ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ধারাবাহিক অভিযান অব্যাহত রাখতে হবে

আগের যে কোন সময়ের চেয়ে জঙ্গীঝুঁকি কমেছে

প্রকাশিত: ০৬:১৪, ১ অক্টোবর ২০১৬

আগের যে কোন  সময়ের চেয়ে  জঙ্গীঝুঁকি কমেছে

গাফফার খান চৌধুরী ॥ জঙ্গীবাদের ঝুঁকি থেকে বাংলাদেশ আংশিক মুক্ত হয়েছে। পুরোপুরি মুক্ত হতে পারেনি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশ থেকে জঙ্গীবাদ পুরোপুরি নিমর্ূূল করতে অন্তত আরও দশ বছর লাগবে। টানা দশ বছর সাঁড়াশি অভিযান চললে দেশ প্রায় শতভাগ জঙ্গীবাদের ঝুঁকি থেকে মুক্ত হবে বলে আশা করা যাচ্ছে। তবে ক্ষমতার পটপরিবর্তন হলে দেশে জঙ্গীবাদ আগের যে কোন সময়ের চেয়ে বেশি মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোও সার্বিক পরিস্থিতি বিচার-বিশ্লেষণ করে এমনটাই ধারণা করছে। ইতিহাস বলছে, আফগান যুদ্ধ থেকেই মূলত বাংলাদেশে জঙ্গীবাদের সাংগঠনিক গোড়াপত্তন হয়েছে। বাংলাদেশ থেকে প্রায় তেরো হাজার ব্যক্তি আফগান যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল; যাদের অনেকেই এখন মৃত। তারপরও জীবিত থাকা আফগান ফেরত যোদ্ধার সংখ্যা অন্তত দশ হাজার। যদিও তারা নানামতে, নানাদলে, উপদলে বিভক্ত। আফগান যুদ্ধে অংশ নেয়াদের শতকরা ৯৫ ভাগই জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতিতে বিশ্বাসী। যে পাঁচভাগ অন্য মতাদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন তারাও আফগান যুদ্ধ শেষে দেশে ফেরার পর বাংলাদেশে ইসলামী শরীয়াহ্ আইন কার্যকর করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। তারাও ইসলামী শাসন ব্যবস্থা কায়েমের স্বপ্ন নিয়ে পরবর্তীতে জামায়াতে ইসলামের রাজনীতিতে যোগ দেন। সব মিলিয়ে আফগান ফেরত যোদ্ধার শতভাগই জামায়াতে ইসলামীর রাজনৈতিক আদর্শে বিশ্বাসী। আফগান ফেরত যোদ্ধাদের একটি অংশ বাংলাদেশে আহলে হাদিস আন্দোলনের মাধ্যমে ইসলামী শাসন কায়েমের পক্ষে কাজ করা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবী বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. আসাদুল্লাহ আল গালিবের সঙ্গে যোগ দেন। ওই শিক্ষকের স্বপ্ন বাংলাদেশে একদিন খেলাফত কায়েম হবে। তিনি চাচ্ছিলেন মানুষের মধ্যে ইসলামকে জাগ্রত করতে। পরবর্তীতে সেই জনতার চাপের মুখে এক সময় সরকার দেশে ইসলামী শাসন ব্যবস্থা কায়েম করতে বাধ্য হবে। কিন্তু অধ্যাপক গালিবের সঙ্গে থাকা আফগান যোদ্ধাদের দাবি, সশস্ত্র বিপ্লব ব্যতীত দেশে ইসলামী শাসনব্যবস্থা কায়েম করা সম্ভব নয়। এমন মতপার্থক্যের কারণে পরবর্তীতে আহলে হাদিস আন্দোলন বিভক্ত হয়ে পড়ে। শায়খ আব্দুর রহমান, সিদ্দিকুল ইসলাম বাংলা ভাইসহ ফাঁসিতে মৃত্যু হওয়া শীর্ষ ছয় জঙ্গী ও হুজি নেতা মুফতি হান্নান আহলে হাদিস আন্দোলনের নামে গড়ে ওঠা তাওহিদী ট্রাস্টের অর্ধেক প্রায় চার শ’ কোটি টাকার ভাগ নিয়ে বেরিয়ে যান। এর পর থেকেই দেশে হুজি ও জেএমবির মতো জঙ্গী সংগঠনের জন্ম হয়। পরবর্তীতে জেএমবি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ চলে যায় জামায়াতে ইসলামীর হাতে। গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, হুজির কার্যক্রম এখনও সচল। তবে খুবই স্বল্প পরিসরে। হুজি বর্তমানে জেএমবির সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে কাজ করছে। হুজি এবং জেএমবির প্রশিক্ষিত সদস্যরাই মারাত্মক অস্ত্র, গোলারুদ তৈরিতে সক্ষম। পরবর্তীতে এই দুটি জঙ্গী সংগঠনের মাধ্যমেই দেশে জঙ্গীবাদের বিস্তার ঘটে। জেএমবি নিষিদ্ধ হওয়ার পর নব্য জেএমবি, হিযবুত তাহরীর নিষিদ্ধ হওয়ার পর আনসারুল্লাহ বাংলাটিম নিষিদ্ধ হওয়ার পর আনসার আল ইসলামের নামে জঙ্গী কর্মকা- চালাচ্ছে। হালে নব্য জেএমবি ও আনসার আল ইসলামের তৎপরতা সবচেয়ে বেশি। ধারাবাহিক সাঁড়াশি অভিযানের মুখে জঙ্গীদের তৎপরতা কমে গেলেও শেষ হয়ে যায়নি। পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট সূত্র বলছে, দেশে আধুনিক জঙ্গীবাদের ধারা চালু হয় হিযবুত তাহরীরের মাধ্যমে। উচ্চবিত্ত পরিবারের উচ্চশিক্ষিত এমনকি ইংরেজী মাধ্যমে পড়ালেখা করা ছেলেমেয়েকে জঙ্গীবাদের দিকে আকৃষ্ট করতে সক্ষম হয় হিযবুত তাহরীর। হিযবুত তাহরীর নিষিদ্ধ হওয়ার পর তারা আনসারুল্লাহ বাংলাটিম নামে তৎপরতা শুরু করে। তারা চার থেকে পাঁচ সদস্যদের নিয়ে একেকটি সিøপার সেল তৈরি করে। প্রতিটি সিøপার সেলই একেকটি আত্মঘাতী স্কোয়াড। প্রায় একই সময় একই ধারায় চলে আসে নিষিদ্ধ জেএমবির একটি গ্রুপ। তারা নব্য জেএমবি নামে কার্যক্রম শুরু করে। তারাও বর্তমানে আনসারুল্লাহ বাংলাটিমের মতো সিøপার সেল পদ্ধতিতে কাজ করে যাচ্ছে। গত কয়েক বছরে আনসারুল্লাহ বাংলাটিমের সিøপার সেলের হাতে হত্যাকা-ের শিকার ব্লগার, লেখক, প্রকাশকসহ এ ধরনের শ্রেণী-পেশার মানুষ। আর নব্য জেএমবির হাতে হত্যাকা-ের শিকার হিন্দু পুরোহিত, খ্রীস্টান ধর্মযাজকসহ অনেকেই। সর্বশেষ নব্য জেএমবি গুলশানের হলি আর্টিজানে দুই পুলিশ কর্মকর্তা, সতেরো বিদেশী ও তিন বাংলাদেশীকে জিম্মি করার পর নৃশংসভাবে হত্যা করে। এর পর জঙ্গী সংগঠনটি কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় দেশের বৃহত্তম ঈদ জামাতে হামলার চেষ্টা করে। বাধা পেয়ে দুই পুলিশকে হত্যা করে তারা। দেশে জঙ্গীবাদের বিস্তার ঘটানো থেকে শুরু