ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

নাজনীন বেগম

আর কত রিশা, নিতু এবং সীমাকে নৃশংসতার বলি হতে হবে

প্রকাশিত: ০৬:৩৮, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৬

আর কত রিশা, নিতু এবং সীমাকে নৃশংসতার বলি হতে হবে

বাংলাদেশ আজ সমৃদ্ধির পথে ক্রমান্বয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। অর্থনৈতিক উন্নয়ন, সামাজিক-সাংস্কৃতিক অঙ্গনের অগ্রগতি সব মিলিয়ে দেশটি আজ বিশ্বের সামনে একটি অনুপম দৃষ্টান্ত। বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর নানাবিধ অগ্রযাত্রার প্রভাবে কোন দেশের কাক্সিক্ষত সফলতা অর্জন সম্ভব হয়। কোন দেশের জনসংখ্যার অর্ধাংশই নারী। নারীরাও উন্নয়নের ধারা থেকে বিচ্ছিন্নতা মোটেও বলা যাবে না। অর্থাৎ নারীরাও উন্নয়নের গতিধারাকে অবারিত করছে বললে মোটেও বেশি বলা হবে না। অর্থনীতি, রাষ্ট্র, সমাজ, রাজনীতি, সংস্কৃতি এমনকি সামরিক বাহিনীতেও নারীদের সফল পদচারণা বাংলাদেশের এক অভূতপূর্ব অর্জন। এর পরেও প্রশ্ন থেকেই যায় নারী স্বাধীনতা বিষয়টি কি কথার কথা? কিংবা নারীরা আজও কি আমাদের সমাজে নিরাপদ? নিরাপত্তাহীনতা পুরুষদের সেভাবে বিচলিত করে না যেভাবে সমস্যাটি নারীদের সামনে এসে দাঁড়ায়। ফলে আজও সমাজ প্রশ্নবিদ্ধ নারীরা কি সত্যিই নিরাপদ? তা না হলে সামান্য কারণে, ঠুনকো অজুহাতে কেন নারীদের এভাবে রক্তাক্ত নৃশংসতার শিকার হতে হয়? তনু এবং মিতু হত্যার বিচারিক কোন সুরাহা না হতেই আবারও ঘটে যায় কয়েকটি নির্মম তরুণী হত্যা। রাজধানীর উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুল এ্যান্ড কলেজের কিশোরী ছাত্রী সুরাইয়া আখতার রিশা বখাটে ওবায়দুলের এলোপাতাড়ি ছুরিকাঘাতে নির্মমভাবে আহত অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি হয়। পাঁচদিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে অবশেষে অন্তিম নিশ্বাসে তার জীবনের আলো চিরতরে নিঃশেষ হয়ে যায়। তার অপরাধ ঘাতক ওবায়দুলের প্রেমের প্রস্তাবে অসম্মতি জ্ঞাপন করা। ওবায়দুলের যেমন অধিকার আছে প্রেম নিবেদন করার একইভাবে রিশারও তো সেই স্বাধীনতা থাকা বাঞ্ছনীয় ‘না’ বলা। যা ধর্ম এবং সমাজ উভয় ক্ষেত্রেই অনুমোদন সাপেক্ষ রিশা শুধুমাত্র ওবায়দুলকে প্রত্যাখ্যান করেছে, কিন্তু তার বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ তোলেনি, বাবাকে পর্যন্ত জানায়নি। নীরবে, নিঃশ্বব্দে নিজের মতটুকু প্রকাশ করে স্বাধীনভাবে বাঁচতে চেয়েছিল। কিন্তু ঘাতক ওবায়দুলের নির্মম, নিষ্ঠুর জিঘাংসার বলি হতে হয় রিশাকে। জানি না এভাবে আর কত রিশাকে প্রাণ দিয়ে প্রমাণ করতে হবে নিজেদের ব্যাপারে তাদের মত প্রকাশেরও স্বাধীনতা নেই। এই পাশবিক হত্যাকা-ে সারা বাংলাদেশ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী জনগণের সহায়তায় ঘাতক ওবায়দুলকে আটকও করে। সে এখন বিচারাধীন। জনগণের প্রত্যাশা তনু আর মিতুর মতো এই হত্যাকা-েরও যেন দুঃখজনক পরিণতি না ঘটে। অভিযুক্ত ব্যক্তি যেন তার উপযুক্ত শাস্তি পায়। মাত্র ২৫ দিনের মাথায় আবারও ঘটে গেল আর এক নির্মম রক্তাক্ত ঘটনা। ১৮ সেপ্টেম্বর স্কুলছাত্রী নিতু ম-ল তার গৃহশিক্ষক মিলন ম-লের হাতে পাশবিক নির্যাতনে প্রাণ হারায়। এখানেও সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি। প্রেমে প্রত্যাখ্যাত হয়ে মিলন ম-ল অমানবিক