ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

চলনবিলের মাছের শুঁটকি

চাহিদা বাড়ছে বিদেশে সুনাম কুড়াল ‘ইয়োলো গোল্ড’

প্রকাশিত: ০৬:১৯, ১ অক্টোবর ২০১৬

চাহিদা বাড়ছে বিদেশে সুনাম কুড়াল ‘ইয়োলো গোল্ড’

সমুদ্র হক ॥ মাছে ভাতে বাঙালী। এক সময় প্রচুর মাছ পাওয়া যেত দেশে। আবার কিছুদিন ঘাটতিও ছিল। এখন তাজা মাছ ঘাটতি মিটিয়ে রফতানি হচ্ছে। সেই সঙ্গে শুকনো মাছও (শুঁটকি) রফতানির পথ উন্মুক্ত করেছে। পূর্বাঞ্চল ও উপকূলীয় এলাকায় সামুদ্রিক শুঁটকির পর দেশের সবচেয়ে বড় বিল উত্তরাঞ্চলের চলনবিলে মিঠাপানির মাছের শুঁটকির আধার তৈরি হয়েছে। এই শুঁটকি এখন বিদেশেও রফতানি হচ্ছে। এনেছে বৈদেশিক মুদ্রা। দক্ষিণাঞ্চলের ‘হোয়াইট গোল্ড’ বা সাদা সোনা খ্যাত চিংড়ির পর উত্তরাঞ্চলের শুঁটকি ‘ইয়োলো গোল্ড’ হয়ে সুনাম কুড়িয়েছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, লোনাপানির মাছের শুঁটকির স্বাদ একরকম, মিঠাপানির মাছের শুঁটকির স্বাদ আরেক রকম। বিদেশীদের কাছে মিঠাপানির মাছের শুঁটকির চাহিদা বাড়তে শুরু করেছে। দেশের মানুষের কাছেও মিঠাপানির মাছের শুঁটকির চাহিদা লোনাপানির মাছের শুঁটকির চেয়ে বেশি। চলনবিল দিনে দিনে শুকনো ভূমিতে পরিণত হয়ে মাছের আধার কমিয়েছে, তবে নতুন আধার সৃষ্টি করেছে শুঁটকি মাছের। বৃহৎ এই জলাভূমিতে আজ আর থৈ থৈ পানি নেই। বিলের অনেকটা ভূমিজুড়ে ধান-পাট, সবজিসহ নানান ফসলের আবাদ হচ্ছে। এর পাশাপাশি বিলের নিচু ভূমির খালগুলোতে শুরু হয়েছে মাছের চাষ। মাছ ধরার সময় উৎসবে পরিণত হয়। ভেসাল জাল সুতি জাল বেড়া জাল পলই দিয়ে মাছ ধরা হয়। এই মাছের সামান্য অংশ যায় স্থানীয় হাটবাজারে। চার ভাগের তিন ভাগই যায় শুঁটকি বানানোর জায়গায়। বিভিন্ন পয়েন্টে শুঁটকির চাতাল ও মাছ শুকানোর আলাদা স্থান তৈরি করা হয়েছে। বিলপাড়ের এলাকায় প্রবেশের পর শুঁটকির গন্ধ টেনে নিয়ে যায় চাতালের দিকে। এছাড়াও বাঁশের ছাউনিতে বসানো হয়েছে ছোট ছোট অস্থায়ী চাতাল। বিলের মধ্যেই এ ধরনের তিন শতাধিক অস্থায়ী চাতাল বসেছে। এসব চাতালে মিঠাপানির নানা জাতের মাছের শুঁটকি বানানো হচ্ছে। চাতালে শোল, বোয়াল, পুঁটি, সরপুঁটি, খলসে, চেলা, ট্যাংরা, পাতাসি, মলা, ঢেলা, টাকি ছাতেন, বাইম, কৈ, মাগুর, শিংসহ মিঠাপানির সব ধরনের মাছের শুঁটকি বানানো হচ্ছে। এমনকি চিংড়ি মাছের শুঁটকি তৈরি হয় এই বিলে। আশ্বিন মাস থেকে অগ্রহায়ণ মাস পর্যন্ত শুঁটকি তৈরি হয়। প্রতি মণ তাজা মাছ শুকালে ১৬ কেজি শুঁটকি মেলে। সাধারণত ৩ মণ তাজা মাছে এক মণ শুঁটকি পাওয়া যায়। প্রায় ১২০ বর্গকিলোমিটার