করে অনেক কিছুর সঙ্গেই যুদ্ধাপরাধী ও জামায়াত-শিবিরের অনেক নেতার পাশাপাশি বিদেশী কতিপয় স্বার্থান্বেষী মহলের জড়িত থাকার যোগসূত্র পাওয়া গেছে। বাংলাদেশে জঙ্গীবাদের প্রেক্ষাপট সম্পর্কে বিশিষ্ট নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব) আব্দুর রশীদ জনকণ্ঠকে বলেন, বাংলাদেশ জঙ্গীবাদ থেকে পুরোপুরি ঝুঁকিমুক্ত হয়নি। তবে আগের যেকোন সময়ের চেয়ে ঝুঁকি কমে এসেছে। প্রাতিষ্ঠানিক নজরদারির পাশাপাশি সামাজিক ও পারিবারিক সচেতনতাই পারে বাংলাদেশকে জঙ্গীবাদের ঝুঁকি থেকে মুক্ত করতে। হালে অনেক খ্যাতিমান শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-শিক্ষার্থী জঙ্গীবাদের দিকে ঝুঁকছে। কেন তারা জঙ্গীবাদে ঝুঁকছে, কারা তাদের জঙ্গীবাদের দিকে ধাবিত করছে তা শনাক্ত করতে হবে। যে পদ্ধতিতে জঙ্গীবাদ ছড়ায় সেই পদ্ধতি সম্পর্কে শিক্ষক, শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে সমাজের প্রতিটি মানুষকে সচেতন করতে হবে। তাহলেই জঙ্গীবাদের তৎপরতা কমে আসবে। বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও জঙ্গীবাদের চর্চা হচ্ছে। সম্প্রতি মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরে জঙ্গী তৎপরতায় জড়িত থাকা বাংলাদেশীদের ধরে দেশে ফেরত পাঠানো হয়েছে। তারা কিভাবে জঙ্গীবাদে জড়িত হয়েছে, তা খুঁজে বের করা জরুরী। তিনি আরও বলছেন, জঙ্গীবাদ নির্মূলে ধারাবাহিক অভিযান অব্যাহত রাখতে হবে। জঙ্গী সংগঠনগুলোর একটি প্রচলিত নীতি রয়েছে, তা হচ্ছে তারা নতুন নতুন নামে সংগঠিত হয়। হালে নব্য জেএমবি আলোচনায় আসার পর তারা আবার নতুন কোন নামে সংগঠিত হচ্ছে কিনা সে বিষয়ে অনুসন্ধান অব্যাহত রাখা অত্যন্ত জরুরী। এই নিরাপত্তা বিশ্লেষক আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেছেন, ক্ষমতার পটপরিবর্তন হলে বাংলাদেশে জঙ্গীবাদ ঘাঁটি গেড়ে বসবে। কারণ, বিএনপি-জামায়াত জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে তাদের অবস্থানের কথা বললেও কার্যত কোন্ পদ্ধতিতে তারা জঙ্গীবাদ দমন করবে, সে সম্পর্র্কে কোন ধারণা আজও জাতির সামনে তুলে ধরেনি। এছাড়া অতীতেও তাদের জঙ্গীবাদ দমনের তেমন কোন নজির লক্ষ্য করা যায়নি। বিএনপির সঙ্গে থাকা দলটির পাকিস্তানের সঙ্গে আগাগোড়াই সুসম্পর্র্ক। পাকিস্তান সারা পৃথিবীতে জঙ্গী রফতানিকারক দেশ হিসেবে পরিচিত। স্বাভাবিক কারণেই বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় গেলে বাংলাদেশে জঙ্গীবাদের বিস্তার ঘটবে। তাতে কোন সন্দেহ নেই। আর বাংলাদেশ অধিকমাত্রায় জঙ্গীবাদের ঝুঁকিপূর্ণ দেশ হিসেবে পৃথিবীতে বিবেচিত হবে।
×