ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

পাকিস্তান-তুরস্কের মিল!

প্রকাশিত: ০৪:১৩, ১ অক্টোবর ২০১৬

পাকিস্তান-তুরস্কের মিল!

পশ্চিমী দেশের কয়েকটি সংস্থা ও ‘লবিস্ট ফার্ম’ বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধ বিচারের সমালোচনা করে আসছে। এদিকে পাকিস্তানের সঙ্গে যোগ দিয়েছে তুরস্ক। এই দুই দেশের মধ্যে একটি মিল লক্ষ্য করার মতো। পাকিস্তান যে নির্লজ্জতায় বাংলাদেশের মাটিতে ইতিহাস অস্বীকার করছে, তেমনি অটোমান টার্কদের হাতে আর্মেনীয় জনগোষ্ঠীর ওপর যে ভয়ঙ্কর গণহত্যা চালানো হয়, যা আধুনিক ইতিহাসের প্রথম গণহত্যা বলে স্বীকৃত, তারও দায়ভার অস্বীকার করেছে অটোমানদের উত্তরসূরি এরদোগানের সরকার। অটোমান সৈন্যদের হাতে সংঘটিত সেই গণহত্যায় ৮ লাখ বা তারও বেশি আর্মেনীয় নিহত হয়েছে। বিশ্বের ২৯টি রাষ্ট্র এই নির্বিচার গণহত্যাকে স্বীকৃতি দিয়েছে। পোপ ফ্রান্সিস একে ভয়াবহতম গণহত্যা বলে আখ্যায়িত করেছেন। চলতি বছরের জুনে জার্মানির পার্লামেন্ট বানস্টেক এক সর্বসম্মত প্রস্তাবে একে ‘ইতিহাসের কালো অধ্যায়’ বলে স্বীকৃতি দিয়েছে। নাজি বাহিনীর হাতে ইহুদী গণহত্যা ইতিহাসের একটি কালো অধ্যায়, নিঃসন্দেহে। কিন্তু ফারাকটা এই যে, তুরস্ক যেখানে বেমালুম আর্মেনীয় গণহত্যাকে অস্বীকার করে যাচ্ছে, জার্মানি সেখানে হিটলারÑনাজিদের হাতে ঘটা বর্বরতার দায় স্বীকার করে দুঃখ প্রকাশ করেছে এবং এই উপলব্ধির ওপর দাঁড়িয়েই আধুনিক জার্মানি গড়ে উঠেছে। পাকিস্তানের সঙ্গে তাল মিলিয়ে তুরস্ক বাংলাদেশের গণহত্যাকারীদের সমর্থনে কেন দাঁড়ালÑ তা বুঝতে খুব অসুবিধে হওয়ার কথা নয়। পাকিস্তানÑবাংলাদেশের যে জামায়াতে ইসলামী, তার সঙ্গে এরদোগানের ক্ষমতাসীন ‘জাস্টিস এ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি’ বা এপিকের আদর্শিক মিল আছে। এরপরও বলতে হবে তুরস্কের প্রতিক্রিয়া অবাঞ্ছিত ও নিন্দাযোগ্য। আরও একটি বড় দ্বিচারিতা লক্ষ্য করার মতো। এরদোগানের বিরুদ্ধে সম্প্রতি যে ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থান ঘটে তাতে শত শত মানুষকে প্রচলিত আইন ও মানবাধিকার লঙ্ঘন করে বিচার করা হচ্ছে অথচ সে দেশটিই কিনা আরেক দেশের মানবাধিকারের প্রশ্ন তুলছে! বাংলাদেশের মাটিতে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের মতোই ১৯১৫ সালের ২৪ এপ্রিল থেকে আর্মেনিয়ায় গণহত্যা শুরু করা হয়। অটোমান সৈন্যরা প্রথমত শত শত