ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

আক্তারুজ্জামান সিনবাদ

প্রেমের দেবী

প্রকাশিত: ০৬:৪৯, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৬

প্রেমের দেবী

যুগে যুগে শিল্পীরা তাঁদের তুলির আঁচড়ে নারীর নগ্ন সৌন্দর্যকে ভিন্নভাবে উপস্থাপন করেছেন। ইতিহাস বলে নগ্ন চিত্রকর্মের শুরু প্রাচীন গ্রিসে। নারী কিংবা দেবীদের নগ্নচিত্র প্রাচীন যুগ থেকে বর্তমানেও চলে আসছে। শিল্পের নগ্নতা সম্পর্কিত দৃষ্টিভঙ্গি ও বিশ্বাস সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পাল্টেছে। নগ্ন চিত্রেও আছে শিল্প। আর তা প্রমাণ করেছেন খোদ শিল্পীরাই। তুলির আঁচড়ে মানুষগুলোকে প্রাণবন্ত ও মনোমুগ্ধকর করে ফুটিয়ে তোলা ছবিগুলো তাই আজও মানসপটে উজ্জ্বল। তুলির আঁচড়ে নারী শরীরের শৈল্পিক উপস্থাপনের জন্য চিত্রশিল্পী বত্তিচেল্লির পারদর্শিতা আজও স্মরণীয়। তারই আঁকা ভুবনখ্যাত নগ্ন ছবি ‘বার্থ অব ভেনাস’। যা সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ চিত্রকর্ম। ফ্লোরেন্সের উফিজি গ্যালারিতে পরম যতেœ সংরক্ষিত রয়েছে চিত্রকর্মটি। সৌন্দর্য ও প্রেমের অনবদ্য প্রতীক দেবী ভেনাস। চিত্রকর্মটি ক্যানভাসের ওপরে টেম্পেরায় করা। আকারে ৬৭.৯ ইঞ্চি বাই ১০৯.৬ ইঞ্চি। ১৪৮২ থেকে ১৪৮৫ সালের ভেতর আঁকা। বিখ্যাত হয়ে আছে পনের শতকের ইতালিয়ান আর্টের ল্যান্ডমার্ক হিসেবে। ছবিটির অন্তর্নিহিত অর্থ আর প্রাচীনতার রূপকসূত্র হিসেবে এর উপস্থাপনা ছবিটিকে পৃথিবীখ্যাত আর বহুল আলোচিত করে রেখেছে। প্রেমের দেবী ভেনাসের নাম শোনেননি এমন লোক খুঁজে পাওয়া ভার। গ্রীক পুরাণ মতে আমরা যাকে ‘আফ্রোদিতি’ বলেও জানি। সেই ভেনাসকেই চিত্রিত করা হয়েছে এখানে। নগ্ন দেবী উঠে আসছেন সাগরের বুকের গহন থেকে ঝিনুকের তরী বেয়ে ডাঙ্গায়, সদ্য ফোঁটা একজন তরুণী হিসেবে। তার দু’হাত লজ্জা ঢাকতে ব্যস্ত। তার বাঁ দিকে মৃদু বাতাস গোলাপের সুরভিতে রাঙিয়ে দিচ্ছে স্বর্ণালী কেশরাশি। মাথাটা মৃদভাবে ডানদিকে কাত করা। চোখে অপার বিষণœ দৃষ্টি। তার জন্ম বৃত্তান্তের সঙ্গে মিল রেখে এমন দৃশ্যপটের আবহ তৈরি করা হয়েছে। বত্তিচেল্লির যেমন স্বভাব, ছবির আকৃতিগুলোকে কখনই স্বাভাবিক বা ন্যাচারাল করে আঁকেন না, এখানেও তাই। ভেনাসের অঙ্গগুলোরও শারীরিক সামঞ্জস্য নেই এখানে। অপেক্ষাকৃত লম্বা বাঁকানো গ্রীবা। বুকের দিকটাও তাই। দাঁড়ানোর ভঙ্গিটিও স্বাভাবিক