ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

রেজওয়ানা আলী তনিমা

নির্ভীক সমাজকর্মী ও নারী নেত্রী কবি সুফিয়া কামাল

প্রকাশিত: ০৬:৩৯, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৬

নির্ভীক সমাজকর্মী ও নারী নেত্রী কবি সুফিয়া কামাল

‘প্রসন্ন প্রভাতে আজি যাত্রা শুরু কর হে কাফেলা! সম্মুখে অলোকদীপ্ত বেলা। দূর পথ প্রসারিত, দিকে দিকে চঞ্চল জীবন। আঁধার নির্মোক হতে কর উন্মোচন গতিময় দৃপ্ত প্রাণাবেগ, ভেদ করি সংশয়ের মেঘ চলো চলো যাত্রাপথে, সম্মুখে অনন্ত সম্ভাবনা!’ বাংলাসাহিত্য এমন চমৎকার পঙ্ক্তি যেমন যোগ করেছেন তেমনি নিজের জীবনেও এই বাণীকে ধারণ করে দেশ-জাতিকে এগিয়ে নিয়েছেন প্রেরণাদাত্রী সুফিয়া কামাল। কবি পরিচয় ছাপিয়ে তিনি নারীমূর্তি আন্দোলনের অন্যতম কা-ারিও। ১৯১১ সালে জন্মগ্রহণকারী এই মহীয়সী ছোটবলায় বাবা নিরুদ্দেশ হলে আশ্রয় পান নানাবাড়িতে। সেখানের ভাষা ছিল উর্দু। বাংলা শেখেন মায়ের কাছে। তাঁর পরিবারটি এতই রক্ষণশীল ছিল যে, স্কুল-কলেজ দূরে থাক, নিজের নামে পত্রিকা পর্যন্ত পাবার জো ছিল না। কে জানত এই পরিবেশে বড় হয়েই তিনি কবি ও সমাজ নেতৃত্বদের মধ্যে একটি বিশিষ্ট স্থান পাবেন? শুভানুধ্যায়ীদের প্রচেষ্টায় যৎসামান্য বইপত্রিকা হাতে পেয়ে বালিকা সুফিয়া বিদ্যা ও সাহিত্যপিপাসা মেটাতেন। উদারচিত্ত সৈয়দ নেহাল হোসেনের সঙ্গে বিয়ের পরে তিনি সাহিত্যানুকূল পরিবেশ পান। প্রথম লেখা ‘সৈনিক বধূ’ প্রকাশ পায় ও প্রশংসিত হয়। নারী সমাজের অনেক ‘প্রথম’ অর্জনকারী হিসেবে সুফিয়া কামাল স্মরণীয়। ১৯২৫ সালে প্রথম মুসলিম হিসেবে মাতৃমঙ্গল সংস্থায় যোগ দেন। ’২৮তে প্রথম বাঙালী মুসিলম নারী হিসেবে বিমানে উড্ডয়ন করেন। ’৩১ সালে হন ইন্ডিয়ান উইমেন্স ফেডারেশনের প্রথম মহিলা সদস্য। অকালে স্বামীর মৃত্যুতে তিনি শিক্ষকতা শুরু করেন ও দক্ষতারও পরিচয় দেন। তাঁর অদম্য উদ্যমের পরিচয় পাওয়া যায় যখন কামাল উদ্দিন খানের সঙ্গে পুনঃবিয়ের পরে ১৯৪০ সালে তাঁর পুত্রের জন্মবছরেই তিনি ব্রিটিশিবিরোধী আন্দোলনে জড়িত হন। বস্তুত তৎকালীন নারী ও সমাজের যে কোন উদ্যোগে কি দাঙ্গাদমন, কি সেবা, শিশুকল্যাণ অথবা সমাজ-রাজনৈতিক আন্দোলন, তাঁকে ছাড়া নেতৃত্বকারী আর কাউকে বিবেচনা করাই মুশকিল ছিল। পাকিস্তান আমলে পশ্চিম পাকিস্তানী শোষণের বিরুদ্ধে দেশে ক্ষোভ দানা বাঁধলে রাষ্ট্রপতি আইয়ূব খান বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে আলোচনার জন্য ঢাকায় আসেন। সুফিয়া কামালের সেই সময়ের অগ্রণী ভূমিকাটি অবিস্মরণীয়। তিনি রাষ্ট্রপতিকে বলেন, ‘আপনি সব শুনুন এবং এর একটা সমাধান করে দিয়ে যান।’ রাষ্ট্রপতি উদ্ধতভাবে বলেন, ‘ওদিকে তো সব মানুষ, এদিকে তো সব জানোয়ার।’ তেজস্বিনী সুফিয়া আইয়ূবের মুখের ওপর ধারালো উত্তর ছুড়ে দিলেন, ‘আপনি তো সেই জানোয়ারদেরই প্রেসিডেন্ট।’ এ রকম সৎসাহসী মানুষ সর্বকালে বিরল। সত্যিকারের দেশপ্রেমিক সুফিয়া পাকিস্তান সরকারের দেয়া ‘তঘমা-ই-ইমতিয়াজ’ তো বটেই, প্রত্যাখ্যান করেন মুক্তিযুদ্ধকালে সোভিয়েত ইউনিয়ন কর্তৃক আশ্রয় দেয়ার প্রস্তাবও। বরং নজরবন্দী হয়েও যোদ্ধাদের সহায়তা করেছেন, পরে যুদ্ধনির্যাতিতদের কল্যাণে ‘নারী পুনর্বাসন সংস্থা’র সভানেত্রীও হন। দেশের প্রয়োজনে সদাপ্রস্তুত তিনি অশীতিপর হয়েও নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে কার্ফুর মধ্যে মৌনমিছিলে নেতৃত্ব দিয়েছেন। কেয়ার কাটা, সাঁঝের মায়া ইত্যািদ গ্রন্থের রচয়িতা কবি সুফিয়া তাঁর কাজের স্বীকৃতি পেয়েছেন বাংলা একাডেমি, একুশে পদক, সোভিয়েত ইউনিয়ন কর্তৃক প্রদেয় ‘লেনিন পদক’সহ অসংখ্য পুরস্কার। ১৯৯৯ সালে এই অনন্য মানুষটি মৃত্যুবরণ করলে পুরো রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তাঁকে দাফন করা হয়।
×