ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

লেখালেখির হাতেখড়ি দেয়ালিকা

প্রকাশিত: ০৪:০২, ১ অক্টোবর ২০১৬

লেখালেখির হাতেখড়ি দেয়ালিকা

দেয়ালে দেয়ালে/মনের খেয়ালে/লিখে যাই কত কথা/আমি যে বেকার/পেয়েছি লেখার স্বাধীনতা...। শিশু বয়সে কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য এভাবেই দেয়ালের ওপর কয়লার আঁচড় কেটে নিজের সৃজনশীল প্রতিভার প্রকাশ ঘটিয়েছিলেন। আর তা দেখে কমরেড মোজাফফর আহমেদ তার হাতে খাতা আর পেন্সিল তুলে দিয়ে বলেছিলেনÑ তার মনের কথাগুলো যেন খাতায় লিখে রাখে। এভাবেই শুরু করেছিলেন কবি সুকান্ত। দেয়ালকে ঘিরে যার লেখালেখির শুরুÑ তার লেখা একদিন অবাক করে দিয়েছিল বাংলা ভাষা-ভাষীদের। শুধু সুকান্তই নন, সাহিত্য জগতে প্রতিষ্ঠিত অগণিত শিল্পী, কবি-সাহিত্যকের আবির্ভাব ঘটেছে এই ‘দেয়ালকে’ আশ্রয় করে। সরাসরি দেয়াল অথবা দেয়ালের ওপর স্থাপিত কাগজ বা অন্য কোন বস্তুর ওপর লিখে চিন্তা ও মত প্রকাশের কৌশল অতি প্রাচীন। কম্পিউটার তো অনেক পরের কথা, মুদ্রণ যন্ত্র বা টাইপ রাইটার আবিষ্কারের আগেও হাতে লেখা নান্দনিক সাহিত্যপত্র প্রকাশের প্রচলন ছিল। কালক্রমে লেখালেখির প্রক্রিয়াগুলোই ‘দেয়াল পত্রিকা’র রূপ ধারণ করে। বলা যায়Ñ ‘দেয়াল’ এর মতো করে অবয়ব নির্মাণ করা হয় বলেই এ ধরনের পত্রিকাকে ‘দেয়াল পত্রিকা’ বা ‘দেয়ালিকা’ বলে। অর্থাৎ এটি অনেক আগে থেকে চর্চিত শিল্প মাধ্যম। দিনে দিনে এর ব্যাপ্তি বা ধরন-ধারণ পাল্টেছে। এটি শিশু-কিশোরদের সৃজনশীল প্রতিভা বিকাশ, মুক্তবুদ্ধি ও সাহিত্য চর্চা, ভাবের আদান-প্রদান এবং মনোবিকাশের এক অনন্য মাধ্যম। ভবিষ্যতে লেখক, চিন্তাবিদ হিসেবে গড়ে ওঠার ক্ষেত্র হিসেবে দেয়াল পত্রিকা অনেকটা বীজতলার মতো। আগেকার দিনে দেয়াল পত্রিকার প্রচলন ছিল সর্বব্যাপী। নিভৃত গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শুরু করে শহরের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ, এমনকি ক্লাব, শিশু-কিশোর সংগঠন ও সাহিত্য-সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানও মাসিক, ত্রৈমাসিক, ষান্মাসিক, বাৎসরিক বা ঋতুভিত্তিক দেয়াল পত্রিকা প্রকাশ করেছে। সাধারণত শিশু-কিশোররাই হয়েছে এর সম্পাদক, প্রকাশক বা লেখক-প্রদায়ক। তবে বড়রাও এর সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকতেন। তারা নেপথ্যে থেকে পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিশেষ দিন বা উৎসবকে কেন্দ্র করে উদ্যোক্তা বা প্রকাশকদের মাঝে দেয়াল পত্রিকা প্রকাশের প্রতিযোগিতা হয়েছে। দিনে দিনে পড়ার চাপ বৃদ্ধি, কোচিং ও প্রাইভেট নির্ভর ফলাফলমুখী শিক্ষা ব্যবস্থার প্রচলন, প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ, ভার্চুয়াল জগতের প্রসার এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অস্থিরতা বৃদ্ধিসহ নানা কারণে এসব সৃজনশীল চর্চার পথ এখন অনেকটাই রুদ্ধ। এরপরও দেয়াল পত্রিকা একেবারে হারিয়ে যায়নি। কালেভদ্রে এখনও এর চর্চা লক্ষ্য করা যায়। এদিকে প্রযুক্তির উৎকর্ষের সঙ্গে তাল মিলিয়ে দেয়াল পত্রিকায় নানা পরিবর্তনও এসেছে। এক সময় তা তৈরি করা হয়েছে কাঠের তৈরি ফ্রেম আর কাগজ দিয়ে। এখন যুক্ত হচ্ছে নানা শিল্প মহিমা। বিশেষ করে পত্রিকার অবয়বকে আকর্ষণীয়, নান্দনিক এবং ঐতিহ্যময় করে তুলতে বর্তমান সময়ে কলাপাতা, পাটি, কুলা, চালনি, ডালা, চট, শোলা, শক্ত কাগজ, কাপড়, কাঁথা, বেলুন, পাতা, মাটির হাঁড়ি পাতিল, কলসি, ধাতব পাত, কাঠ প্রভৃতি জিনিসও ব্যবহার করা হচ্ছে। দেয়াল পত্রিকা এখন আর শুধু দেয়ালে আবদ্ধ নেই। দেয়ালকে ছাপিয়ে তা চলে এসেছে দেয়ালহীন আঙ্গিনায়, শ্রেণী কক্ষের বোর্ডে, জাদুঘরের গ্যালারিতে- এমনকি ডিজিটাল মনিটরেও। বিষয়গত দিক দিয়ে দেয়াল পত্রিকা বেশ বৈচিত্র্যময়। কবিতা, ছড়া, গল্প, স্মৃতিচারণ, ইতিহাস, ঐতিহ্য, সামাজিক-সাংস্কৃতিক ভাবনাÑ সবই প্রকাশ করা হয় এতে। শহীদ দিবস, বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবস, পয়লা বৈশাখ, পয়লা বসন্তসহ বিভিন্ন জাতীয় উৎসবের দিনকে কেন্দ্র করে সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও শিশু-কিশোর সংগঠনের পাশাপাশি বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দেয়াল পত্রিকা প্রকাশ করে থাকে। প্রযুক্তির উৎকর্ষের কারণে হাতের লেখার পাশাপাশি দেয়ালিকায় এখন কম্পিউটারের ব্যবহারও লক্ষ্য করা যায়। উল্লেখ করা দরকার, সৃজনশীল প্রতিভা বিকাশের পাশাপাশি ঐতিহাসিক আন্দোলন-সংগ্রামেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে দেয়াল পত্রিকা। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ ও স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে দেয়াল পত্রিকার প্রতিবাদী ভূমিকার কথা অনেকেরই জানা। সাম্প্রতিক কালের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে আন্দোলনসহ জঙ্গীবিরোধী আন্দোলনেও সোচ্চার দেয়াল পত্রিকার কর্মীরা। এক কথায় দেয়াল পত্রিকা আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অন্যতম অনুষঙ্গ হিসেবে অনেক আগে থেকেই স্বীকৃত হয়ে আছে। আগের মতো চর্চা না থাকলেও ভাবের আদান প্রদান, শিল্প ভাবনার বিনিময়, বুদ্ধিভিত্তিক চর্চা এবং মনোবিকাশের মাধ্যম হিসেবে দেয়াল পত্রিকার কদর একেবারে হারিয়ে যায়নি, আজও তা সর্বজনবিদিত। আশার কথা, দেয়াল পত্রিকাকে ঘিরে এখন জাতীয় পর্যায়েও উৎসব হয়। জাতীয় দেয়াল পত্রিকা পরিষদ ২০০৮ সাল থেকে প্রতিবছর ঢাকায় জাতীয় দেয়াল পত্রিকা উৎসব করছে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সহযোগিতায় এ উৎসবে অংশ নিচ্ছে শত শত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। মফস্বল শহর নেত্রকোনা থেকেও প্রতি বছর চারটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এ উৎসবে অংশগ্রহণ করছে। এর মধ্যে নেত্রকোনা আদর্শ বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় ২০১৫ সালে ‘আত্মস্বর’ পত্রিকার জন্য চ্যাম্পিয়ন, ২০১৪ সালে ‘অন্তর্দীপ্ত’ পত্রিকার জন্য দ্বিতীয় রানার আপ এবং ২০১৩ সালে ‘নেত্রকোনার ইতিকথা’ পত্রিকার জন্য সেরা দশে আসন লাভ করে। এ ছাড়া জাহানারা স্মৃতি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, দত্ত উচ্চ বিদ্যালয় এবং রাজুর বাজার কলেজিয়েট উচ্চ বিদ্যালয়ও বিভিন্ন সময় সেরা দশে স্থান পায়। বিদ্যালয় নাট্য দলের (বিনাদ) আয়োজনে নেত্রকোনায় প্রতিবছর মাধ্যমিক বিদ্যালয় পর্যায়ে দেয়াল পত্রিকা প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। নেত্রকোনা সরকারী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সম্প্রতি জঙ্গীবাদ বিরোধী বিশাল দেয়ালিকা প্রকাশ করে প্রশংসা কুড়ায়। চ্যাম্পিয়ন পুরস্কার অর্জনকারী ‘আত্মস্বর’-এর সম্পাদক বর্ণ চন্দ এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘দেয়াল পত্রিকার মাধ্যমে একটি শিশু বা কিশোর-কিশোরীর সৃজনশীল প্রতিভার অঙ্কুরোদ্গম ঘটে। এর মধ্য দিয়ে তার চিন্তা-চেতনার পরিধি বিস্তৃত হয়। মনে নতুন ও ব্যতিক্রম কিছু করার স্পৃহা বা সাহস জাগে।’ জাতীয় দেয়াল পত্রিকা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মোতাহার আখন্দ বলেন, দেয়াল পত্রিকা নির্মিত হয় একদল শিশু বা কিশোর-কিশোরীর অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে। অংশগ্রহণমূলক এ প্রক্রিয়াটি তাদের পরমতসহিষ্ণু এবং গণতান্ত্রিক ভাবাপন্ন হতে শেখায়। পত্রিকা প্রশংসিত হলে তাদের উৎসাহ যেমন বাড়েÑ তেমনি সমালোচনা হলে তাদের মাঝে ‘আরও ভাল কিছু করার’ আগ্রহ সৃষ্টি হয়। এর মধ্য দিয়ে তারা ব্যবস্থাপনা এবং সম্পাদনার দক্ষতা অর্জন করতে পারে। এ ছাড়া পত্রিকা সম্পাদনা করতে গিয়ে তাদের মধ্যে নেতৃত্ব বিকশিত হয়। দেশ, কাল, সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি, ইতিহাস, ঐতিহ্য প্রভৃতি বিষয় নিয়ে ভাবনায় নিমগ্ন হয়। এক কথায়, দেয়াল পত্রিকা নির্মাণের মধ্য দিয়ে শিশু-কিশোরদের জীবন গঠনের বিশাল প্রশিক্ষণ বা শিখন প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। তাই শিশু-কিশোরদের সৃজনশীলতার পাশাপাশি তাদের মেধা ও মনন বিকাশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে বেশি বেশি দেয়াল পত্রিকা প্রকাশ করা প্রয়োজন। Ñসঞ্জয় সরকার, নেত্রকোনা থেকে
×