ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

বদলে গেছে ওদের জীবনচিত্র ॥ তবে হতাশাও আছে অনেকের

সাতক্ষীরায় ভূমিহীন ১৪শ’ পরিবার এখন জমির মালিক

প্রকাশিত: ০৬:২০, ১ অক্টোবর ২০১৬

সাতক্ষীরায় ভূমিহীন ১৪শ’ পরিবার এখন জমির মালিক

মিজানুর রহমান, সাতক্ষীরা থেকে ॥ সাতক্ষীরায় খাসজমির শ্রেণী পরিবর্তন করে ভূমিহীনদের মাঝে বিতরণের প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা দীর্ঘ দেড় যুগেও সম্পূর্ণ কার্যকর হয়নি। মোট ৩১৭৮ একর খাসজমির মধ্যে ১৫২৭.৮৬ একর খাসজমি এখনও রয়েছে প্রভাবশালীদের দখলে। তবে অবমুক্ত হওয়া ১১৯১.৭৯ একর জমি বিতরণ করা হয়েছে ভূমিহীনদের মধ্যে। প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণায় সাতক্ষীরার ১৩শ’ ৬৪ ভূমিহীন পরিবারকে দেয়া হয়েছে খাসজমির স্থায়ী দলিল। এখনও বন্দোবস্ত রেজিস্ট্রি দলিল সম্পাদনযোগ্য জমির পরিমাণ- ৪৫৮.৩৫ একর। আর ভূমিহীনদের এই খাসজমি পাওয়ার জন্য জমির নথি তৈরি থেকে দলিল রেজিস্ট্রি পর্যন্ত যাবতীয় খরচ দিয়ে সহায়তা করছে বেসরকারী সংস্থা উত্তরণ। পরিবারপ্রতি এক একর করে জমির দলিল পেয়ে ভূমিহীনরা এখন নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখছে। ভূমিহীন থেকে ওরা হয়েছে ভূমি মালিক। বদলে গেছে ওদের জীবনচিত্র। তবে যারা এখনও খাসজমির দলিল পায়নি, তাদের মধ্যে রয়েছে হতাশা। শ্রেণী পরিবর্তন না হওয়া খাসজমি নিয়ে এলাকায় রয়েছে সামাজিক অস্থিরতা। সাতক্ষীরার দেবহাটা কালীগঞ্জে বসবাসরত ভূমিহীনদের দাবি, অবিলম্বে প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা কার্যকর করতে অবশিষ্ট ১৫২৭.৮৬ একর খাসজমি শ্রেণী পরিবর্তন করে অবমুক্ত করে ভূমিহীনদের মাঝে স্থায়ী বন্দোবস্ত দেয়া হোক। সাতক্ষীরার দেবহাটা ও কালীগঞ্জে হাজার হাজার বিঘা সরকারী খাসজমির শ্রেণী পরিবর্তন করে ভূমিহীনদের মাঝে বিতরণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্দেশ দেন ১৯৯৮ সালে। দীর্ঘ দেড় যুগেও প্রধানমন্ত্রীর এ নির্দেশ সম্পূর্ণ কার্যকর না হওয়ায় সাতক্ষীরার দেবহাটা ও কালীগঞ্জ উপজেলায় বসবাসরত ভূমিহীনদের মাঝে রয়েছে সামাজিক অস্থিরতা। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশের পরও খাসজমি ‘অবমুক্ত’ করে কৃষি খাসজমিতে রূপান্তর করা না করায় সমস্যা রয়ে গেছে। পিও/৭২ এর বলে সরকার সাতক্ষীরার দেবহাটা ও কালীগঞ্জ উপজেলার ঢেপুখালিপূর্ব, ঢেপুখালি পশ্চিম, কাঠমহল, কামিনীবসু, কালাবাড়িয়া-১, কালাবাড়িয়া-২, নোড়া চারকুনি, ঝায়ামারী, ভাঙ্গানমারী ও বাবুরাবাদ এলাকায় দশটি গ্রামে ৩ হাজার ১শ’ ৭৮ একর জমি অধিগ্রহণ করে খাস ঘোষণা করে। ১৯৮২ সালে সুপ্রীমকোর্টের আপীল বিভাগ পৃথক দুটি রায়ে এই জমি ‘কৃষি খাসজমি’ হিসেবে সরকারের ১নং খাস খাতিয়ানভুক্ত করে তা ভূমিহীনদের মাঝে সরকারী নীতিমালা অনুযায়ী বন্দোবস্ত দেয়ার আদেশ দেয়া হয়। খাসজমির অধিকার নিয়ে ১৯৯৮ সালে দেবহাটা কালীগঞ্জে গড়ে ওঠে ভূমিহীনদের আন্দোলন। সে সময় প্রশাসন ও ভূমিদস্যুদের নির্যাতনে ও পুলিশের গুলিতে ভূমিহীন জায়েদা নিহত হওয়ার পর উত্তাল হয়ে ওঠে সাতক্ষীরা। খাসজমি পাওয়ার এ অধিকারের প্রতি দেশজুড়ে সমর্থন মেলে। ভূমিহীনদের দাবির প্রতি সমর্থন জানিয়ে সে সময়ে বিরোধী দলসহ সকল রাজনৈতিক দলের প্রধানরা সাতক্ষীরায় এসে জনসভা করে ভূমিহীনদের আন্দোলনের প্রতি সংহতি প্রকাশ করেন। উত্তাল সাতক্ষীরাকে নিয়ন্ত্রণ করতে সে সময়ের প্রধানমন্ত্রী বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা সাতক্ষীরার কালীগঞ্জে এসে জনসভায় খাসজমিতে বসবাসরত সকল ভূমিহীনদের জমি প্রদানের ঘোষণা দেন। এছাড়া চিংড়ি ঘের হিসেবে ব্যবহৃত খাসজমির শ্রেণী পরিবর্তন করে কৃষি খাসজমিতে রূপান্তরিত করে স্থানীয় ভূমিহীনদের মাঝে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ঘোষণা দেন। ১৯৯৮ সালে প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী কালীগঞ্জে ৭শ’ ৩১ একর, দেবহাটায় ৪শ’ ২৬ একর জমি এবং দেবহাটা কালীগঞ্জের নোড়া চারকুনি এলাকায় ৪শ’ ৯২ একর জমি অবমুক্ত করা হয়। সরকার প্রতিশ্রুত ভূমিহীনদের মধ্যে খাসজমি বিতরণ প্রক্রিয়ায় ইতোমধ্যে ১৩৫৪ জন ভূমিহীন পরিবারের মধ্যে জমির দলিল হস্তান্তর করা হয়েছে। এ সকল পরিবার পেয়েছে ৯শ’ ৭৪ একর খাসজমি। সরকারের দেয়া খাসজমি বদলে দিয়েছে ওদের জীবনচিত্র। ওদের জীবন এখন অন্য ভূমিহীনদের মতো আর অনিশ্চয়তায় নয়। বহুমুখী আয়ের উৎস হওয়ায় এখন ওদের প্রতিদিনের কাজের চিন্তা করতে হয় না। থাকার জায়গার জন্য ভাবতে হয় না। নিশ্চিন্ত আবাস হয়েছে ওদের। এলাকায় সহিংসতা কমেছে। খাসজমি পাওয়া এ সকল পরিবারের সদস্যরা এখন পুষ্টিকর খাবার খায়। ছেলেমেয়েরা স্কুলে যায়। পরিবারের সদস্যরা রুচিসম্মত পোশাক পরে। ওদের সামাজিক মর্যাদা বেড়েছে। বেড়েছে গ্রহণযোগ্যতা। বহুমুখী আয়ের উৎসে এখন ওরা স্বাবলম্বী। খাসজমির মালিকানা ওদের এনে দিয়েছে দুশ্চিন্তাহীন নতুন জীবন। ভূমিহীন জনপদের ঢেবুখালিতে ২ বিঘা খাসজমিতে বসতি মনোয়ারা বেগমের। মনোয়ারা বলেন, সরকারের দেয়া ২ বিঘা খাসজমি আমার পরিবারে অলৌকিক পরিবর্তন এনে দিয়েছে। খাসজমির জন্য দীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রামের পর আমি জমির দলিল পেয়েছি। পেয়েছি ভবিষ্যতের ঠিকানা। ২০১৪ সালের ৮ মে আমার নামে এই দলিল রেজেস্ট্রি হয়। বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থা উত্তরণের অপরাজেয় প্রকল্প আমাকে জমি পেতে সহায়তা করেছে। মাছ চাষের জন্য আর্থিক ঋণসুবিধা পেয়েছি। বসতঘর আর রান্নাঘর তৈরির পর বাকি জমিতে চলে চিংড়ি চাষ। চিংড়ি চাষ করে বছর শেষে খরচা বাদে আমার থাকে ২৫ হাজার টাকা থেকে ৩০ হাজার টাকা। পাশাপাশি ছাগল আর মুরগি পালন করে সংসারের খরচ মেটাই। ভূমিহীন পরিবারে জন্ম হলেও আমি এখন আর ভূমিহীন নই। আজ আমি সুখী-সমৃদ্ধ ও উন্নয়নমুখী। তবে ভূমিহীন জনপদে বসবাস করলেও খাসজমি না পাওয়া ভূমিহীনদের সংখ্যাও কম নয়। এদের মধ্যে রয়েছে হতাশা, ক্ষোভ, দ্বন্দ্ব, সহিংসতা। গত এক বছরে খাসজমির দখল পাল্টা দখল নিয়ে সংঘর্ষে কয়েকজনের মৃত্যুও হয়েছে। সরকারী খাসজমির ইজারা দেয়াও বন্ধ রয়েছে। শ্রেণী পরিবর্তন না হওয়া খাসজমিতে বসবাসরত ভূমিহীনদের সংখ্যাও কম নয়। খাসজমি না পাওয়া নোড়ার চকে বসবাসরত ভূমিহীন গফ্ফার বলেন, ৩ বিঘা জমিতে তিনি বসবাস করেন দীর্ঘদিন। খাসজমি হলেও প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার পরও জলমহাল হিসেবে চিহ্নিত এই জমির শ্রেণী পরিবর্তন করে কৃষি খাসজমিতে রূপান্তর না করায় আমি খাসজমির দলিল পাইনি। এই জমি নিয়ে প্রভাবশালী ভূমিদস্যুদের সঙ্গে সংগ্রাম লড়াই করতে হয় প্রতিনিয়ত। অভাব আমার পরিবারে নিত্যসঙ্গী। খাসজমিতে স্থায়ীভাবে নিশ্চিন্তে বসবাসের জন্য খাসজমির শ্রেণী পরিবর্তনে আমরা প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার বাস্তবায়ন চাই বলে জানান গফ্ফার মোড়ল।
×