আর্মেনীয় বুদ্ধিজীবীকে নির্মমভাবে হত্যা করে। এরপর দুই পর্যায়ে এই ভয়ঙ্কর গণহত্যা কার্যকর করা হয়। লাখ লাখ শক্তসামর্থ্য মানুষকে বন্দী করে সিরিয়ার মরুভূমিতে নেয়া হয়। নারী ও শিশুদের ওপর চালানো হয় বর্বরতম নিপীড়ন। অটোমান খ্রীস্টান ও গ্রীক এসেরিয়ানদেরও একই পরিকল্পনায় হত্যা করা হয়। গ্রাম ও শহর ধ্বংস করা হয় একমাত্র ধর্মের কারণে। বিংশ শতাব্দীর নিষ্ঠুরতম গণহত্যা পাকিস্তান হানাদার বাহিনী ও তাদের দেশীয় অনুচররা বাংলাদেশের মাটিতে যে গণহত্যা চালিয়েছিল, তা বিংশ শতাব্দীর নিষ্ঠুরতম গণহত্যা। এর মূল লক্ষ্য ছিল বাঙালী জনগোষ্ঠীকে নিধন করা, কারণ তারা সামরিক স্বৈরতন্ত্র ও ধর্মতান্ত্রিক শোষণের বিরুদ্ধে নিজেদের আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারের দাবিতে সোচ্চার হয়েছিল। আট মাস ২ সপ্তাহ ৩ দিনের এই গণহত্যার স্বরূপ ছিল ভয়ঙ্কর। পরিকল্পিতভাবে তারা বাঙালী জনগোষ্ঠীকে হত্যা করেছে, গণহারে বাঙালী নারীদের ওপর পাশবিক নির্যাতন চালিয়েছে। পাকিস্তানী বাহিনীর সঙ্গে এসব বর্বরোচিত নিপীড়নে সহযোগী ছিল বাঙালী ও অবাঙালী সদস্য সমন্বয়ে গঠিত রাজাকার, আল বদর, আল শামস এবং শান্তি কমিটির সদস্যরা। একটি নিরস্ত্র জনগোষ্ঠীর ওপর এ ধরনের সামরিক অভিযানের ফলে জীবন বাঁচাতে লাখ লাখ মানুষ ঘরবাড়ি ছাড়তে বাধ্য হয়। ফলে সর্বমোট এক কোটি মানুষ উদ্বাস্তু হয়ে সীমান্তবর্তী ভারতীয় রাজ্যগুলোতে আশ্রয় নেয়। ‘টাইম ম্যাগাজিন’ এর এক রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে : ‘ওঃ রং ঃযব সড়ংঃ রহপৎবফরনষব, পধষপঁষধঃবফ ঃযরহম ংরহপব ঃযব ফধুং ড়ভ ঃযব ঘধুরং রহ চড়ষধহফ.’ নির্বিচার নারী নির্যাতনের একটি ঘটনার উল্লেখ করে ‘নিউইয়র্ক টাইমস’ এ গধষপড়ষস ড. ইৎড়হিব লিখেছেনÑ ৫৬৩ ড়িসবহ ঢ়রপশবফ ঁঢ় নু ঃযব ধৎসু রহ গধৎপয ধহফ অঢ়ৎরষ ধহফ যবষফ রহ সরষরঃধৎু নৎড়ঃযবষং ধৎব হড়ঃ নবরহম ৎবষবধংবফ নবপধঁংব ঃযবু ধৎব ঢ়ৎবমহধহঃ নবুড়হফ ঃযব ঢ়ড়রহঃ ধঃ যিরপয ধনড়ৎঃরড়হং ধৎব ঢ়ড়ংংরনষব. যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক কেবলেও পাকিস্তানী গণহত্যার বর্ণনা আছে। হাওয়াই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আর. জে. রুমেলের লিখেছেন : ঞযবংব “রিষষরহম বীবপঁঃরড়হবৎং” বিৎব ভঁবষবফ নু ধহ ধনরফরহম ধহঃর-ইবহমধষর ৎধপরংস.. ইবহমধষরং বিৎব ড়ভঃবহ পড়সঢ়ধৎবফ রিঃয সড়হশবুং ধহফ পযরপশবহং. ওহঃবৎহধঃরড়হধষ ঈড়সসরংংরড়হ ড়ভ ঔঁৎরংঃং (ওঈঔ) ১৯৭২ সালে রিপোর্ট দিয়েছে : ঃযব ‘যিড়ষব ড়ভ ঃযব সরষরঃধৎু ধপঃরড়হ ধহফ ৎবঢ়ৎবংংরাব সবধংঁৎবং ঃধশবহ নু ঃযব চধশরংঃধহর ধৎসু ধহফ ঃযবরৎ ধীঁরষরধৎু ভড়ৎপবং পড়হংঃরঃঁঃবফ মবহড়পরফব’ ঃযধঃ ধিং রহঃবহফবফ ঃড় ফবংঃৎড়ু ঃযব ইবহমধষর ঢ়বড়ঢ়ষব রহ যিড়ষব ড়ৎ রহ ঢ়ধৎঃৃ’ এমনকি মার্কিন সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি ভারতের শরণার্থী শিবিরগুলো ঘুরে স্বদেশে ফিরে এই গণহত্যার বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলেন। বাংলাদেশÑভারতের যৌথ বাহিনীর হাতে ৯৩,০০০ পাকিস্তানী সৈন্যের আত্মসমর্পণের পর মুজিবনগর মন্ত্রিসভা ২২ ডিসেম্বর ১৯৭১ ঢাকা ফিরে আসে। ঢাকায় ফিরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এএইচএম কামরুজ্জামান ২৪ ডিসেম্বর বলেন, “ধিৎ পৎরসরহধষং রিষষ হড়ঃ ংঁৎারাব ভৎড়স ঃযব যধহফং ড়ভ ষধ.ি “ ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর মধ্যে বৈঠক শেষে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে ভারতের সহযোগিতার কথা বলা হয়। পাকিস্তানের হামুদুর রহমান কমিশনের রিপোর্টেও গণহত্যা ও নারী নির্যাতনে দায়ী সেনা সদস্যদের বিচারের সুপারিশ করা হয়। বিবেকবান পাকিস্তানী নাগরিকগণওÑ যেমন মানবাধিকার নেত্রী আসমা জাহাঙ্গীর, সাবেক এয়ার ফোর্স প্রধান আসগর খান, স্বনামধন্য বুদ্ধিজীবী পারভেজ হুদভয়, সেলিমা হাসমিসহ অনেকেই বছরের পর বছর ধরে এই নৃশংসতার জন্য বাংলাদেশের কাছে ক্ষমা চাওয়ার দাবি জানিয়ে আসছেন। জুলফিকার আলী ভুট্টো ১৯৭১-এর ঘটনাবলীর জন্য ‘দুঃখ’ প্রকাশ করেছেন ১৯৭৪ সালে। ২০০২ সালে বাংলাদেশ সফরের সময় জেনারেল পারভেজ মোশাররফ ১৯৭১-এর “বীপবংংবং” জন্য ‘দুঃখ’ প্রকাশ করেছেন। শুধু ২০১৫ সালের ৩০ নবেম্বর প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফের সরকার প্রথমবারের মতো গণহত্যাকে অস্বীকার করার ধৃষ্টতা দেখিয়েছে। শুধু দেশীয় নয়, বাংলাদেশে যে ত্রিশ লাখ মানুষ নিহত হয়েছে তার প্রমাণ বিদেশের নথিপত্রেও আছে। ঘধঃরড়হধষ এবড়মৎধঢ়যরপ সধমধুরহব, ঊহপুপষড়ঢ়বফরধ অসবৎরপধহধ, ধহফ ঈড়সঢ়ঃড়হ’ং ঊহপুপষড়ঢ়বফরধ তে এই গণহত্যাকে বলা হয়েছে ধং ড়হব ড়ভ ঃযব ষধৎমবংঃ ভরাব মবহড়পরফবং রহ ঃযব ঃবিহঃরবঃয পবহঃঁৎু. ১৯৮১ সালে টঘ’ং ফবপষধৎধঃরড়হ ড়ভ টহরাবৎংধষ ঐঁসধহ জরমযঃং বলা হয়েছে; “অসড়হম ঃযব মবহড়পরফবং ড়ভ যঁসধহ যরংঃড়ৎু, ঃযব যরমযবংঃ হঁসনবৎ ড়ভ ঢ়বড়ঢ়ষব শরষষবফ রহ ষড়বিৎ ংঢ়ধহ ড়ভ ঃরসব রং রহ ইধহমষধফবংয রহ ১৯৭১. ..ঞযরং রং ঃযব যরমযবংঃ ফধরষু ধাবৎধমব রহ ঃযব যরংঃড়ৎু ড়ভ মবহড়পরফব’ং.” ত্রিপক্ষীয় চুক্তির পরিকল্পিত অপব্যাখ্যা যুদ্ধাপরাধ বিচারের সমালোচনায় পাকিস্তান ১৯৭৪ সালের ত্রিপক্ষীয় চুক্তির অপব্যাখ্যা করে আসছে। কারণ, সেদিনকার পরিস্থিতিতে পাকিস্তানী যুদ্ধবন্দীদের ‘ক্লিমেন্সি’ বা ক্ষমা করা হয়েছিল। ভারতÑবাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে স্বাক্ষরিত চুক্তিটি হয়েছিল যুদ্ধ পরবর্তীকালে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের স্বার্থে। এতে যেমন পাকিস্তানী যুদ্ধবন্দীদের ফেরত পাঠাতে বাংলাদেশ সম্মত হয়েছিল, তেমনি পাকিস্তানের মাটি থেকে প্রায় ৫ লাখ অবরুদ্ধ বাঙালীকে স্বদেশে পাঠানোর বিষয় ছিল। আরও ছিল আটকেপড়া পাকিস্তানীদের প্রত্যাবর্তন। কিন্তু পাকিস্তান সে শর্ত পূরণ করেনি। তারা ‘আটকেপড়া পাকিস্তানীদের’ ফেরত নেয়নি। এমনকি ১৯৫ যুদ্ধাপরাধীর যে বিচার তারাই সম্পন্ন করবে বলে কথা দিয়েছিলÑ সেটিও তারা করেনি। অন্যদিকে এই চুক্তিতে কোথাও বলা হয়নি যে বাংলাদেশের নাগরিকÑ রাজাকার, আলবদর, আল শামসদেরÑ মানবতাবিরোধী অপরাধের কারণে বিচার করা যাবে না। পাকিস্তানের মনে রাখা উচিত যে, যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে যাদের বিচার হয়েছে তারা কেউ পাকিস্তানের নাগরিক নয়। উপসংহার কেবল যুদ্ধাপরাধ বিচারের বিরোধিতাই নয়, বিগত দুই বছরে তিন পাকিস্তানী কূটনীতিককে বাংলাদেশ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে জঙ্গীবাদে অর্থ যোগান দেয়া ও বাংলাদেশবিরোধী তৎপরতায় যুক্ত থাকার অভিযোগে। কাজেই বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে পাকিস্তানী হস্তক্ষেপের বিষয়টি সতর্কতার সঙ্গে পর্যালোচনার দাবি রাখে। মানব ইতিহাসের অনেক ট্র্যাজেডি আছে, যা পরিবর্তনযোগ্য নয়। কাজেই ইতিহাসের সত্যকে অস্বীকার করে নয় বরং তাকে স্বীকার করেই সভ্য সহাবস্থানের ভিত তৈরি করতে হয়। আধুনিক জার্মানি গড়ে উঠেছে সেই সত্যকে স্বীকার করেই। জাপানীরা তাদের অতীতের ভুল স্বীকার করেছে, ক্ষমা চেয়েছে। স্বীকার করেনি বা ক্ষমা চায়নি শুধু পাকিস্তান এবং তুরস্ক। যতদিন পাকিস্তান ইতিহাস অস্বীকার করে যাবে, যতদিন দেশটি বাংলাদেশের গণমানুষের কাছে ক্ষমা না চাইবে, ততদিন পিছিয়ে যাবে দুই দেশের সম্পর্ক। এই প্রক্রিয়া সভ্য দুনিয়া থেকে পাকিস্তানকে আরও বিচ্ছিন্ন করবে, আজ যতটা তার চাইতেও অনেক বেশি। লেখক : মুক্তিযোদ্ধা
×