ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

রেজাউদ্দিন স্টালিন

একুশ শতকের ইউলিসিস

প্রকাশিত: ০৬:৪৩, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৬

একুশ শতকের ইউলিসিস

আজ হক ভাই নেই। মনে পড়ছে অনেক স্মৃতি। তাঁর সেই বিখ্যাত করোটির স্বপ্নের মধ্যে শুধুই ছিল কবিতা। একজন মহৎ প্রাণ কবির জীবন আচরণ কেমন হওয়া উচিত হক ভাই তার দৃষ্টান্ত। আজ অনেক কথাই মনে পড়ছে- যশোর সাহিত্য সম্মেলন ১৯৮০ সাল। জেলা প্রশাসনের পৃষ্ঠপোষকত এই সম্মেলন। জেলা প্রশাসক আবদুল আউয়াল অর্থের যোগান দিলেন এবং মনোবলেরও। আমরা কয়েকজন তরুণ নবগঠিত যশোর সাহিত্য পরিষদের অন্যতম পৃষ্ঠপোষক প্রকৌশলী আবদুর রাজ্জাক এবং কবি আজীজুল হক আর সঙ্গে আছেন যশোর সিটি কলেজের অধ্যক্ষ লৎফর রহমান এবং সাংস্কৃতিক নেতা হারুন অর-রশীদ। দিনক্ষণ মনে নেই ঘটনা মনে আছে, স্মৃতি এখনও সবকিছু উজ্জ্বল মেলে ধরছে। টাউন হল মিলনায়তন। লোক ভর্তি। ঢাকা থেকে আগত সব বড় কবিরা মঞ্চে। কবিতা পাঠ শুরু হলো। একপর্যায়ে এলেন কথাশিল্পী রশীদ হায়দার। তিনি বললেন, জরুরি কাজে সব্যসাচী সৈয়দ শামসুল হক আসতে পারেননি। দুঃখ প্রকাশ করছি সেজন্য। আমি তার একটি কবিতা পড়ে শোনাচ্ছি- তিনি দরাজ কণ্ঠে পড়লেন- ঐ দরোজা বন্ধ ঐ জানালা বন্ধ-ঐ ঘর বন্ধ ঐ পাঠশালা বন্ধ ঐ গোয়ালন্দ বন্ধ- এক অদ্ভুত উচ্চারণ- এতো কিছু বন্ধ-কিন্তু কেন? অনেক পরে বুঝেছিলাম স্বৈরশাসনে হৃদয়ের কোন জানালা কি খোলা থাকতে পারে? ঐ প্রথম সৈয়দ হকের কবিতার সঙ্গে পরিচয়। এরপর পড়তে শুরু করেছি তাঁর লেখা, দেখতে শুরু করেছি তাঁর নাটক শুনতে শুরু করেছি তাঁর চমৎকার আবৃত্তি। তাঁর কবিতার ভাষা বুঝতেই আমার এত সময় লাগল। অর্থাৎ একজন কবিকে বুঝতে পাঠককেও তো তৈরি হতে হয়। গাছ থেকে পড়ে কেউ ভাল পাঠক হয় না। এরপর পড়েছি আর মুগ্ধ হয়েছি ‘পরাণের গহীন ভেতর’। অনেকের মুখে আবৃত্তি শুনেছি। কিন্তু মন ভরে না। নিজের কবিতা ভাল পড়েন বোধ করি সে রকম কবি বা আবৃত্তিকার হাতেগোনা হক ভাই তাঁর কবিতা পড়েন দুর্দান্ত। তাঁর অধিকাংশ কবিতাই আবৃত্তিযোগ্য। নাটকীয়তা তাঁর কবিতার একটা বড় চারিত্রলক্ষণ। গালিবকে নিয়ে তাঁর একটা কাব্যগ্রন্থ অসাধারণ মনে হয়েছে। আমি বইটা পড়ে শেষ করেছি। এর কয়েক দিনের মধ্যে আজীজ সুপার মার্কেটের নিচতলায় হঠাৎ হক ভাইয়ের সঙ্গে দেখা, বললাম গালিবকে নিয়ে কাব্যগ্রন্থটি আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো পড়েছি। তিনি বললেন, ওটা অনেক আগের। অনেকদিনের স্মৃতি মনে পড়ছে- আবার যশোর সাহিত্য সম্মেলন ১৯৮১। ঢাকার সব বাছাই কবিরা সম্মেলনে