারসাজিতে সুদানে ওই পাটপণ্য রফতানি করা যাচ্ছে না। এমনকি অগ্রিম টাকা নিয়েও পাটপণ্য শিপমেন্ট করছে বিজেএমসি। ফলে সুদানের সম্ভাবনাময় পাটের বাজার হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে। এ প্রসঙ্গে সুদানে দেশের পাটপণ্য বিক্রির জন্য বিজেএমসির একক এজেন্ট প্রতিষ্ঠান দ্য গোল্ডেন ফাইবার ট্রেড সেন্টার লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোশতাক হোসেন বলেন, ‘আমরা সুদানে পাটের ব্যাগ সরবরাহের জন্য ৩৫০ কোটি টাকার অর্ডার নিয়ে এসেছি। এরমধ্যে পাটপণ্য উৎপাদনের জন্য বিজেএমসিকে ৫০ কোটি টাকা অগ্রিমও দিয়েছি। সেই টাকায় বিজেএমসি ব্যাগও তৈরি করে রেখেছে। কিন্তু শিপমেন্ট করছে না।’ তিনি অভিযোগ করেন, বিজেএমসির কিছু স্বার্থান্বেষী কর্মকর্তা এক সুদানী ব্যবসায়ীর সঙ্গে যোগসাজশে এই পাটপণ্য রফতানি আটকে রেখেছে। কৃষি মৌসুমের মধ্যে ওই পাটপণ্য রফতানি করতে না পারলে সুদান সরকার ওই পাটের বস্তা নেবে না। ফলে বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা আয় থেকে বাংলাদেশ বঞ্চিত হবে।’ উল্লেখ্য, গোল্ডেন ফাইবার ট্রেড সেন্টার হচ্ছে সুদানে সরকারী পর্যায়ে পাটপণ্য বিক্রির জন্য বিজেএমসির একক এজেন্ট। চুক্তি অনুযায়ী, সুদানের তিনটি সরকারী প্রতিষ্ঠান এগ্রিকালচারাল ব্যাংক অব সুদান, সুদান কটন কোম্পানি লিমিটেড এবং ফার্মার্স কমার্শিয়াল ব্যাংক এই কোম্পানির মাধ্যমে বিজেএমসির কাছ থেকে পাটপণ্য কিনে থাকে। সুদান একটি কৃষিপ্রধান দেশ হওয়ায় সেদেশের সরকার কৃষিপণ্য সংরক্ষণের জন্য কৃষকদের পাটের ব্যাগ সরবরাহ করে। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে, বেসরকারী কোম্পানি যাতে বাজারে পাটের ব্যাগের কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টি করতে না পারে। সুদানে প্রতিবছর প্রায় এক থেকে দেড় লাখ বেল পাটের ব্যাগের প্রয়োজন হয়। মোশতাক হোসেন অভিযোগ করেন, ‘আমরা সুদানে পাটপণ্য বিক্রির একমাত্র এজেন্ট হওয়া সত্ত্বেও আমাদের সঙ্গে কোন প্রকার আলোচনা না করেই বিজেএমসি সুদানী এক ব্যবসায়ীর সঙ্গে ছয় মাসের পণ্য বিক্রির চুক্তি করেছে। শুধু তাই নয়, আমাদের দেড় লাখ বেলের অর্ডারের মধ্যে এক লাখ ৩০ হাজার বেল অর্ডার বাতিল করেছে। এই অর্ডার বাতিলের চিঠিও চলে গেছে ওই সুদানী ব্যবসায়ীর কাছে। ফলে ওই ব্যবসায়ী আমাদের অর্ডার বাতিলের চিঠি সুদান সরকারের কাছে দেখিয়ে বলছে তোমরা যে কোম্পানিকে পাটপণ্য আমদানির কার্যাদেশ দিয়েছে তার অর্ডার বাতিল হয়েছে। ফলে সে তোমাদের পাটের বস্তা দিতে পারবে না। এতে সুদানী কর্তৃপক্ষ বিভ্রান্ত হচ্ছে। তারা এ বিষয়ে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের কাছে প্রকৃত অবস্থা জানতে চেয়েছে। কিন্তু মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে তাদের এ বিষয়ে কিছু জানানো হচ্ছে না।’ তিনি বলেন, ‘মূলত সুদানী ওই ব্যবসায়ীর স্বার্থরক্ষার জন্যই বিজেএমসি এই চুক্তি করেছে। এখন তার জন্য মায়াকান্না করছে সংস্থাটির স্বার্থান্বেষী কর্মকর্তারা।’ তিনি বলেন, আমরা আগে থেকেই বিজেএমসিকে জানিয়ে এসেছি, সুদান থেকে আমাদের কাছে বড় অর্ডার আসছে। এবছর সুদান সরকার কৃষির ভাল ফলন আশা করছে। ফলে তাদের শস্য সংরক্ষণের জন্য পাটের ব্যাগের চাহিদা বেড়ে যাবে। সে অনুযায়ী, আমরা বিজেএমসিকে দেড় লাখ বেলের একটি চাহিদা দিয়ে রেখেছি। এখন আমাদের কাছে এক লাখ বেলের অর্ডার এসেছে। আমাদের অগ্রিম টাকা দিয়ে বিজেএমসি পাটের বস্তা তৈরি করে রেখেছে, কিন্তু শিপমেন্ট করছে না। মোশতাক হোসেন বলেন, আমরা এ বিষয়টি সরকারের উচ্চ পর্যায়ে জানিয়েছি। এখন বিজেএমসি বলছে ২০ হাজার বেল পাটের ব্যাগ তারা এখন দেবে, অবশিষ্ট ব্যাগ ফেব্রুয়ারিতে দেবে। কিন্তু ফেব্রুয়ারিতে সুদানের কৃষি মৌসুম শেষ হয়ে যাবে। তখন তারা পাটের ব্যাগ দিয়ে কি করবে? এ অবস্থা করলে সুদানে বাংলাদেশের পাটের বাজার হাতছাড়া হয়ে যাবে। তারা বাংলাদেশের অপেক্ষায় না থেকে ভারত থেকে পাটের ব্যাগ ক্রয় করবে। বিজেএমসির মিলগুলোতে তিন শিফটে কাজ করলে জানুয়ারির মধ্যেই বিজেএমসি পাটের ব্যাগ সরবরাহ করতে পারবে বলে তিনি মনে করেন। তিনি বলেন, ‘আসলে বিজেএমসি আমাদের অর্ডারকে গুরুত্ব দিচ্ছে না। তারা সুদানী ব্যবসায়ীকে মাল দেয়ার পাঁয়তারা করছে। আমাদের অর্ডারকে গুরুত্ব দিলে তারা সুদানী ব্যবসায়ীর সঙ্গে চুক্তি করত না। ওই ব্যবসায়ীকে মাল দিতে হলে বিজেএমসিকে তার পণ্য উৎপাদন করতেই পাঁচ-ছয় মাস ব্যস্ত থাকতে হবে। আমাদের মাল দেবে কি করে?’ তিনি অভিযোগ করেন, ওই সুদানী ব্যবসায়ী বাংলাদেশের কনসাল জেনারেল হিসেবে কাজ করছে। বিগত বিএনপি সরকার ১৯৯১ সালে সুদানী ব্যবসায়ী আমিন আবদেল লতিফ নামে এই ব্যবসায়ীকে সুদানে বাংলাদেশের কনসাল জেনারেল হিসেবে নিয়োগ দেয়। সে সুবাদে ১৯৯১ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত এবং ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত জোট সরকারের আমলে একচেটিয়াভাবে পাটপণ্যের ব্যবসা করেন। মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর তার ব্যবসায় ভাটা পড়লে তিনি একের পর এক বাংলাদেশী পাটপণ্যের বিরুদ্ধে অপতৎপরতা চালাতে শুরু করেন। গোল্ডেন ফাইবার ট্রেড সেন্টারের এমডি মোশতাক হোসেন জানান, বিএনপি সরকারের আমলে নিয়োগ পাওয়া এই অনারারি কনসাল জেনারেল নিজের ব্যবসায়িক স্বার্থে একের পর এক বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। এমনকি সুদানের পাটপণ্য আমদানির দরপত্রে অংশগ্রহণ করতে না পেরে সেদেশের সরকারের কাছে অভিযোগ করেছে, বিজেএমসির একসঙ্গে অধিক পরিমাণে পাটপণ্য উৎপাদনের সক্ষমতা নেই। বরং ভারত বিশ্বের বৃহত্তম পাট উৎপাদনকারী দেশ। ভারত থেকে সুদানকে পাটপণ্য আমদানি করতে বলেছে। এ ব্যাপারে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ে একাধিক অভিযোগ জমা পড়েছে। তিনি তার অপতৎপরতার উদাহরণ দিয়ে বলেন, এগ্রিকালচারাল ব্যাংক অব সুদানের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান গ্রীন রেভ্যুলিউশন কোম্পানি ফর ট্রেড এ্যান্ড সার্ভিসেস গত মে মাসে ৬০ হাজার বেল স্ট্যান্ডার্ড বি টুইল ব্যাগ কেনার জন্য একটি দরপত্র আহ্বান করে। এতে শর্ত জুড়ে দেয়া হয় ওই ব্যাগ বাধ্যতামূলকভাবে বাংলাদেশের বিজেএমসির হতে হবে। কিন্তু বাংলাদেশের কনসাল জেনারেল এতে ক্ষুব্ধ হয়ে সেদেশের এ্যাটর্নি জেনারেল অফিসের মাধ্যমে লিখিত অভিযোগ এনে বাধ্যতামূলক বিজেএমসির ব্যাগ আমদানির ওই দরপত্র স্থগিত করান। তিনি আরও জানান, গ্রীন রেভ্যুলিউশন কোম্পানি গত আগস্টে এক লাখ বেল স্ট্যান্ডার্ড বি টুইল ব্যাগ কেনার জন্য পুনরায় দরপত্র আহ্বান করলে সেটাও তিনি নানা অভিযোগ এনে পিছিয়ে দেন। এবার তিনি আরবিতে একটি অভিযোগপত্র দাখিল করেন। এতে তিনি উল্লেখ করেন, বিজেএমসির যে দরে পাটপণ্য বিক্রি করছে তা অল্প পরিমাণে কেনার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। বেশি পরিমাণে কিনলে মূল্য ৯০ ডলারে নেমে আসবে। তাই বেশি দরে পাটপণ্য কেনা হলে সুদানের কৃষকেরাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। উল্লেখ্য, বর্তমানে বিজেএমসির প্রতি এক শ’ বস্তা পাটপণ্য বিক্রি করছে ১০১ ডলার থেকে ১০৩ ডলার মূল্যে। মূলত সুদান সরকারের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টির জন্যই তিনি এসব তথ্য দেন। অথচ তিনি বিজেএমসির কাছ থেকে পাট কেনার যে চুক্তি করে গেছেন তাতে ১০১ ডলারই উল্লেখ করা হয়েছে। মোশতাক হোসেন তার চিঠি প্রসঙ্গে বলেন, চিঠিতে তিনি বাংলাদেশের একচেটিয়া বাজার নষ্ট করারও তৎপরতা চালান। ভারত সর্ববৃহৎ পাটপণ্য উৎপাদনকারী দেশ। সেক্ষেত্রে কেন ভারতকে বাদ দিয়ে শুধু বিজেএমসির পাটপণ্যই দরপত্রে বিবেচনা করা হবে? এসব তিনি চিঠিতে উল্লেখ করেন। এখানেই তিনি ক্ষান্ত থাকেননি। তিনি তার আরবি চিঠিতে বিজেএমসির উৎপাদন ক্ষমতা নিয়েও সংশয় প্রকাশ করেছেন। তিনি উল্লেখ করেছেন, বিজেএমসির একসঙ্গে এতো বিপুল পরিমান পাটপণ্য উৎপাদনের ক্ষমতা নেই। অথচ বিজেএমসিই হলো বিশ্বের সর্ববৃহৎ পাটপণ্য প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান, যার অধীনে ২২টি পাটকল অব্যাহতভাবে পাটপণ্য উৎপাদন করে যাচ্ছে। এসব বিভ্রান্তিকর তথ্য দিয়ে বাংলাদেশের কনসাল জেনারেল মূলত সুদানের পাটপণ্য আমদানির বাজারকে ভারত ও পাকিস্তানের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় ঠেলে দিতে চাইছেন। যাতে তার প্রতিষ্ঠান দ্য সেন্ট্রাল ট্রেডিং কোম্পানি ভারত ও পাকিস্তান থেকে পাটপণ্য আমদানি করতে পারে। কারণ বর্তমানে সুদানের তিনটি সরকারী আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানকে শুধুমাত্র বাংলাদেশের বিজেএমসি থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত আমাদের মাধ্যমেই পাটপণ্য আমদানি করতে হবে। জানা যায়, সুদান সরকারের কাছে পাট পণ্যের বিল বাবদ বাংলাদেশের প্রায় এক হাজার ৬৫০ কোটি টাকা বকেয়া পাওনা রয়েছে। এ কারণে সুদানী সরকারী প্রতিষ্ঠানগুলো গত চার-পাঁচ বছর ধরে কেবলমাত্র বাংলাদেশের বিজেএমসির পাটপণ্যই আমদানি করে আসছে। পাটপণ্য আমদানির কোন দরপত্র আহ্বান করলে তাতে শর্ত জুড়ে দেয়া হয় আমাদনিকৃত পাটপণ্য বাংলাদেশের বিজেএমসির হতে হবে। মুসলিম দেশ হওয়ায় গত তিন দশক ধরে সুদান বাংলাদেশ থেকে একচেটিয়া পাটপণ্য ক্রয় করে আসছে। সুদানের কৃষকদের কাছেও বাংলাদেশের তৈরি পাটের বস্তা খুবই জনপ্রিয়। বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর থেকেই সুদানের সরকারী-বেসরকারী এবং কৃষকগণ বিজেএমসির পাটের বস্তাকে অগ্রাধিকার দিয়ে আসছে। কিন্তু বাংলাদেশী একটি কোম্পানি সুদানে পাট রফতানির কার্যাদেশ পাওয়ার পর থেকে সুদানী ওই ব্যবসায়ী অপতৎপরতায় মেতে ওঠেন। সুদান সরকারকে প্রভাবিত করে শুরু করেন পাকিস্তান থেকে পাটপণ্য আমদানির।
×