পহেলা অক্টোবর আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবস। এবারের দিবসের প্রতিপাদ্য ‘প্রবীণদের প্রতি বৈষম্যের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান।’ জরা বা বার্ধক্য জীবনের এক চরম সত্য। শৈশবের সোনালি সকাল শেষ করে, তারুণ্য আর যৌবনের রোদেলা দুপুর পাড়ি দিয়ে, মাঝ বয়সের ব্যস্ত বিকেলটাও যখন চলে যায়, তখনই জীবন সায়াহ্নের গোধূলী বেলা হয়ে আসে বার্ধক্য। এই সময়টা আসলে মানব জীবনের শেষ অধ্যায়। নেহায়েত অকালমৃত্যু না হলে এই স্তরটিতে শেষ পর্যন্ত পদার্পণ করতেই হবে। বার্ধক্যকে এড়িয়ে চির তারুণ্যের সোনার হরিণ ধরার চেষ্টা মানব ইতিহাস জুড়েই হয়েছে, কিন্তু তার নাগাল পাওয়া যায়নি। বার্ধক্য তাই জীবনের নিয়তি।
বার্ধক্যজনিত স্বাভাবিক পরিবর্তন ছাড়াও বৃদ্ধদের শরীরে নানাবিধ রোগব্যাধিও দানা বাঁধে। শারীরিক পরিবর্তনের কারণে কিছু কিছু রোগ প্রকৃতিগত ভাবে বয়স্কদেরই হয়ে থাকে। যেমন তাদের রক্তনালী সরু হয়ে যায়। ফলে উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ, স্ট্রোক বা মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ ইত্যাদি হতে পারে। প্রবীণদের মস্তিষ্ক ছোট হয়ে আসে, মেডিকেল সাইন্সের ভাষায় বলে- ব্রেন এট্রফি। ফলে মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা ধীরে ধীরে কমতে থাকে। কেউ কেউ আলঝেইমারস ডিজিজ বা ডিমেনসিয়াতে আক্রান্ত হন। ফলে স্মৃতিশক্তি কমে যায়, আবেগ, অনুভূতি, বিচারবুদ্ধি, বিবেচনাশক্তি, চিন্তাক্ষমতা, কাজ করার ক্ষমতা ইত্যাদির পরিবর্তন ঘটে। আচার আচরণে অনেকটাই শিশুতে পরিণত হন। এক সময় খাওয়া দাওয়া ছেড়ে দেন, বিছানায় মলমূত্র ত্যাগ করেন। এছাড়াও মাথাঘোরা, হাত-পা কাঁপা যাকে বলে পার্কিনসন্স ডিজিজ ইত্যাদি নানা ধরনের মস্তিষ্কের রোগও প্রবীণদের মাঝে দেখা যায়। আবার মাথাঘুরে পড়ে গিয়ে অন্য নতুন সমস্যার সৃষ্টি হয়।
বয়সের সাথে সাথে হাড় ক্ষয়ে যায়, যাকে বলা হয়- অস্টিওপরোসিস। এতে শরীরের বিভিন্ন স্থানে ব্যথা বোধ করেন, মাঝে মাঝে সামান্য আঘাতেই হাড় ভেঙ্গে যায়। এছাড়া অস্টিওআর্থ্রাইটিসের কারণে অস্থিসন্ধিতে ব্যথা হয় যেমন হাঁটুতে ব্যথা, কোমরে ব্যথা এমনকি শরীর বেঁকে যায়। ফলে কার্যক্ষমতা আরও কমে যায়। হাঁটা চলায় প্রচ- অসুবিধা হয়। চোখে ছানি পড়াটাও বয়স্কদের রোগ। পুরুষদের ক্ষেত্রে প্রস্টেট গ্রন্থি বড় হয়ে প্রস্রাবের জটিলতা দেখা দিতে পারে। এতে মূত্র ধারণক্ষমতা কমে যায়, প্রস্রাব করতে বেশি সময় লাগে, চাপ দিয়ে প্রস্রাব করতে হয়। মলমূত্র ধরে রাখার ক্ষমতাও বয়সের সাথে সাথে হ্রাস পায়। পানি ও লবণের পরিমাণ ব্যাঘাত ঘটে, শীতে বা সামান্য ঠা-াতেই তাদের দেহ ঠা-া হয়ে পড়ে। শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। ফলে তাদের বিভিন্ন ধরনের ইনফেকশনে আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা থাকে, যেমন নিউমোনিয়া, যক্ষ্মা, চামড়ার ইনফেকশন ইত্যাদি। বিভিন্ন ধরনের ক্যান্সারও বয়স্কদের বেশি হয়।