উন্মাদনায় বেপরোয়া হয়ে ওঠে। নিজেকে মারধর করে সে, শেষ পর্যন্ত নৃশংস অত্যাচারে প্রাণটুকু কেড়ে নিতেও তার দ্বিধা হয়নি। এখানেও নিতুর একই অপরাধ মিলনকে তার অপছন্দ ছিল। একটি কিশোরী তরুণী তার মৌলিক অধিকারটুকুও প্রয়োগ করতে পারে না পছন্দ-অপছন্দের বেলায়। তাহলে কোথায় নারী স্বাধীনতা। কোন্ উপায়ে নারী মুক্তি আর অধিকার! নারীদের নিরাপত্তার বিষয়টি কি তাহলে আজও প্রশ্নবিদ্ধ। ঘাতক মিলন পালাতে গিয়েও ধরা পড়ল জনতার হাতে এবং তারা মিলনকে পুলিশে সোপর্দ করে। মিলনও স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়ে আজ বিচারের মুখোমুখি। সবাই আইনী ব্যবস্থায় আস্থা রেখে বিচার প্রক্রিয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। ইতোমধ্যে ঘটে আরও একটি নৃশংস ঘটনা। গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়া উপজেলায় ধর্ষণের শিকার সীমা নামে এক তরুণী। তার আপন চাচাত ভাই বিবাহিত ও দুই সন্তানের জনক পলাশ বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে সীমাকে ধর্ষণ করলে সীমার বাবা এ নির্যাতনের বিচার দাবি করেন। অভিযুক্ত পলাশ সালিশী রায় তো মানেইনি বরং পরের দিন আবারও সীমার ওপর পাশবিক নির্যাতন চালায়। এই অপমান আর জ্বালা সহ্য করতে না পেরে সীমা আত্মহত্যা করে। জানি না এভাবে আর কত সীমার জীবনপ্রদীপ নিভে যাবে অকথ্য অত্যাচার আর অপমানের জ্বালায়। বিচারহীনতার সংস্কৃতি যদি দিনের পর দিন চলতে থাকে তাহলে এ ধরনের নৃশংসতা বাড়বে বৈ কমবে না। শুধুমাত্র আইন আদালত কিংবা পুলিশী কার্যক্রম দিয়ে এ ধরনের পাশবিক নির্মমতাকে ঠেকানো যাবে না। প্রয়োজন জনসচেতনতার, নারীর প্রতি সম্মানবোধ সর্বোপরি প্রতিটি মানুষ সে নারী-পুরুষ যেই হোক না কেন তার যথার্থ অধিকার এবং স্বাধীনতা নিশ্চিত করা। আইন কিংবা শাসনে নয় ভেতরের বোধ থেকেই মানুষ হিসেবে মানুষের প্রতি মমতা ছোঁয়া না থাকলে অত্যাচার আর নির্যাতন থেকে কেউই রেহাই পাবে না। এরই মধ্যে আবারও খবর হলো স্ত্রী হত্যার মতো এক পাশবিক ঘটনা। গাজীপুর সদরের ওয়ার্ড কমিশনার সোলায়মান তার স্ত্রী টুম্পাকে পিটিয়ে ও শ্বাসরোধে হত্যা করে। স্ত্রীর অপরাধ, স্বামীর পরকীয়ায় বাধা দেয়া। নারীরা সমাজে যে কতভাবে লাঞ্ছিত আর অসম্মানিত হয় তার অনেক ইতিহাস তো অজানাই থেকে যায়। সেই মধ্যযুগীয় কায়দায় আজও নারীরা অপমান, নৃশংসতা আর অত্যাচারের বলি হয়। সামাজিক গণমাধ্যমে আরও একটি ঘটনা তীব্র ক্ষোভ আর অসন্তোষের ঝড় তোলে। ভারতের রাজধানী দিল্লীতে করুণা নামের এক তরুণীকে রাস্তায় সকাল নয়টায় প্রকাশ্য দিবালোকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। ঘাতক করুণার ওপর ৩০ বার ধারালো অস্ত্রের আঘাত হানে। তরুণীটিকে রক্ষা করার জন্য একজন লোকও এগিয়ে আসেনি। কিন্তু নির্বিঘেœ হত্যাযজ্ঞের পর ঘাতক যখন পালিয়ে যাচ্ছিল তখনই জনতার হাতে সে ধরা পড়ে। পরবর্তীতে পুলিশের হাতে খুনীকে তুলে দেয়া হয়। ততক্ষণে যা ঘটার সবই ঘটে যায়। জানি না এসব হত্যাকা-ের আদৌ কোন সুরাহা হবে কি না। ঘাতকরা তাদের যথাযথ শাস্তি পাবে কি না। নারীরা আদৌ কখনও তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারবে কিনা। সমাজ-সংসার নারীর প্রতি অধিকার আর সম্মান প্রদানে সক্রিয় হবে কিনা। সচেতন মানবিক মূল্যবোধে নারীরা তাদের ন্যায্য প্রাপ্তির কতটা অর্জন করতে পারবে সময়ই তার যথাযথ জবাব দেবে।
×