নয়। যদিও তার দাঁড়ানোর ভঙ্গিটিকে আঁকা হয়েছে বেঁকে থাকার ধ্রুপদী ভঙ্গিতে। যেখানে এক পায়ের ওপরে তার সব শারীরিক ভার ছেড়ে দেয়া হয়েছে। তার ওপর ভেনাসকে বত্তিচেল্লি ঝিনুকের এমন স্থানে দাঁড় করিয়েছেন যে কোন মুহূর্তে তা উল্টে যেতে পারে। ভেনাসের ডান দিকে আছেন বায়ুর দেবতা ‘জেফিরাস’ আর তার বক্ষলগ্ন হয়ে থাকা মৃদুমন্দ হাওয়ার প্রতীক ‘অরা’। বায়ুর দেবতা জোরালো ফুঁ দিয়ে ঝিনুকটিকে ডাঙ্গায় নিয়ে যাওয়ার চেষ্টায়রত। তারাও অর্ধনগ্ন। বাঁয়ে অপেক্ষমাণ রয়েছেন ঋতুর দেবী ‘হেরা’। প্রেমের দেবীকে বরণ করে নিতে তার হাতে রয়েছে ফুলাচ্ছাদিত বস্ত্র খ-। এই বস্ত্র খ- ভেনাসের নগ্নদেহকে আছাদন করার জন্য। এই আচ্ছাদন কি খুব জরুরী? বত্তিচেল্লি যেন এই প্রশ্ন করেছেন দর্শনার্থীদের। দৃশ্যপটে বাকি যা আছে মনে করা হয় তা নিছক সৌন্দর্য বাড়ানোর জন্যই। বেগুনি রঙে এসেছে গাছপালা। বেগুনি নাকি ভালবাসার রং, তাই। কারও কোন ছায়া আঁকেননি শিল্পী এখানে। তাই ধরে নেয়া যায়, এটা একটা স্বপ্নবিলাসী ছবি। ইতালিয়ান মেডিসি প্রাসাদের জন্য বত্তিচেল্লি এটি আঁকেন। মনে করা হয়, ভেনাসের মডেল হিসেবে মেডিসি প্রাসাদের সভাকক্ষের সুন্দরী শ্রেষ্ঠা জনপ্রিয় ‘সিমোনেত্তা কাত্তানিও ডি ভেসপুঁচি’ কে ব্যবহার করেছেন তিনি। মৃদুমন্দ হাওয়ার প্রতীক ‘অরা’ও কি ভেসপুঁচি? আদলটাও মিলে যায় ভেসপুঁচির আদলের সঙ্গে। আর এই ছবিতে কি অসাধারণ নমনীয়তার ছন্দে অরাকে এঁকেছেন তিনি। এটা কি ভেসপুঁচির প্রতি তাঁর গভীর গোপন অনুরাগের প্রকাশ? আর বায়ুর দেবতা কি বত্তিচেল্লি নিজে? কল্পনা করেছেন, প্রেমাষ্পদকে আঁকড়ে আছেন বুকে? রসিকজন এমনটা মনে করতেই পারেন। কারণ, ভেসপুঁচির অনেক অনেক পোট্রেট করেছেন বত্তিচেল্লি। একটুও অনুরাগ কি জন্মায়নি? রেনেসাঁ সময়কালের বিশেষজ্ঞ চিত্র ঐতিহাসিকরা কিন্তু তেমনটা মনে করেন না। অনেকের ধারণা, বত্তিচেল্লি এটা এঁকেছেন স্বর্গীয় ভালবাসার নিত্তপ্লেটনিক ধারণা থেকে, যেখানে ভালবাসা নগ্ন ভেনাসের রূপ ধরে বিরাজমান। আবার অনেকের ধারণা কবি এঞ্জেলো পলিজিয়ানের কবিতার আলোকে ছবিটি এঁকেছেন। আসলে বত্তিচেল্লি কি দেখে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন এর সঠিক জবাব নেই। রেনেসাঁ যুগে প্রাক্সিটিলিসের গড়া ভাস্কর্য ‘আফ্রোদাইত’-এর ভঙ্গিমার সঙ্গে বত্তিচেল্লির ছবির ভেনাসের অদ্ভুত মিল দেখে মনে হতে পারে বত্তিচেল্লির প্রেরণা এটাই।
×