শুধু শারীরিক রোগ ব্যাধিই নয়, প্রবীণদের সমস্যাটা আসলে বহুমাত্রিক। তারা মানসিক, পারিবারিক, সামাজিক এমনকি রাষ্ট্রীয়ভাবেও সমস্যায় জর্জরিত। আসলে একটা মানুষ যখন বার্ধক্যে উপনীত হয় তখন তার নিজের মধ্যেই কিছু কিছু জিনিস দানা বেঁধে ওঠে, যেমন শারীরিক অসামর্থ্য, অসহায়ত্ব, পরনির্ভরশীলতা, অদৃষ্টের উপর সমর্পণতা ও অতিরিক্ত সংবেদনশীলতা। এগুলোর কারণে মানসিক যন্ত্রণা থেকে শুরু করে নিজেকে অবাঞ্ছিত, পরিবারের বা সমাজের বোঝা মনে করেন। অনেক প্রবীণই বিষণœœতায় ভোগেন। অনেক সময় এমন অযৌক্তিক ও শিশুসুলভ আচরণ তাদের মধ্যে প্রকাশ পায় যাকে অনেকেই দ্বিতীয় শৈশব বলে মনে করেন।
বয়স্ক রোগী বৃদ্ধির কারণে পারিবারিক, স্বাস্থ্যগত, সামাজিক এমন কি রাষ্ট্রীয় সমস্যাও প্রবল আকার ধারণ করছে। পারিবারিকভাবে অনেক সময় প্রবীণরা অবহেলা অযতেœর শিকার হয়ে পরিবার থেকে দূরে সরে যাচ্ছেন বা পরিবারই তাকে ঠেলে দিচ্ছে দূরে। তার নিকটজন এমনকি ছেলেমেয়েও তাকে বোঝা মনে করছে। আবার অনেক প্রবীণ নিজেই কারও উপর বোঝা হয়ে থাকতে চাচ্ছেন না, বৃদ্ধাশ্রমে আশ্রয় নিচ্ছেন।
তাদের স্বাস্থ্যগত সমস্যার প্রধান কারণ হলো চিকিৎসা সুবিধার অভাব। তাদের জন্য চিকিৎসার সুযোগ সুবিধা অনেক জায়গায় নাই বা থাকলেও সীমিত, বিশেষ করে গ্রাম পর্যায়ে। তৃতীয় বিশ্বে অর্থনৈতিক অবস্থা খুবই খারাপ আর এর শিকার হন প্রবীণরা বিশেষ করে মহিলারা। আবার গ্রামের প্রবীণদের আর শহরের প্রবীণদের সমস্যা অনেকসময় ভিন্ন হয়। শহরে অনেক প্রবীণ সামাজিক এবং অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছল, কিন্তু মনস্তাত্ত্বিক সমস্যায় ভোগেন বেশি। নিঃসঙ্গতা বা পারিবারিক অবহেলা এ ক্ষেত্রে দায়ী। গ্রামের প্রবীণদের মধ্যে আর্থিক অসচ্ছলতা বেশি। ভূমিহীন অসচ্ছল গ্রামীণরাই আর্থিক দৈন্যে আরও বেশি ভোগেন। ফলে পরনির্ভরশীলতার কারণে খাওয়া দাওয়া থেকে শুরু করে স্বাস্থ্য সমস্যাটা গ্রাম পর্যায়ে অত্যন্ত জটিল।
প্রবীণ বা বয়স্ক ব্যক্তিরা সম্মানিত। তারা দ্বিতীয় শিশু। আমাদের মনে রাখা উচিত, আজ যারা প্রবীণ তারাও অতীতে তার পরিবার, সমাজ, দেশ ও জাতির কল্যাণে অনেকেই অনেক কিছু করে গেছেন। তাদের যেন কোন রকম অবহেলা করা না হয়। আমরা যারা নবীন তারা যেন ভুলে না যাই যে আমাদেরও একদিন এই অবস্থায় উপনীত হতে হবে। আজ যদি আমরা তাদের প্রতি অবহেলা করি, তাহলে আমাদেরও এই রকম অবহেলার শিকার হতো হবে। পৃথিবীর অনেক দেশেই প্রবীণরা অবহেলিত, উপেক্ষিত, সমাজে ও পরিবারে অনেকের কাছে বোঝাস্বরূপ। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে আমাদের সবার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া অবশ্য কর্তব্য।
