ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

লাগাম টেনে ধরতে নিয়মিত বাজার মনিটরিংয়ের তাগিদ

চাল, চিনি ও তেলের বাজার উর্ধমুখী ॥ স্বস্তি নেই ভোক্তাদের ॥ কারসাজি অসাধু ব্যবসায়ীদের

প্রকাশিত: ০৬:১৫, ১ অক্টোবর ২০১৬

চাল, চিনি ও তেলের বাজার উর্ধমুখী ॥ স্বস্তি নেই ভোক্তাদের ॥ কারসাজি অসাধু ব্যবসায়ীদের

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ আন্তর্জাতিক বাজারের দোহাই দিয়ে অত্যাবশ্যকীয় তিন পণ্য চাল, চিনি ও ভোজ্যতেলের দাম বাড়ানো হচ্ছে। এ তিন পণ্যের দামই এখন উর্ধমুখী। লাগাম টেনে ধরা না গেলে ভোগ্যপণ্যের বাজার অস্থির হওয়ার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। কোরবানির ঈদের পর থেকে অসাধু ব্যবসায়ীদের কারসাজিতে বেড়ে গেছে চাল, চিনি ও ভোজ্যতেলের দাম। শুধু তাই নয়, অত্যাবশ্যকীয় এসব পণ্যের দাম কমানোর সরকারী নির্দেশনা থাকলেও তা বিবেচনায় না নিয়ে বরং উল্টো দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়ে ট্যারিফ কমিশনে চিঠি দিয়েছে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো। ব্যবসায়ীদের এ অপকৌশলের কারণে নিত্যপণ্যের বাজারে ভোক্তাদের স্বস্তি মিলছে না। এ বাস্তবতায় আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সমন্বয় করে পণ্যমূল্য নির্ধারণ এবং নিয়মিত বাজার মনিটরিং করার ওপর তাগিদ দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। জানা গেছে, এক সপ্তাহের ব্যবধানে রাজধানীর খুচরা বাজারে চালের দাম বেড়েছে কেজিতে ৪-৬ টাকা। পাইকারি ব্যবসায়ীরা বলছেন, ধানের মূলবৃদ্ধির অজুহাতে অটোরাইস মিল মালিকরা পণ্যটির দাম দফায় দফায় বাড়াচ্ছেন। যদিও মৌসুমের শুরুতেই তাদের কব্জায় চলে যায় অধিকাংশ ধান। রাজধানীর পুরান ঢাকার বাবুবাজার ও বাদামতলী এলাকার পাইকারি চাল ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, গত কোরবানির ঈদের আগে মোকামে মিনিকেট চালের দাম ছিল কেজিপ্রতি ৪১-৪২ টাকা। বর্তমানে একই পরিমাণ পণ্যে ৪৪-৪৫ টাকা দাম হাঁকাচ্ছেন মিল মালিকরা। মোকাম থেকে ওই চাল ঢাকায় আনতে কেজিতে আরও এক টাকার বেশি খরচ হচ্ছে। ফলে লাভ রাখতে মিনিকেট চাল তাদের বিক্রি করতে হচ্ছে প্রতি কেজি ৪৬-৪৭ টাকায়। আর খুচরা বাজারে তা বিক্রি করা হচ্ছে ৪৮-৫০ টাকায়। বাবুবাজার এলাকার চাল ব্যবসায়ীরা আরও জানান, আগে মোকাম মালিকরা চাল সরবরাহের পর পাইকারি ব্যবসায়ীরা সুবিধামতো দামে বিক্রি করতে পারতেন। কিন্তু সম্প্রতি মিল মালিকরা মূল্য নির্ধারণ করে দিচ্ছেন। নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে কমে বিক্রি করলে তার দায় ব্যবসায়ীদের নিতে হচ্ছে। মিল মালিকরা প্রতিদিনই চালের দাম বাড়াচ্ছেন। বাদামতলী-বাবুবাজার চাল আড়তদার সমিতির সাংগঠনিক সম্পাদক হাজী রফিকুল ইসলাম জানিয়েছেন, অটোরাইস মিল মালিকদের সিন্ডিকেটের কারণে চালের বাজারে অস্থিরতা বিরাজ করছে। ৪১-৪২ টাকার চাল মিলেই ৪৪-৪৫ টাকা দাম হাঁকানো হচ্ছে। প্রতিযোগিতামূলক বাজারে মিল মালিকরা দাম নির্ধারণ করে দেয়ায় তারা সমস্যায় পড়েছেন। ইচ্ছা করলেও তারা সামান্য কমে চাল বিক্রি করতে পারছেন না। কৃষি বিপণন অধিদফতরের হিসাব অনুযায়ী, বর্তমানে সরু চাল বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ৪৪-৫৪ টাকায়, যা এক মাস আগে ছিল ৪২-৫৩ টাকা। বর্তমানে মোটা চাল বিক্রি হচ্ছে কেজিপ্রতি ৩৬-৩৮ টাকায়। এর দাম এক মাস আগে ছিল ৩৩-৩৪ টাকা। চলতি অর্থবছরের (২০১৬-১৭) বাজেটে চাল আমদানির ওপর কাস্টমস ডিউটি ১০ শতাংশের পরিবর্তে ২৫ শতাংশ এবং রেগুলেটরি ডিউটি ১০ শতাংশ করার প্রস্তাব রাখা হয়। এ কারণে অনেকেই চাল আমদানি কমিয়ে দিয়েছেন বলে জানা গেছে। ভোজ্যতেল ও চিনির দাম বাড়ছে ॥ বাজারে বোতলজাত সয়াবিন তেল লিটারপ্রতি ৮ টাকা ও চিনির দাম কেজিতে ৬ টাকা বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে বিপণনকারী কোম্পানিগুলো। তাদের প্রস্তাব অনুযায়ী, বোতলজাত সয়াবিন তেলের খুচরা দর হবে লিটারপ্রতি ১০৩ টাকা। চিনির মিলগেট মূল্য হবে কেজিপ্রতি ৭২ টাকা। বর্তমানে বাজারে বোতলজাত সয়াবিন তেল লিটারপ্রতি ৯৪-৯৫ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। একটি কোম্পানি বিক্রি করছে ৯৮ টাকা দরে। তারা আলাদা দর প্রস্তাব দিয়েছে। তবে ঢাকায় বাজারভেদে চিনি বিক্রি হচ্ছে ৭২ থেকে ৭৫ টাকা দরে। এদিকে, কোম্পানিগুলোর প্রস্তাবিত দর এখনই কার্যকর হচ্ছে না। বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশন এ দর বিশ্লেষণ করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে একটি সুপারিশ করবে। মন্ত্রণালয় আরেক দফা পর্যালোচনার পর কোম্পানিগুলোকে সিদ্ধান্ত জানাবে। মন্ত্রণালয় থেকে আসছে সপ্তাহে সিদ্ধান্ত জানানো হতে পারে। এছাড়া ভোজ্যতেল ও চিনির দাম নিয়ে সম্প্রতি বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশনে (বিটিসি) ব্যবসায়ীদের নিয়ে একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ওই বৈঠকে মূল্যবৃদ্ধির এ প্রস্তাব দেয় কোম্পানিগুলো। তাদের দাবি, আন্তর্জাতিক বাজারে দুটি পণ্যের দামই বেড়েছে। দেশে না বাড়লে আমদানি কমে যাবে। ফলে সরবরাহে ঘাটতি তৈরি হওয়ার আশঙ্কা থাকে। ট্যারিফ কমিশনে কোম্পানিগুলো প্রস্তাব দিয়েছে ভোজ্যতেল মিল মালিক সমিতি ও চিনিকল মালিক সমিতির মাধ্যমে। সয়াবিন তেল নিয়ে দেয়া প্রস্তাবে অপরিশোধিত সয়াবিন তেল আমদানিতে চট্টগ্রাম বন্দরে বিল অব এন্ট্রি বা প্রত্যয়ন মূল্য দেখানো হয়েছে টনপ্রতি ৭৯০ ডলার, ঋণপত্রের মূল্য দেখানো হয়েছে ৮৩৫ ডলার ও বুকিং মূল্য দেখানো হয়েছে ৮২৫ ডলার। এ তিন দর গড় করে প্রতি টনের মূল্য ধরা হয়েছে ৮১৭ ডলার। ব্যবসায়ীদের হিসাবে, তাদের এক লিটার বোতলজাত তেলের উৎপাদন খরচ ৯৫ টাকা ৭৬ পয়সা। তারা এ দর ৯৫ টাকা করার প্রস্তাব দিয়েছেন। এর সঙ্গে পরিবেশক ও খুচরা ব্যবসায়ীর কমিশন ৮ টাকা ধরে খুচরা বাজারদর ধরা হয়েছে ১০৩ টাকা। বর্তমানে ঢাকার বাজারে সিটি গ্রুপ, মেঘনা গ্রুপসহ বিভিন্ন কোম্পানি প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেল ৯৪ থেকে ৯৫ টাকা দরে বিক্রি করছে। বাংলাদেশ এডিবল অয়েলের সয়াবিন তেলের দর লিটারপ্রতি ৯৮ টাকা। বাংলাদেশ এডিবল অয়েলের তেলের দাম অন্যদের থেকে লিটারে ৩ টাকা বেশি। সিটি গ্রুপের বিশ্বজিৎ সাহা জানান, এ দর সমিতির মাধ্যমে প্রস্তাব করা হয়েছে। এর চেয়ে বেশি দামে কোন কোম্পানি বিক্রি করতে পারবে না। এদিকে, পাঁচ দিনের ব্যবধানে রাজধানীর পাইকারি বাজারে প্রতি মণ চিনির দাম বেড়েছে ১৫০ টাকা। রাজধানীর পুরান ঢাকার মৌলভীবাজারের চিনি পরিবেশকরা জানিয়েছেন, গত শনিবার তাদের বাজারে প্রতি মণ (৩৭ কেজি ৩২০ গ্রাম) চিনির মূল্য ছিল ২ হাজার ৩০০ টাকা। এ হিসাবে প্রতি কেজির দাম পড়ে ৬১ টাকা ৬৩ পয়সা। কিন্তু গত বৃহস্পতিবার তা বিক্রি হয়েছে ২ হাজার ৪৫০ টাকায়। এ হিসাবে কেজিপ্রতি দাম পড়েছে ৬৫ টাকা ৬৫ পয়সা। পাঁচ দিনের ব্যবধানে কেজিতে দাম বেড়েছে ৪ টাকা। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বৃদ্ধির বিষয়টি সামনে এনে দেশের মিল মালিক, পরিবেশক, পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ের ব্যবসায়ীরা চিনির দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন। শুধু তাই নয়, দাম বাড়ানোর জন্য সরকারকে তারা নানাভাবে চাপে রাখছেন। কিন্তু দাম কমে গেলে নানা অজুহাতে পণ্যটি তারা চড়াদামেই বিক্রি করেন। এতে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোও নীরব ভূমিকা পালন করে। এ প্রসঙ্গে মৌলভীবাজারের চিনি ব্যবসায়ী হাজী মোহাম্মদ আলী ভুট্টো জনকণ্ঠকে বলেন, এখন আন্তর্জাতিক বাজারে চিনির দাম বাড়তির দিকে রয়েছে। আর তাই দেশেও দাম বেড়ে যাচ্ছে।
×