আয়তনের ২২টি জলাশয় ও ১৬টি নদীর সমন্বয়ে এ বিলের প্রায় সাড়ে ৪ হাজার হেক্টর জলাভূমিতে মাছ আহরণ করে শুঁটকি তৈরি হচ্ছে। একজন রফতানিকারক জানালেন, বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, মালয়েশিয়া সৌদি আরব কাতার বাহরাইন দুবাই ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের কয়েকটি দেশে এই শুঁটকি যাচ্ছে। চলতি অর্থবছরে ৩শ’ মেট্রিক টনেরও বেশি শুঁটকি তৈরি হয়ে রফতানির তালিকায় যোগ হবে। শুঁটকি তৈরির পর এ বি সি এই তিন গ্রেডে ভাগ করা হয়। এ গ্রেডের সকল শুঁটকি যায় বিদেশে। বি ও সি গ্রেড বিক্রি হয় দেশীয় বাজারে। ঢাকা, চট্টগ্রাম নারায়ণগঞ্জ বগুড়া রংপুর রাজশাহী খুলনা নীলফামারী বরিশালসহ দেশের প্রায় প্রতিটি অঞ্চলে এই শুঁটকি বাজারজাত হচ্ছে। মান ভেদে ছোট আকৃতির মাছের শুঁটকির দাম প্রতি মণ ১৬ থেকে ২৫ হাজার টাকা। বড় আকৃতির মাছের শুঁটকির দাম প্রতি মণ ৩০ হাজার টাকা থেকে ৭০ হাজার টাকা। নাটোরের গুরুদাসপুর উপজেলার ব্যবসায়ী নাজমুল আলম বললেন, গত বছর তার চাতালে ৭শ’ মণ শুঁটকি তৈরি হয়েছে। সবই ঢাকা চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীরা কিনে নিয়ে গেছেন। মূলত ঢাকা চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীদের হাত ঘুরে এই শুঁটকি বিদেশে যাচ্ছে। ঢাকার আশুলিয়ার ব্যবসায়ী আব্দুর রাজ্জাক জানালেন, এ ব্যবসায় লাভ-লোকসান দুই-ই আছে। শুঁটকি ভালভাবে শুকানো না হলে পঁচে নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনাও থাকে। উন্নতমানের শুঁটকি কিনে বড় ব্যবসায়ীরা তা প্রক্রিয়াজাত করে রফতানি করেন। চাটমোহরের ব্যবসায়ী সমিতির নেতৃবৃন্দ জানালেন, চলনবিলের শুঁটকি বেশি স্বাদের। বিদেশে এ শুঁটকির চাহিদা বেশি। চলনবিলের শুঁটকির এত যে চাহিদা তারপরও প্রক্রিয়াজাত ও সংরক্ষণের তেমন ব্যবস্থা নেই। যারা রফতানি করেন তারাই নিজের উদ্যোগে সংরক্ষণ ও প্যাকেটজাত করেন। শুঁটকি প্রক্রিয়াজাত ও সংরক্ষণের কোন প্রশিক্ষণের উদ্যোগও নেই। শুঁটকি রফতানিকারক ব্যবসায়ীরা বলছেন, অপার সম্ভাবনার এ খাতটিকে এগিয়ে নিতে চাতাল মালিকদের প্রশিক্ষণ দেয়া দরকার। মৎস্য অধিদফতর এ কাজে এগিয়ে আসতে পারে। একই সঙ্গে শুঁটকির মান উন্নয়নে চাতাল মালিকদের সহজ শর্তে ঋণ প্রদানের পরামর্শ দিয়েছেন তারা। ১৯১৪ সালে চলনবিলের বিশাল এ মাছের আধার থেকে কলকাতায় মাছ নিয়ে যাওয়ার জন্য ব্রিটিশরা ইশ্বরদী-সিরাজগঞ্জ রেলপথ নির্মাণ করে। শুঁটকির এ আধার টিকিয়ে রাখতে পরিকল্পনা এবং তা বাস্তবায়নের দাবি শুঁটকি ব্যবসায়ী ও রফতানিকারকদের।
×