* প্রথমে মনে রাখতে হবে প্রবীণ বয়োজ্যেষ্ঠরা আমাদের পরিবারেরই অংশ। পরিবারের অন্যান্য সদস্যের মতোই তার সাথে আচার আচরণ করতে হবে। আমাদের নৈতিক দায়িত্ব হওয়া উচিত সবসময় প্রবীণদের আদর যতœ দিয়ে শিশুদের ন্যায় প্রতিপালন করা। তাদের প্রতি মায়া মমতা, ভালবাসা ও শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা। কোন ক্রমেই তাদের মধ্যে যেন এই ধারণা না হয় যে তারা আমাদের জন্য একটি অতিরিক্ত বোঝা।
* পৃথিবীর অনেক দেশে প্রবীণদের জন্য বৃদ্ধনিবাস বা ওল্ড হোমের ব্যবস্থা আছে। প্রয়োজনে সেরকম ব্যবস্থা আমাদের দেশেও করতে হবে। তাই বলে অযতœ অবহেলায়, দায় এড়ানোর জন্য তাদের যেন এসব বৃদ্ধনিবাসে ঠেলে দেয়া না হয় সেদিকেও নজর রাখতে হবে।
* আমাদের দেশে শুধু সরকারী কর্মচারী চাকরি হতে অবসর নেয়ার পর সামান্য পরিমাণ পেনশন ভাতা পেয়ে থাকেন। প্রবীণ কি শুধু তারাই হবে? সরকারী চাকরির বাইরে যারা অন্য পেশায় আছেন বা ক্ষেতে খামারে কাজ করেন, তারা কি বৃদ্ধ হবেন না? এদের জন্যও এ ধরনের সুযোগ সুবিধা থাকা জরুরী। তা সরকারকে অবশ্যই ভেবে দেখা উচিত।
* পেনশন বা বয়স্ক ভাতা হিসেবে যে অর্থ দেয়া হয় তার পরিমাণটাও সম্মানজনক হওয়া উচিত, যাতে তারা খেয়ে পরে চলতে পারেন এবং পরনির্ভরশীল হতে না হয়।
* প্রবীণরা যাতে স্বল্পব্যয়ে উন্নত চিকিৎসা লাভ করতে পারেন সেজন্য পর্যাপ্ত হাসপাতালের ব্যবস্থা করতে হবে। সরকারী হাসপাতালে তাদের জন্য আলাদা বিছানা বরাদ্দ থাকা উচিত। বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষা এবং ওষুধ তাদের বিনামূল্যে বা অল্প দামে দেয়া উচিত। এছাড়া প্রবীণদের চিকিৎসার জন্য বড় বড় হাসপাতালে বিশেষায়িত বিভাগ খোলা উচিত।
* পরিবারের সদস্যদের বা ছেলেমেয়েদের মনে রাখা উচিত, তারা যেন তাদের নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করার ব্যবস্থা গ্রহণ করেন।
* বিভিন্ন সামাজিক, পারিবারিক, ধর্মীয় এমনকি রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে যথাসম্ভব প্রবীণদের আমন্ত্রণ জানানো উচিত যাতে তারা নিজেদের অপ্রয়োজনীয় ও অবহেলিত মনে না করেন।
আমাদের প্রবীণদের জীবন যেন সত্যিকার অর্থেই হয় আনন্দের, শান্তিময়, মধুর স্মৃতিময়। তারা যেন নিজেদের অবহেলিত, পরিবারের ও সমাজের বোঝা মনে না করেন।
লেখক : ডিন, মেডিসিন অনুষদ
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়
আরো পড়ুন
শীর্ষ সংবাদ: