ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

সম্মেলনের উপযোগী পরিবেশ তৈরির চেষ্টা নেপালের

পারস্পরিক আস্থার অভাবে সার্কের ভবিষ্যত চরম অনিশ্চয়তায়

প্রকাশিত: ০৬:০৭, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৬

পারস্পরিক আস্থার অভাবে সার্কের ভবিষ্যত চরম অনিশ্চয়তায়

তৌহিদুর রহমান ॥ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে পারস্পরিক আস্থা না থাকার কারণে সার্কের ভবিষ্যত এখন চরম অনিশ্চয়তার মুখে। ১৯তম সার্ক শীর্ষ সম্মেলনে বাংলাদেশ, ভারত, আফগানিস্তান ও ভুটানের অংশ না নেয়ার ঘোষণায় দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম এই শীর্ষ সংস্থায় সংকট আরও ঘনীভূত হয়েছে। এই অবস্থায় সার্ক শীর্ষ সম্মেলনের উপযোগী পরিবেশ তৈরির জন্য সদস্য দেশগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ অব্যাহত রেখেছে নেপাল। ১৯৮৫ সালে সার্ক প্রতিষ্ঠার পর থেকেই দক্ষিণ এশিয়ার সাধারণ মানুষের স্বপ্ন ও আশা বাস্তবায়নের অঙ্গীকার করে সংস্থাটি। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে পারস্পরিক যোগাযোগ আরও বৃদ্ধি ও একে অপরের মধ্যে সহযোগিতা বাড়ানোই ছিল সার্কের অন্যতম উদ্দেশ্য। তবে বিভিন্ন সময়ে এই অঞ্চলের আঞ্চলিক রাজনীতির শিকার হয়েছে সার্ক। সে কারণে অনেকবারই সার্ক শীর্ষ সম্মেলন বাতিল হয়ে যায়। আবার বিভিন্ন সময়ে সার্কের নেয়া সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নও হয়নি। সূত্র জানায়, সার্ক শীর্ষ সম্মেলনে একাধিকবার জঙ্গী ও সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে জোরালো লড়াইয়ের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। সদস্য দেশগুলো একাধিকবার এ বিষয়ে তথ্য আদান-প্রদানে একমত হয়। তবে পাকিস্তানের পক্ষ থেকে বারবার অসহযোগিতা করা হয়। বিভিন্ন সময়ে সন্ত্রাস ও জঙ্গী প্রতিরোধে পাকিস্তানের কাছ থেকে সহযোগিতা পায়নি সার্কের অন্যান্য দেশ। দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে সার্ককে ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতো গড়ার দাবি জানানো হয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ায় একক ভিসা ও একক মুদ্রা চালুরও দাবি তোলা হয়। এ বিষয়ে একাধিকবার সার্ক শীর্ষ সম্মেলনে আলোচনাও হয়েছে। তবে এসব দাবি কখনোই বাস্তবায়ন হয়নি। ৩১ বছর ধরে সার্ক এই অঞ্চলের মানুষের স্বপ্ন পূরণ করতেও পারেনি। তারপরেও সার্ক শীর্ষ সম্মেলনে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর শীর্ষ নেতারা একে অপরের সঙ্গে আলোচনা করে থাকেন। সেখানে প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে বিভিন্ন সমস্যা সমাধানেও আলোচনা করা হয়। ফলে প্রতিবারই সার্ক শীর্ষ সম্মেলন ঘিরে নতুন আশার সঞ্চার হয়ে থাকে। তবে এবার সার্ক শীর্ষ সম্মেলন স্থগিত হওয়ায় সেসব সম্ভাবনার কোন আশা আর নেই। সার্কের গঠন কাঠামো অনুযায়ী সদস্য দেশগুলোর যে কোন একটি দেশ উপস্থিত না হলেই সার্ক শীর্ষ সম্মেলন বাতিল হয়ে যায়। এর আগে কারগিল যুদ্ধ এবং পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ অরাজকতার জেরে ১৯৯৯ থেকে ২০০২ সাল পর্যন্ত স্থগিত ছিল সার্ক শীর্ষ সম্মেলন। ২০০৪ সালের পর এই প্রথমবারের মতো পাকিস্তান সার্ক শীর্ষ সম্মেলনের আয়োজন করেছিল। তবে এবারের সার্ক শীর্ষ সম্মেলনও স্থগিত হয়ে গেছে। ভারত ও পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিরোধের কারণে সার্কের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য বাস্তবায়ন হচ্ছে না বলে অনেকেরই অভিযোগ রয়েছে। সার্ক শীর্ষ সম্মেলনে আগে বিভিন্ন সময়ে দুই দেশের অভ্যন্তরীণ বিরোধ সার্কের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। এবারো ১৯তম সার্ক শীর্ষ সম্মেলনের আগেই কাশ্মীর ও বেলুচিস্তান ইস্যুতে দুই দেশ বিরোধে জড়িয়ে পড়ে। আর বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধ ইস্যুতে বারবার নাক গলানোর কারণে ঢাকা-ইসলামাবাদের মধ্যে টানাপোড়েন চলে আসছিল। সেই টানাপোড়েনের প্রভাব পড়ে সার্কের ওপর। ইসলামাবাদে সার্ক শীর্ষ সম্মেলনে যোগদান না করার বিষয়ে ইতোমধ্যেই সার্কের চেয়ার নেপালকে জানিয়ে দিয়েছে চারটি দেশ। তবে সার্কের চেয়ার হিসেবে নেপাল সদস্য দেশগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ অব্যাহত রেখেছে। সার্ক শীর্ষ সম্মেলনের উপযোগী পরিবেশ তৈরির জন্য প্রতিটি দেশকেই নেপাল অনুরোধ করেছে। চার সদস্য দেশের বয়কটের কারণে সম্মেলনের উপযোগী পরিবেশ তৈরিতে এগিয়ে আসতে জোটের দেশগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়েছে সার্কের বর্তমান সভাপতি দেশ নেপাল। দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, বর্তমান চেয়ারম্যান হিসেবে নেপাল সরকার আকুল আবেদন জানাচ্ছে, সার্ক সনদের প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ থেকে জোটের সকল সদস্য দেশ যেন শীর্ষ সম্মেলনের পরিবেশ তৈরিতে সহযোগিতাপূর্ণ মনোভাব নিয়ে এগিয়ে আসে। এদিকে বৃহস্পতিবার দিল্লীতে ভারতীয় জনতা পার্টির মুখপাত্র নলিন কোহলি জানিয়েছেন, সন্ত্রাস ও সহযোগিতা একসঙ্গে চলতে পারে না। আর পাকিস্তান এই নীতিতেই চলছে। সেকারণে ইসলামাবাদে সার্ক শীর্ষ সম্মেলন বাতিল হয়ে যাওয়াটা আশ্চর্যের কোন বিষয় নয়। এটাই স্বাভাবিক। তিনি আরও বলেন, দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে পাকিস্তান নাক গলিয়ে আসছে। সে কারণে ইসলামাবাদের ওই সম্মেলনে কোন দেশই অংশগ্রহণ করতে আগ্রহী নয়। আগামী ৯-১০ নবেম্বর পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল সার্কের ১৯তম শীর্ষ সম্মেলন। কিন্তু বাংলাদেশ, ভারত, ভুটান ও আফগানিস্তান এ সম্মেলনে অংশ নিতে নিজেদের অপারগতার কথা আনুষ্ঠানিকভাবে চিঠি দিয়ে বর্তমান সভাপতি দেশ নেপালকে জানিয়েছে। ফলে এই সম্মেলন স্থগিত হয়ে যায়। দক্ষিণ এশিয়ার সাত দেশ বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল, ভুটান, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ এবং পাকিস্তানের মধ্যে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সহযোগিতার ফোরাম সার্ক ১৯৮৫ সালে যাত্রা শুরু করে। পরে আফগানিস্তান এই সংস্থার সদস্যপদ পায়। দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়ন এবং অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ও সহযোগিতার লক্ষ্যে সার্ক গঠন করা হয়। তারপর থেকেই সার্ক এই অঞ্চলের অর্থনৈতিক, প্রযুক্তিগত, সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং উন্নয়নে কাজ করে চলেছে। বর্তমানে সার্কের আটটি সদস্য দেশ ছাড়াও নয়টি পর্যবেক্ষক দেশ রয়েছে। এসব দেশের মধ্যে রয়েছে জাপান, অস্ট্রেলিয়া, চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইরান, মরিশাস। সার্কের পর্যবেক্ষক দেশগুলোও অব্যাহত সহযোগিতা দিয়ে আসছে।
×