উপস্থিত। মঞ্চে শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, সৈয়দ শামসুল হক, আসাদ চৌধুরী, হেলাল হাফিজ, আজীজুল হক এ রকমই মনে পড়ছে এখন। হল ভর্তি লোক গমগম করছে। দু’একজন বক্তৃতা করেছেন। হঠাৎ তৎকালীন দৈনিক বাংলার যশোর সংবাদদাতা সিংহদা’ এসে হক ভাইয়ের কানেকানে বলে দিলেন- রাশিয়াতে হাসান হাফিজুর রহমান মারা গেছেন। বিবিসি বাংলা নিউজ। মুহূর্তে হক ভাই সোজা হয়ে দাঁড়ালেন। শামসুর রাহমানের কানেকানে কি যেন বললেন- তারপর মাইকে গিয়ে কেঁদে উঠলেন- হাসান, হাসান ভাই আমাদের মধ্যে নেই। তিনি বেশিক্ষণ বলতে পারলেন না। এরপর ত্রিদিব তারস্বরে কেঁদে উঠল। হাসান ভাই আমার পিতা-আমার পিতা। আল মাহমুদ এমন কথা বললেন যে- এখন লোক সম্মুখে কাঁদবার প্রয়োজন নেই বরং তাঁর আত্মার শান্তি কামনা করে সভা শুরু হোক। ভাঙা হাটে আর সম্মেলন জমল না। সকালে এলজিইডির বাংলোতে গেলাম। কবিদের নাস্তা ও অন্যান্য দেখভালের ব্যাপার আছে। তখন সকাল ৭টা হবে হালকা ঠা-া পড়ছে। শামসুর রাহমান বারান্দায় হাঁটছেন। হক ভাই বাইরে বেরিয়ে বললেন- রাহমান আপনি ভেতরে আসুন, ঠা-া লাগতে পারে। এ কথা মনে পড়ল অনেক দিন পর সৈয়দ শামসুল হকের লেখা ‘মহান সতীর্থ শামসুর রাহমান’ গ্রন্থটি পড়তে গিয়ে। কনকর্ড টাওয়ারের বইয়ের দোকানের প্রকৃতির কর্ণধার কবি সৈকত হাবীব এই বইটি আমার হাতে দিয়ে বললেন, বইটি পড়ুন ভাললাগাবে, ধন্যবাদ সৈকতকে। বইটি যখন আমি পড়তে শুরু করেছি তখন জানলাম হক ভাই অসুস্থ ল-নে চিকিৎসাধীন। একটা ছবি দেখলাম পত্রিকায়। ছবিটি দেখে মনে হলো হক ভাই আরও কিছুদিন বাঁচতে চান। তাঁর অবয়বে যেন সেই আকুতি, নাকি সেটা আমার চিন্তা জানি না। ‘মহান সতীর্থ শামসুর রাহমান’ গ্রন্থটিতে প্রথমেই স্থান পেয়েছে ‘শামসুর রাহমান, আপনার পঞ্চাশতম জন্মদিনে কবিতাটি। কবিতাটি আমি আগেও পড়েছি সম্ভবত সচিত্র সন্ধানীতে ছাপা হয়েছিল। এবার এই ১৯১৬ সালের শরতে ঠিক যে সময়ে প্রথম হক ভাইয়ের সবকিছু ‘বন্ধ’ হওয়া কবিতাটি শুনেছিলাম সেই শরতেই আবার পড়ে অভিভূত হচ্ছি শামসুর রাহমানকে নিয়ে লেখা কবিতাটি। কি গভীর ভালবেসেছেন তিনি বন্ধু শামসুর রাহমানকে আর কী অসীম কষ্ট পেয়েছেন। এখন এমন বন্ধুত্ব কবিদের মধ্যে পাওয়া বিরল ঘটনা। ভেরলেন আর র্যাঁবো, জ্যাক ক্যারুয়াক আর এলেন গিন্সবার্গ, শহীদ কাদরী আর আল মাহমুদ, সুনীল ও শক্তি- না কারোর সম্পর্কই হয়ত শেষ পর্যন্ত মধুর হয়নি কিংবা ধারাবাহিকতা থাকেনি। কিন্তু সৈয়দ হক আর শামসুর রাহমানের ধারাবাহিকতা অসাধারণ দৃষ্টান্ত। যে কবিতাটি হক ভাই তার প্রিয় বন্ধু শামসুর রাহমানকে নিয়ে লিখেছেন তা’ এক স্বল্পদৈর্ঘ্য মহাকাব্য। কাব্যশৈলী আর নান্দনিক তাৎপর্য, বক্তব্যের সমকালীনতায় কবিতাটি এখনও প্রাসঙ্গিক শুধু একজন রাহমান কিংবা সৈয়দ হক নন বাংলার প্রতিটি কবির জীবনে যেন কবিতাটির তাৎপর্য সত্য বলে মনে হচ্ছে স্বপ্ন আর শাণিত শব্দের ঠাসবুননিতে সৈয়দ হক তুলে ধরেছেন জীবন তৈরি হয়েছে এক অসামান্য নকশিকাঁথার- যার মধ্যে নীল হলুদ সাদা কালো সবুজ সুতোর তৈরি নদী, বৃক্ষ, পাখি, পতঙ্গ আর মানুষ আর শ্রমিক আর শাসক আর ঢাকা শহরের প্রতিটি রাস্তা ও রেস্তোরাঁ, সিনেমা হল আর হকার আর ফুটপাথ বেশ্যা ও বেকার আর কবি আর কবিতাÑ এবং এই বিষয়টাই তাড়িয়ে নিয়ে এলো এতদিন, এই তিনটি দশক সমস্ত কিছুই বদলে দিতে পারবো- এতোই বিশ্বাস করতাম আমরা এবং জানতাম যে পৌঁছুচ্ছি, আমরা পৌঁছুচ্ছি। তাই কেউ লক্ষ্মীবাহার থেকে শিংটোলা কমলাপুর, কেউবা মাউতটুলী থেকে বেরিয়ে এসে পরস্পরের হাত ধরে অবিরাম চষে ফেলেছি এই চায়ের কাপে নিয়েছি অমৃতের স্বাদ, চিক চিক করে উঠেছে ধুলোর কণা যেন আকাশের সমস্ত নক্ষত্র আমাদের চুলে এবং আমরা ছিনতাইকারীর চোখের ওপরেই নাচিয়ে নিয়ে বেড়িয়েছি বর্ণমালার আঙটি হা বন্ধু হা বাচ্চু হা শামসুর রাহমান হা কবি শেষ পর্যন্ত বেরিয়ে এলো একটি মরা প্রজাপতি আর কোনো কোনো বন্ধুরাই হরণ করলো আমাদের সেই আঙটি। সম্ভবত এই কবিতার ভাষ্য অনুযায়ী হক ভাই তখন প্যারিসে। সেখান থেকেই কবিতাটির উৎসারণ। কিন্তু বাংলাদেশ যেন স্তরে স্তরে সাজানো। গ্রামগঞ্জ নগর সভ্যতা আর তার অভ্যন্তরের কৃমিকীট এবং সৈয়দ শামসুল হক এক অভিজ্ঞতার কথা বলেন দীর্ঘ দুঃসাহসিক পরিভ্রমণÑ ইউলিসিস যেন তিনি এ যুগের। যেন আছেন দীর্ঘ প্রবাস থেকে দেশে ফেরার ব্যাকুলতায় ঘুরছেন নানা দ্বীপ আর বন্দর দেখছেন কত সম্রাজ্য আর তার ধ্বংসাবশেষ এবং উচ্চারণ করছেন নাভিমূল হতে-কীটের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে প্রজাপতি, এর চেয়ে বিস্ময়কর কিছু আর আমরা জানব না। কিন্তু আরও অনেক বিস্ময় অপেক্ষা করছে তার জন্য তাহলো তার প্রিয় বন্ধু শামসুর রাহমানের বিয়োগ। এই গ্রন্থেই সৈয়দ হক শেষ পর্বে লিখছেন যেন নিজেরই কথা স্বগত সংলাপের মতো- ‘জীবনতো চলবেই। বিমর্ষ বিষণœ হয়ে যে আছি তো আমার বন্ধুর জন্য যার সঙ্গে একসঙ্গে বেড়ে উঠেছি, কত রাজপথ হেঁটেছি। এই ঢাকা শহর চষে বেড়িয়েছি। কত জায়গায় আড্ডা দিয়েছি। আমি ভাবি আমার ভাই একজনতো চলে গিয়েছেন। বিষণœ হয়েছি শোকাহত হয়েছি। কিন্তু এ রকমতো নয়। এ রকমতো নয়। একি বন্ধন; এ কোন রক্ত? বন্ধুত্বের বন্ধন কবিতার বন্ধন এতদৃঢ় এত মজবুত এ হয়তো আত্মার রজ্জু যা অদৃশ্য-অচ্ছিন্ন। কারণ কবি জানেন মানবের স্বপ্নসমূহের রক্তাক্ত অনুবাদ হাজার বছরের। প্রাচীন কীর্তির কাঠের দরোজায় দাঁড়িয়ে তিনি হয়ত ভাবেন হাতের কাছেই পাবেন পাখি ফুল আর মাছ সমৃদ্ধ আচ্ছাদন। তিনি তা’ কল্পনার জাদু স্পর্শে পেয়ে যান হয়ত তা স্বপ্নে-স্বল্প সময়ের জন্য। হৃৎকলমের টানে তুলে আনেন জনমানবের বিপন্ন জীবন- বিপন্ন স্বপ্ন ও বন্দিশালার চিৎকার। সৈয়দ শামসুল হক নাট্যকার প্রাবন্ধিক ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, অনুবাদক, কলামিস্ট, নাট্যপরিচালক ও নির্দেশক, সঙ্গীত রচয়িতা আর এই জন্যই সব্যসাচী অভিধায় অভিষিক্ত তিনি। কিন্তু কেউ যদি তাঁকে কথাশিল্পী, ঔপন্যাসিক অভিধায় অবহিত করে তার চেয়ে তিনি বেশি খুশি হন কবি বললে। আসলে তিনি তো কবিই হতে চেয়েছেন আজীবন। শামসুর রাহমানের সমার্থক তিনি। দুই প্রধান কবি। রাহমান ভাই নেই আছেন হক ভাই এটুকই তো আমাদের সম্বল, এটুকুই তো বদ্বীপ বাংলাদেশের অহম। রোগশয্যার হিংস্র শৈলীর সামনে দাঁড়িয়ে শুশ্রƒষার হাত এখনও বাড়িয়ে দিচ্ছেন জরাগ্রস্ত বাংলার দিকে শামসুর রাহমানের জন্মদিন তো উপলক্ষমাত্র- তিনি যথার্থই বলছেন এবং সত্যিই তিনি অনবদ্য হয়ে উঠছেন তার উচ্চারণের ভেতর দিয়ে যদি বলি তাঁর বিখ্যাত কবিতাটির ভেতরে ‘আজ আমি আপনার জন্মদিনে বাড়িয়ে দিলাম আমার দক্ষিণবাহু এবং কোথাও না কোথাও কেউ স্বপ্ন দেখছে বলেই সঙ্গীতের একটি শুদ্ধস্বর বাদিত হচ্ছে অবিরাম, দীর্ঘ হোক আপনার জীবন, ত্বরান্বিত হোক স্বপ্নসমূহের অনুবাদ- হক ভাইয়ের স্বপ্ন ত্বরান্বিত হোক- তার উদ্দেশ্যেই নিবেদিত হোক তার বন্ধু রাহমানের জন্য লেখা কবিতার পঙ্ক্তি- রাতের আকাশব্যাপী নক্ষত্রের অক্ষরে অক্ষরে সেই পঙ্ক্তি জ্বল জ্বল করে। ‘কবির তো মৃত্যু নেই, মৃত্যু নেই মৃত্যুরও পর’। মনে পড়ছে ১৯১৪ সালে হক ভাই আর রাবেয়া খাতুনের জন্মদিন উদযাপিত হচ্ছে কথাশিল্পী ফরিদুর রেজা সাগরের নির্দেশনায়। আমীরুল ইসলাম আমন্ত্রণ জানিয়ে বললো-স্টালিন ভাই আপনাকে কিছু বলতে হবে। আমি হক ভাইকে উদ্দেশ্যে করে এই কবিতার চরণের মতোই অসীমত্ব বোঝাতে হাইনরিশ হাইনের একপত্রের উদাহরণ দিয়েছিলাম। হাইনরিশ হাইনে তার বন্ধুকে ভালবাসার গভীরতা বোঝাতে লিখেছিলেন আমি তোমাকে ভালবাসি চিরদিনের জন্য এমনকী তারপরেও। সেদিন হোটেল ওয়েস্টিনের লোক ভর্তি হলে লাউডস্পীকারে দাঁড়িয়ে হক ভাইয়ের জন্য যা উচ্চারণ করেছিলাম তার অনিবার্য পুনরাবৃত্তিই আমাকে স্বস্তি দেবে- সৈয়দ শামসুল হক, সৈয়দ হক, হক ভাই আমরা জানি- ভালবাসার ক্ষতই আপনার উচ্চারণের উৎস আর আমরা তো আপনাকে ভালবাসি চিরদিনের জন্য এমনকি তারপরেও।
×